Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণপিটুনির বর্বরতা বন্ধ হোক

| প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে চলছে দেশ। রাজনৈতিক গুম-খুন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে এখন শিশু হত্যা, শিশু-ধর্ষণ, মানুষের মুন্ডু কাটার আদিম বর্বরতায় পদার্পণ করছে সমাজ। একদিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ঘিরে সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব সৃষ্টি করে একটি চক্র মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলছে, অন্যদিকে ছেলে ধরা সন্দেহে রাস্তায় উত্তেজিত জনতার হাতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। এখানেও একটি চক্র সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন। বেশ কিছুদিন ধরেই গলাকাটা পার্টি, পদ্মাসেতুর জন্য মানুষের মাথা সংগ্রহ, ছেলে ধরা আতঙ্ক ইত্যাদি ঘটনার কিছুটা সত্য ও বেশিরভাগ গুজবের আতঙ্কে তোলপাড় চলছে। গত দুইদিনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অন্তত ৩ জন গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত ৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা এবং আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা বার বার ঘটেছে। ২০১৭ সালের শেষদিকে এমন বেশকিছু গণপিটুনির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বিশেষ দূত, বিরোধিদলীয় নেতা ও সদ্য প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশে সুশাসনের অভাবে মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে বলে তার দলের যৌথ সভায় উল্লেখ করেছিলেন।

মানুষকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন বা অস্থিতিশীলতা নেই। বলতে গেলে সরকার বিরোধি শক্তির রাজনৈতিক তৎপরতা খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। সরকার দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবী করছে। ঠিক সেই সময়টাতে সমাজে এমন অস্বাভাবিক, অস্থিরতা, অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা কেন দেখা দিচ্ছে। রাস্তায়-জনপদে মানুষ কেন যখন তখন উত্তেজিত হয়ে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে বিচারহীন হত্যাকান্ডের জন্ম দিচ্ছে, দেশের সমাজতাত্তি¡ক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে যথাশীঘ্র এ বিষয়ে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে হবে। সুশাসনের অভাব ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতা ও নৃশংস ঘটনা সরকারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতির দাবীকে অপাংতেয় করে তুলছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির উন্নয়নের চেয়ে মানুষের নিরাপত্তা ও সামাজিক-রাজনৈতিক শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা সরকার ও রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। সরকার ও রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণেই মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন আদালতের প্রতি ক্রমে আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া প্রাপ্ত অপরাধিরা প্রকাশ্য কুপিয়ে মানুষ হত্যা করছে। সেই সাথে গুম-খুন, ছেলে ধরা, গলাকাটাপার্টি, শিশুধর্ষণের মত অপরাধ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এক শ্রেণীর মানুষ গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে তুলছে। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে উত্তেজিত ও অসহিষ্ণু জনতা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের পিটিয়ে হত্যার মত নির্মম ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। কোনো সভ্য সমাজে এ এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত-অনাকাঙ্খিত।

ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুজব ও সন্দেহের বশে এমন ঘটনা ঘটলেও গত বৃহষ্পতিবার নেত্রকোনায় দুই শিশুর কাটা মস্তক বহনকারি এক যুবক জনতার হাতে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে সারাদেশে একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে ও নারায়ণগঞ্জে গত দুইদিনে অন্তত ৩জন গণপিটুনিতে নিহত ও আরো কয়েকজন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ শ্রেফ সন্দেহের কারণে করুণ পরিনতির শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়। ছেলেধরা ও মুন্ডু কাটা নিয়ে অনেক গুজব ও আতঙ্কজনক প্রচারণা চালু হয়েছে। অবশেষে নেত্রকোণায় এই চক্রের একজন শিশুর কাটামুন্ডুসহ হাতে নাতে ধরা পড়ার পরও এ সম্পর্কে এখনো সুস্পষ্ট কোনো তথ্যপ্রমান হাজির করতে পারেনি পুলিশ। উত্তেজিত জনতা আইন হাতে নিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা না করলে ধৃত ব্যক্তির মাধ্যমে পুরো বিষয়টি উদঘাটন করা হয়তো আরো সহজ হতো। গুজব ও আতঙ্কের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশু-কিশোরদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়নি। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাশীঘ্র এই চক্রকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে। এটাই সকলের প্রত্যাশা। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা ও সম্মিলিত ও সমন্বিত সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন। গণপিটুনি ও আইন হাতে তুলে নেয়ার মাধ্যমে ঘটনার কোনো সমাধান নেই। এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষও উত্তেজিত জনতার হঠকারিতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একটি অবিচার ও নৃশংসতার প্রতিবাদ -প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিরপরাধ মানুষ বিচারহীন মৃত্যুর শিকার হবে, এমনটা খুবই দু:খজনক ও নির্মম। সন্দেহভাজনদের ধরে আইনের হাতে তুলে দেয়া এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধিচক্রকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এই দায়িত্বে ব্যর্থতার কারণেই মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিতে শুরু করেছে। এটি মানুষের আস্থাহীনতার লক্ষণ। মানুষকে আস্থায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন