Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ জরুরি

মো. শামসুল ইসলাম সাদিক | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

প্রকৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার বৃক্ষ। কোরআনে এ ব্যাপারে বর্ণিত- ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে এবং তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদ্গত করেছি নয়নপ্রীতিকর সব ধরনের উদ্ভিদ। আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি এবং এর দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি এবং সমুন্নত খেজুরগাছ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ’ (সূরা: কাফ, আয়াত-৭, ১১)। সৃষ্টির সেরা মানুষ জাতিকে আল্লাহ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করেছেন। বনাঞ্চল ও বনজাত গাছপালার দ্বারা ভূমন্ডলের পরিবেশ ও মনোরম প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্যলীলার মধ্যে বৃক্ষরাজি অন্যতম, যা ছাড়া প্রাণিকুলের জীবন-জীবিকার কোনো উপায় নেই। মানুষ না থাকলে গাছের কোনো অসুবিধা হতো না, কিন্তু বৃক্ষরাজি না থাকলে মানবজাতির অস্তিত্বই বিলীন হয়ে পড়ত। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী বৃক্ষের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। বৃক্ষ পরিবেশ ও প্রকৃতি জীবজগতের পরম বন্ধু। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বৃক্ষ। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতি জরুরি অক্সিজেন আসে বৃক্ষ থেকে। বৃক্ষ মানুষের জীবনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় অর্থনীতি, আবহাওয়া এবং জলবায়ু সহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বন্যা, জলোচ্ছ¡াস, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি প্রতিরোধে বৃক্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। বৃক্ষ ছাড়া আমাদের পৃথিবীতে বসবাস চিন্তা করা যায় না। পৃথিবীতে মানুষের খাদ্য, ঔষধ, বস্ত্র, ঘরবাড়ি তৈরি, মাটির ক্ষয়রোধ, আবহাওয়া ও জলবায়ু সঠিক রাখা, পরিষ্কার পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা, কৃষি জমির উৎপাদন বৃদ্ধি করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধন ও বেকারত্ব দূর করার ক্ষেত্রে বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছ না থাকলে পৃথিবীর মধ্যে বন ও বন্যপ্রাণী থাকতো না। বৃক্ষ আল্লাহ প্রদত্ত এক অমূল্য সম্পদ। তাই বৃক্ষহীনতা যেকোনো দেশের জন্য, যেকোনো জাতির জন্য অভিশাপ স্বরূপ।

গাছ ও পরিবেশের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক অন্তর্নিহিত। গাছ আমাদের পরম বন্ধু। কিন্তু আমরা কতটুকু যতœশীল বন্ধুর প্রতি? আমরা কোনো কারণ ছাড়াই অথবা সামান্য কারণ দেখিয়ে বন উজাড় করে ফেলি। একটা দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গাছপালা শুধু কার্বন ড্রাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে উপকারের পরিসমাপ্তি ঘটায়, তা না। বড় বৃক্ষ বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য আজ প্রতিদিন বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। দেশে বজ্রপাত, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ধস, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। তাই ইচ্ছেমতো গাছ কাটা ও বনভূমি উজাড় করা ঠিক নয়। বনাঞ্চল না থাকলে প্রাকৃতিক পরিবেশ হয়ে উঠত উষ্ণ, পৃথিবী হয়ে উঠত মরুভূমি এবং মানুষের অস্তিত্ব হতো বিপন্ন। রাসুল (সা.) উর্বর ভূমির সুপরিকল্পিত ব্যবহারে বৃক্ষ রোপণ ও বনায়নের জন্য জোরালো তাগিদ দিয়ে ইরশাদ করেন- ‘কোনো মুসলিমের রোপিত গাছ থেকে কোনো ব্যক্তি ফল ভক্ষণ করলে তা পরোপকার হিসেবে বিবেচিত হবে, কোনো ফল চুরি হলে তা-ও পরোপকার হিসেবে বিবেচিত হবে, কোনো পাখি যদি ওই গাছের ফল ভক্ষণ করে, তবে তা জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে’ (বুখারি)। প্রকৃতি ও পরিবেশরক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই। আধুনিক সুরম্য অট্টালিকা আর ইট-কাঠের নগরজীবন সত্তে¡ও বনাঞ্চল ছাড়া মানুষের বাঁচার উপায় নেই। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ অপরিহার্য। পৃথিবীতে লাখ লাখ প্রাণি ও উদ্ভিদের বসবাস হলেও গাছ কাটার কারণে গহীন অরণ্যের জীববৈচিত্র্য লোপ পাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘিœত করার জন্য মানুষই একমাত্র দায়ী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছু স্বার্থপর ব্যক্তি বন-জঙ্গল উজাড় করছে। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মানুষের ঘরবাড়ি, চাষাবাদ ও শিল্পায়নের জন্য প্রচুর জমিজমা লাগছে। ফলে বন-জঙ্গল কেটে এসব প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে। এতে পশুপাখি অন্ন ও বাসস্থান হারাচ্ছে এবং অন্য জীববৈচিত্র্য লোপ পাচ্ছে। পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা বাড়ছে। ফল-ফসল ও প্রাণহানি ঘটছে। এমন মহাবিপর্যয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক বনায়ন একান্ত দরকার। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, ফলে তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সূরা:রুম, আয়াত- ৪১)।

জনসংখ্যার চাপে বনভূমির পরিমাণ ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ কমে আসায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে আবহাওয়ায়। বৃক্ষ নিধনের ফলে বাতাস দূষিত হচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে মাটি। পরিবেশ আজ সংকটের মুখোমুখি। পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় অনাবৃষ্টি দেখা দিচ্ছে। ফলে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বিলীন হয়ে যাচ্ছে অতুলনীয় সবুজ সৌন্দর্য। মানুষ ও প্রাণীর অস্তিত্বের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সবুজ বৃক্ষরাজি ও বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বনাঞ্চল একদিকে নিসর্গে শোভা বাড়ায়, অন্যদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা পালন করছে। বনভূমি বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফসল ভালো হয়। তাছাড়া গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, ভূমির ক্ষয়রোধ করে। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়তে গাছ নিধন নয়, সৃজনই হোক সবার লক্ষ্য। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহলে সে যেন সেই বিপদসংকুল মুহূর্তেও তা রোপণ করে দেয়’ (আদাবুল মুফরাদ)। একটি দেশের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় আঠারো শতাংশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্ত্তী সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বনভূমি, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চল বনভূমি। সুন্দরবন বাদ দিলে বন বলতে যা অবশিষ্ট থাকে তা খুবই নগণ্য। ওয়াল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের মতে, এর পরিমাণ মাত্র পাঁচ শতাংশ। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। যেখানে ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে ৯৬৪ জন মানুষ। ২০১০ সালের শ্রমিক জরিপে দেখা যায় মোট বেসামরিক শ্রমিক ৫৭.১ মিলিয়ন এবং এর মধ্যে বিশাল একটি অংশ বনজ সম্পদ সৃষ্টি কিংবা বনজ সম্পদ নির্ভর উৎপাদনমুখী কর্মকান্ডে নিয়োজিত। ২০১১-২০১২ সালের বসতবাড়ি ভিত্তিক বনজ জরিপে দেখা যায় বন নির্ভর কর্মকান্ডে মোট ৭.৪২ মিলিয়ন শ্রমিক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছে। ২০১৪-১৫ সন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৩.১৯ শতাংশ বৃক্ষাচ্ছাদন এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এক সময় বাংলাদেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৮টি জেলায় কোনো বনায়ন কার্যক্রম ছিল না। এখন প্রায় সবকটা জেলাতেই সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে রয়েছে বনায়নের বিপুল সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে। পরিকল্পিত একটি বাগানেই হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আয়ের উৎস। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য দেশ গড়ে তুলতে হলে বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।



 

Show all comments
  • maksud ১৬ অক্টোবর, ২০২০, ১১:৩৬ পিএম says : 0
    valo hoy ni likha ta aro valo korte parle valo hoto
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন