পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একটি মিথ্যাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে আরো ১০টি মিথ্যার জন্ম হয়। সেই ১০টি থেকে অসংখ্য মিথ্যা, অন্যায় অবিচার সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। আমরা এখন এমনি এক সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থায় বসবাস করছি যা অসংখ্য মিথ্যার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, প্রকাশিত ও প্রভাবিত। মূলত একই(ইউনিপোলার) অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কারণে মিথ্যার এই বেসাতি থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছি না। প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে আমরা সকলেই পশ্চিমা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদি নীলনকশার নিয়ন্ত্রণ, লুণ্ঠন ও প্রোপাগান্ডার শিকার। বিশ্বের সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সম্পদ লুণ্ঠনের যথেচ্ছ ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত রাখতে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তারা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক-মনস্তাত্তি¡ক কলা-কৌশল আরোপ করে থাকে। ভোগবাদী সমাজকে শ্রম দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করাই তাদের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য। যে সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিষয় অর্থনৈতিক বৈষম্য, সম্পদের পুঞ্জিভবন এবং ভোগবাদী ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করে এমন সব রাজনৈতিক, দার্শনিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিষয়কে সমূলে উপড়ে ফেলা তাদের অন্যতম রাজনৈতিক এজেন্ডা। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণেই মুসলমানরা এ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডার অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণের বৈষম্যবোধ জাগিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক মাল্টি-কালচারালিজমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে সারাবিশ্বে একটি যুদ্ধংদেহি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভৌগলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক বাস্তবতা যাই হো না কেন, অর্থনৈতিক-সামরিক আধিপত্য নিষ্কণ্টক রাখেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের মত পরাশক্তিগুলো ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকটা অভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ণে তৎপর রয়েছে। সবক্ষেত্রেই কমন টার্গেট বা এনিমি হচ্ছে, মুসলমানরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ, হোয়াইট সুপারমেসি, ওয়ার অন টেররস, ভারতে হিন্দুত্ববাদ এখন এক প্রকার ফ্যাসিবাদি চরিত্র লাভ করতে শুরু করেছে। এখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট এবং ভারতের বিজেপির একপাক্ষিক বন্দেমাতরম ও ভারত বন্দনার মূলসূত্র যেন একই। যে ধর্মের অন্যতম বানী হচ্ছে, ‘অহিংসা পরমধর্ম’, সেই হিন্দু ধর্মালম্বীরা এখন নানা মিথ্যা অজুহাত খাড়া করে ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করছে, মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। যে ভারত বিশ্বের এক নম্বর বিফ রফতানীকারক দেশ, প্রতি বছর যারা লাখ লাখ গরু জবাই করে বিদেশে মাংস বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার আয় করছে, সেই দেশের হিন্দুরা গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে দেশের মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে নাগরিকত্বের নতুন তালিকা করার নাম করে কোটি কোটি মুসলমানকে ভারতের নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার ফন্দি-ফিকির করে চলছে। একইভাবে চীনের উইঘুরের লাখ লাখ মুসলমান নাগরিকের সাথে গৃহপালিত বন্যপ্রাণীর মত আচরণ করছে চীন সরকার। চীনে সমাজতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরু থেকে উইঘুরি মুসলমানরা বৈরীতা ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের সম্মুখীন হচ্ছে। মার্কিন পুঁজিপতিরা যেমন মুসলমানদেরকে কনজিউমারিজমের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করে, ঠিক একইভাবে চীনের ধর্মহীন ডগম্যাটিক বস্তুবাদের প্রসার এবং স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রশ্নে মুসলমানদের শিক্ষা ও মানসিকতাকে অন্যতম প্রতিবন্ধক বলে মনে করছে। এজন্য শি জিনপিংয়ের রিজিম উইঘুরের লাখ লাখ মুসলমানকে ক্যাম্পে আটকে রেখে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মনগড়া ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। যে শিক্ষা চীনের পুঁজিবাদি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভাবধারাকে আত্মস্থ করে নিবে।
চীনের জিনঝিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের উপর অমানবিক আচরণের সাথে যেমন চীনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডা কাজ করছে, একইভাবে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর সামরিক বাহিনী ও উগ্রবাদি বৌদ্ধদের গণহত্যা বা এথনিক ক্লিনজিংয়ের ঘটনার সাথেও চীনের নিরব সমর্থন দেখা গেছে। পাশাপাশি চীন বাংলাদেশের সাথেও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এ কারণেই রোহিঙ্গা সংকটে চীন একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে চীনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সহজ হতে পারে। তবে রোহিঙ্গা ও উইঘুর মুসলমানদের মানবাধিকারের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চেতনা খুব টনটনে বলে মনে হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার নসিহত করেছিল, যদিও তাদের নসিহতের আগে থেকেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছিল। তবে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব সংকট এবং সামরিক জান্তার নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে বাঁচতে গত ৫ দশক ধরেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও, মালয়েশিয়া, সউদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারতসহ আরো অনেক দেশে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছে। যেখানে পুরো ইউরোপ মিলে তাদের সৃষ্ট সংঘাতের কারণে বাস্তুত্যাগী সিরীয় ও লিবীয় অভিবাসিদের চাপ সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও খাদ্য নিরাপত্তা দিচ্ছে। পশ্চিমারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের সুরাহা করে পুর্নবাসনের প্রশ্নে পশ্চিমাদের বাগাড়ম্বর শোনা গেলেও কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য ও ত্রান সহায়তা বা নিরাপত্তার গ্যারান্টিসহ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করার জন্য পশ্চিমারা কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ব্যর্থতা ইতিমধ্যে নানাভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন ইস্যুতে পশ্চিমা স্বার্থে জাতিসংঘকে কাজে লাগাতে পশ্চিমা দেশগুলোকে যথেষ্ট সক্রিয় ও তৎপর দেখা গেলেও ফিলিস্তিন সংকট, রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনার সুস্পষ্ট দালিলিক প্রমানাদি থাকা সত্তে¡ও তাদেরকে ততটা সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দোহাই দিয়ে মাঝে মধ্যে যে সব বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়, তার পেছনে চীনের সাথে তাদের স্বার্থ দ্ব›দ্ব এবং প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্ব›িদ্বতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চীনের সাথে মার্কিনীদের এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থদ্ব›দ্ব না থাকলে রোহিঙ্গা বা উইঘুরিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে কোনো টু শব্দটিও হয়তো শোনা যেত না। সাম্রাজ্যবাদি শক্তিগুলো মুসলমানদেরকে কমন প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে থাকে। পশ্চিমাদের ফল্স ফ্লাগ বা বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনাকে রং চং মাখিয়ে প্রচার করে যেভাবে মুসলমানদের উপর বেøইম চাপানো হয়, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া বা মিয়ানমারে নগ্ন সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে শিশু-নারীসহ হাজার হাজার মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে তাদের নিরবতা বিশ্ব সভ্যতাকে বড় ধরনের নৈতিক-মানবিক সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
জিনঝিয়াং প্রদেশের পশ্চিমে উইঘুর মুসলমানদের উপর চীন সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে অপ্রত্যাশিতভাবে জাতিসংঘে এক বিরল দৃষ্টান্ত তৈরী হয়েছে। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ ২২টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা চীনের উইঘুরের মুসলমানদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে। জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কাউন্সিলের ৪১তম অধিবেশনে এসব দেশের রাষ্ট্রদূতরা জিনঝিয়াং প্রদেশে চীনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে উইঘুরি মুসলমান নাগরিকদের আটকে রেখে চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতিগোষ্ঠির শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রশিক্ষণে বাধ্য করার ঘটনাকে সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে পশ্চিমাদের যৌথ বিবৃতির জবাবে উইঘুরিদের উপর চীন সরকারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ও রি-এডুকেশন সিস্টেমের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাশিয়া, সউদি আরবসহ ওআইসিভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশ এবং উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভেনিজুয়েলাসহ অন্তত ৩০টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা বিবৃতি দিয়েছে। প্রসঙ্গ হচ্ছে উইঘুর মুসলমানদের জাতিগত স্বাতন্ত্র্য, মানবাধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর চীন সরকারের নগ্ন ও অমানবিক হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ। এটি হঠাৎ করেই ঘটেনি। উইঘুরের মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে চীনা কমিউনিজমের দ্বারা আরোপিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদি ভূমিকায় রয়েছে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার উইঘুর পরিবার জিনঝিয়াং থেকে মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের অবস্থা রাখাইনের রোহিঙ্গাদের মত না হলেও বিশাল সাম্রাজ্যবাদি পরিকল্পনার ছকে তারা তাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে টিকে থাকতে পারছে না। পশ্চিমাদের সাথে চীনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দ্বন্দের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এই ইস্যুতে পশ্চিমারা কথা বলছে, তাদের গণমাধ্যম এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেছে। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নে অথবা উইঘুর মুসলমানদের অধিকার অস্তিত্বের প্রশ্নে পশ্চিমা বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মাথাব্যথা না থাকলেও অনেক লঘু সমস্যার কারণে বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ার মাত্র ১৫হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের খৃস্টান অধ্যুসিত দ্বীপ পূর্ব তিমুরকে আলাদা রাষ্ট্রে পরিনত করতে অথবা দারিদ্রপীড়িত সুদানের খৃষ্টান অধ্যুসিত দক্ষিনাংশ দক্ষিণ সুদান নামে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমাদের যে দায়বদ্ধতা ও তৎপরতা দেখা গেছে মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুসিত অঞ্চল ফিলিস্তিন, কাশ্মির, মিন্দানাও বা উইঘুর নিয়ে তার শতভাগের একভাগও দায়বদ্ধতা দেখা যায়না। শুধুমাত্র মুসলমানদের অনৈক্য ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ ভ’মিকার কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে। সভ্য দুনিয়ায় এ এক দ:খজনক অমানবিক বাস্তবতা। অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষন-লুণ্ঠন ও পুঁিজবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অভিন্ন অবস্থানই কেবল এ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
বিশ্বের প্রধান ধর্মবিশ্বাসী অধিকাংশ মানুষ এখন ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে একটি ক্ষেত্রে একধরণের মতৈক্য দেখা যাচ্ছে, আর তা হচ্ছে- প্রায় সবাই যার যার অবস্থান থেকে মুসলমান বিদ্বেষী অবস্থান নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে খৃষ্টধর্মীয় জনমত এখন চার্চ বা পোপের গন্ডি থেকে বেরিয়ে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজ ও কর্পোরেট মিডিয়ার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমেরিকায় রাজনৈতিক বর্ণবাদ ও অভিবাসন বিদ্বেষী জেনোফোবিয়ার মূল শিকার মুসলমানরা। একইভাবে ভারতের সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর কয়েকটি রাজ্যে নাগরিকত্ব তালিকা নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তার মূল টার্গেটও মুসলমানরা। দেশভাগসহ নানা সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় গত একশ বছরে উপমহাদেশে যে ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন হয়েছে তাতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বৃটিশদের সুনজরে থাকার কারণে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভারতের শহরগুলোতে ভীড় জমিয়েছে। একই কারণে গত ৭০ বছরে ভারতসহ উপমহাদেশে ডায়াসপোরা সারাবিশ্বে বিস্তৃত হয়েছে। নতুন নাগরিত্ব সংশোধনী আইনে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খৃস্টানদের আত্মীকরণের কথা বলা হলেও মুসলমানদের প্রতি তাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এরই প্রেক্ষাপটে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের অনুরূপ বিকল্প পরোক্ষ ব্যবস্থা হিসেবে তথাকথিত নাগরিকত্ব তালিকা তৈরী করে বেছে বেছে মুসলমানদের বাদ দেয়ার কারসাজি দেখা যাচ্ছে। তবে আসামের নাগরিকত্ব তালিকায় বাদ পড়া মুসলমানদের মধ্যে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবার, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ বংশ পরম্পরায় বসবাসরত মুসলমানদের পাশাপাশি হাজার হাজার বাংলাভাষি হিন্দুর নামও রয়েছে। তবে হিন্দুদের নাম পর্যায়ক্রমে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নাগরিক হিসেবে আত্মীকরণের একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও মুসলমানদেরকে তারা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি জারি রেখেছে। শতকোটি মানুষের বহুজাতির একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের এই মানসিকতা গত হাজার বছরে আর কখনো দেখা যায়নি। গো রক্ষার নামে, ধর্ম রক্ষার নামে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে ভারতের মুসলমানরা এখন ইতিহাসের নজিরবিহিন অন্যায়-অবিচার ও হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। ভারতের এই মুসলিম বিদ্বেষ এখন উপমহাদেশের অন্যদেশগুলোতেও পাচার হচ্ছে। মিয়ানমারের বৌদ্ধভিক্ষু অশিন উইরাথু বৌদ্ধধর্মের অহিংসার বানী প্রত্যাক্ষাণ করে বৌদ্ধ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের ডাক দিয়েছেন যার মূল টার্গেট রাখাইনের মুসলমানরা। মিয়ানমার থেকে বৌদ্ধ সন্ত্রাসবাদ এখন শ্রীলঙ্কায়ও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে বৌদ্ধ শাসকদের পরাভুত করে মুসলমানদের ক্ষমতা দখলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় মুসলিম বিদ্বেষী বৌদ্ধ জঙ্গিবাদের উত্থানে সে সব ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। তারা এখন সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে একজাতি আখ্যা দিয়ে মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করছে। তাদের এই ভ‚মিকা বুদ্ধের অহিংসা ও শান্তির বানীর চরম বরখেলাফ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কয়েকটি টুইট বার্তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রগ্রেসিভ কংগ্রেসওম্যানের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে উঠে আসা জনমত প্রতিক্রিয়ায় অভিবাসি বংশোদ্ভুত কংগ্রেস ওম্যান ইলহান ওমর, রাশিদা তালিব, ওকাসিও কর্তেজ ও আয়ান্না প্রেসলির উদ্দেশ্যে করা ট্রাম্পের মন্তব্যকে বর্ণবাদি ও বিদ্বেষপূর্ণ বলে পরিগণিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত অভিবাসিদের নিয়ে গড়ে ওঠা দেশ। শত বছর আগের সিভিল ওয়ার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের কর্পোরেট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে অভিবাসি জনশক্তিই মূল ভ’মিকা পালন করেছে। অভিবাসি জনগোষ্ঠির মধ্য থেকে প্রখর মেধাবী তরুণ-তরুণীরা নিজেদের যোগ্যতার কারণেই মার্কিন রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে সক্ষম হচ্ছেন, তারা ট্রাম্পের মত প্রেসিডেন্টের হাতে মার্কিন সমাজের উদার গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদি মূল্যবোধ ধ্বংসের হুমকির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাদের মানবিক যুক্তিনিষ্ঠ জোরালো বক্তব্যের কাছে ট্রাম্পের একপেশে হোয়াইট সুপারমেসিস্ট বক্তব্য ধোপে টিকছে না। মার্কিন রাজনীতির প্রতিভাবান এসব তরুণ-তর্কিদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে অক্ষম বলেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাদেরকে পূর্ব পুরুষের দেশে চলে যেতে বলছেন। আমরা জানি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন আদিবাসি নন। তার পরিবার জার্মানী থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল। তিনি যখন নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্যদের পূর্বপুরুষের দেশে চলে যেতে বলেন, তার জবাবে ওরা কিন্তু তাকে জার্মানীতে চলে যেতে বলছেন না। তারা শুধু এক চরম দু:সময় ও বর্ণবাদী অমানবিক ব্যবস্থা থেকে বহুত্ববাদী মার্কিন সমাজের সুরক্ষার দাবী তুলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই তরুণ তুর্কিরা ব্যর্থ হলে ভারতে, চীনে, ইউরোপে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের চরম উত্থান ঘটবে, যা বিশ্বকে রক্তাক্ত সংঘাতের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।