Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

জনগণের ভোটে নির্বাচিত মিশরের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি ১৭ জুন ২০১৯ ইং বিচারকের উপস্থিতিতে শুনানী চলাকালে কাচঘেরা বুলেট প্রুফ বন্দী খাচায় মৃত্যুবরণ করেন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার কারণে মিশরের সেনা প্রধান আবদুল ফাত্তাহ সিসি ক্ষমতার লোভে মুহাম্মদ মুরসিকে হামাসের সাথে গোপন আতাতের অজুহাত সৃষ্টি করে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করায়। গতানুগতিক নিয়মনীতি লঙ্গন করে সাময়িক জান্তা মুরসিকে কারাগারে মানসিক নির্যাতনে তিলে তিলে জীবননাশের দিকে নিয়ে ছিল। মুরসির মৃত্যুতে কেহ বলেছেন একটি সিংহের মৃত্যু, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরগোদান বলেছেন মুরসি শাহাদাৎ বরণ করেছেন, কাতারের আমির শায়খ তামিম বিন হামদ আস সানি, মালোয়শিয়া, ইরান মুরসির মৃত্যুতে শোক জানালেও মুসলিম অন্যান্য রাষ্ট্র প্রকাশ্যে শোক বা নিন্দা কোন কিছুই জানায় নাই, যদিও এখনো ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র পৃথিবীতে রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি তথা বিচার বিভাগ যে নির্যাতনের হাতিয়ার বা রাষ্ট্র যন্ত্রের ক্রীড়ানক হিসাবে ব্যবহ্নত হয়, মুরসির মৃত্যুই এর স্পষ্ট প্রমাণ।

পাক-ভারত উপমহাদেশের সমসাময়িক দূর্দান্ত প্রতাপশালী তিন জন নেতা যাদের ভ‚মিকা ও সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হয়েছে জনগণের ভাগ্য, সে তিন জনেরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বপর ঘটনার যারা ছিলেন কেন্দ্র বিন্দু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীব ও ইন্দারা গান্ধী নিহত হয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা এবং জুলফিকার আলী ভূটোর মৃত্যু হয়েছিল আইনের গ্যারাকলে। বাংলাদেশে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছেন এমন কোন ব্যক্তি নাই যারা কারাগারের অতিথিশালায় অতিথি হন নাই, ৩০ টাকার ইফতারী সকলের জন্যেই জোটেছে। ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণকারী শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক জেল খেটেছেন এবং একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এখনো খাটছেন যার মুক্তিতে বর্তমান সরকারের প্রচন্ড অনাগ্রহ। দুই নারী প্রধানমন্ত্রী (সাবেক ও বর্তমান) একই সাথে জেল খেটেছেন, তবে সাজা হওয়ার রায় কি নির্মম সে অভিজ্ঞতার মূখোমুখি তিনি হন নাই। প্রতাপশালী মরহুম হুসেই মুহম্মদ এরশাদ জেলের স্বাদ পুরোটাই গ্রহণ করেছেন। জেলখানার অতিথি শালায় যেতে হয় নাই সে সকল রাষ্ট্রপতিদের যাদের কামড় দেয়ারমত নখ বা দাত ছিল না এবং যাদের কাজই ছিল শুধু জি হুজুর, জাহাপনা বলা। বিচারপতি শাহাবউদ্দিন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে যথেষ্ঠ প্রতাপ খাটিয়েছেন, কিন্তু তিনিও বলেছিলেন যে, মিলাদে অংশ গ্রহণ এবং মাজার জেয়ারত করা ছাড়া সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতির অন্যকোন কাজ নাই। কিছু রাষ্ট্রপতি ছিলেন যারা সুনাম দুর্নাম কিছুই কামাইতে পারেন নাই। তবে বিএনপি প্রতিষ্ঠাকালিন মহাসচিব ডা. বি চৌধুরী’কে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে বাধ্যতামূলক পদত্যাগের মাধ্যমে। অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ১/১১ সময়ের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন। স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে ময়দানে দৌড়ে বেরিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে কালু ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যিনি মেজর র‌্যাংকের একজন সেনা কর্মকর্তা হয়েও একটি রাজনৈতিক বার্তা দিয়ে ছিলেন তিনিও হত্যার শিকার হয়েছেন রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়। রাষ্ট্র নায়ক বা রাষ্ট্রপতি হলে হত্যার শিকার হতে হবে, জেল খাটতে হবে বা নির্মম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে এটা আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু নহে, বিষয়বস্তু হলো অন্যখানে।

দীর্ঘকাল ধরে শোনা যাচ্ছে যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেন একটি লজ্জাবতী গাছের মত, একটু স্পর্শ করলেই যেন নুয়ে পড়ে, যা ভুক্তভোগী জনগণ মোটেই পছন্দ করে না। সরকার যে আইন করবে বা সরকার মামলাটি যেভাবে সাজিয়ে দিবে সে সাজানো পুতুলের গায়ে রং তুলি মাখানো বিচার বিভাগের দায়িত্ব নহে, বরং রাজনৈতিক মামলায় আদালত থেকে মানবিক আচরন যদি পেতে হয় তবে তা পাওয়ার একমাত্র হকদার অভিযুক্ত ব্যক্তি, যাদের ক্ষমতাসীনরা কারামুক্ত রাখতে পছন্দ করে না। মিশরের প্রধান বিচারপতি যদি মুহাম্মদ মুরশির প্রতি নির্মম না হতেন, তাকে যদি মানসিক ও শারিরিক নির্যাতন করার সুযোগ না দেয়া হতো, তবে হয়তো বিচারকের সামনেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। সম্প্রতি ২৮ বছর পূর্বে সংগঠিত একটি ঘটনায় অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে ট্রেন হামলার অভিযোগে ৯ জন’কে ফাসিসহ অনেকে যাবৎ জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। কোন মানুষকে হত্যার জন্য বোমা/গুলি করে আক্রমন করাকে সমর্থন নয় বরং নিন্দা করি। তারপরও এ ঘটনায় ৯ জনের ফাসি দৃষ্টিকটু হলেও বলা যাবে না, কারণ আদালতের সমালোচনা করা মানা, যেহেতু কথায় বলে আদালতই নাকি মানুষের শেষ আশ্রয়।

ক্ষমতায় থাকলে কারো কোন অপরাধ ধর্তব্য নহে, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রতঙ্গ সবই ক্ষমতাসীনদের মনোরঞ্জনে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। ক্ষমতাচ্যুত হলেই বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ক্ষমতা দখলকারীকে তুষ্ট রাখার জন্য ক্ষমতাচ্যুতদের বিচার শুরু করে, উদ্দেশ্য থাকে ন্যায় বিচার নহে বরং ক্ষমতাসীনদের মনোরঞ্জন। এ অবস্থা সমগ্র পৃথিবীতে, মানবতা বা নৈতিকতার অবস্থান রয়েছে শুধুমাত্র মূখে মূখে।

আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতা, প্রাগ ইসলামী যুগ তথা আইয়ামে জাহিলিয়াতের বর্বরতার কথা শুনেছি। মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শিখে নাই, মানুষ যখন কাচা গোশত ভক্ষণ করতো, সে সময়ের বর্বরতার কথা শুনেছি। এখনও শুনছি পৈশাচিক, অমানবিক ও বর্বরতার কাহিনী। তবে পৃথিবীতে এখন যে বর্বরতা চলছে, তা ইতিহাসের যে কোন বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় নির্দেশে মানুষ হত্যা, পূর্বেও ছিল এখনও চলছে কোটারী স্বার্থের কারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন যে কোন নির্মম ঘটনার চেয়ে কম নহে। জাতিসংঘ চিৎকার করে রোহিঙ্গাদের পূর্ণবাসনের কথা বললেও রোহিঙ্গারা শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অন্যদিকে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলি মুসলমানদের বিপক্ষে। এছাড়াও মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানগণ গণতন্ত্র যাহাতে রাজতন্ত্রের সিংহাসন দখল করতে না পারে এ জন্য মুসলিম রাষ্ট্রের মুসলমান রাজা, সূলতানরা অমুসলিম রাষ্ট্র তথা বৃটেন, আমেরিকা, চীন, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্রের কর্নধারদের ভোগ বা সেবা দানে ব্যস্ত। যার কারণ মুরসির মৃত্যুতে যে পরিমাণ প্রতিবাদ মুসলিম বিশ্ব থেকে হওয়া উচিৎ ছিল, তা মোটেই হয় নাই। অন্যদিকে একশ্রেণীর মাদরাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ গণহারে যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে মুসলিম সমাজ মাথা উচু করে কতটুকু দাড়াতে পারবে, তাহাও এখন ভাবনার বিষয়।

রোহিঙ্গা পূর্ণবাসনে সৌদিবাদশাসহ ইসলামী বিশ্ব বা ওয়ার্ল্ড ইসলামীক কাউন্সিল (ও.আই.সি) যে ভ‚মিকা রাখার কথা ছিল তা মোটেই সম্ভব হয় নাই। বর্তমানে নতুন করে ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাহলো রাখাইনকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা। প্রস্তাবটি ভারতের পক্ষ থেকে উঠেছে। সংবিধান মোতাবেক ভারত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে ভারত একটি চরম হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র এবং দু:ক্ষজনক হলেও সত্য যে, সে ভারতের বুদ্দিজীবিদের নিকট থেকেই অসাম্প্রদায়িকতার মর্মবানী শুনতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, পূর্ণবাসনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী নিজেও যাচ্ছেন, যদিও বিষয়টি সমাধানের জন্য বিএনপিসহ সর্বদলীয় সভা ডেকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের তিনি উদ্দ্যোগ নিতে পারতেন। কিন্তু যে বিষয়টি হয়েছে তা শুধু একক ক্রেডিট বা বাহাবা নেয়ার বিষয় নয়, বরং জাতীয়ভাবে প্রাধান্য দেয়া বাঞ্চনীয় ছিল, যা পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রে হয়ে থাকে। গোটা পৃথিবী এখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিন জিয়াং প্রদেশে মুসলিম শিশুদের পরিবার থেকে চীন সরকার আলাদা করে দিয়েছে। তাদের আচরণ, ধর্ম বিশ্বাস ও ভাষা বদলে দিতেই চীন সরকার এহেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে গবেষকগণ মনে করেন। ভারতে “জয় শ্রীরাম” না বলায়” ১১ বৎসর বয়সী মাদ্রাসার ছাত্রকে মারধর করা হয়েছে। নোভেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্যসেন বলেছেন “জয় শ্রীরাম” মানুষ পেটানোর শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। চীনের জিন জিয়াং প্রদেশের ১০ লক্ষ জাতিগত মুসলিমকে উইঘুর বন্ধী শিবিরে আটকে রাখা হয়েছে। শ্রীলংকার মুসলিম বিদ্বেষ ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষের প্রতিবাদে বিশ্ব মুসলিম নেতৃত্ব একমাত্র এরদোগান ছাড়া প্রায় সকলেই রয়েছে নিরব দর্শকের ভ‚মিকায়।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী মনোভাব বাংলাদেশের অনেক সমস্যার সমাধান না হওয়ায় মূল কারণ। সকল সমীক্ষা আলোচনা পর্যালোচনায় এটাই প্রতিয়মান হয় যে, ১৯০৫ ইং সনের বঙ্গবঙ্গ সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল, তাহলে প্রায় সকল আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিশেষ করে পানি বন্টনের ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য চাতকপাখীর মত বাংলাদেশকে ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। অন্যদিকে স্বাধীনতার জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রয়োজন হতো না, বাংলাদেশ স্বাভাবিক ভাবেই শক্তিশালী থাকতো। রাজনীতির গ্যারাকলে বাংলাদেশকে বারবার অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু দিন পর পর বিভিন্ন অজুহাতে রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমার নির্যাতন চালাচ্ছে। রাষ্ট্র তাদের ভোটাধিকার সহ নাগরিকত্ব হরন করেছে, ফলে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মায়ানমারকে বিশ্বাস বা আস্থা রাখার যুক্তি সংগত কোন কারণ নাই। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন তাদের জন্য আলাদা ভ‚খন্ড। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইন ভ‚খন্ডকে যদি স্বয়ত্বশাসন সহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের পূর্ণবাসন করা যায় তবে তাহাই হবে তাদের জন্য একমাত্র নিরাপদ স্থান। প্রতিকারের জন্য জাতিসংঘ উদ্যোগ জানাবে, বাস্তরে কিছুই হবে না, যেমনটি হয় নাই ইতোপূর্বে-তা হতে পারে না।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন