পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেনের মহাসড়কটি সরকারের মেগা প্রজেক্টের মধ্যে অন্যতম। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ২০১৩ সালে এ প্রকল্পটির কাজ একনেকে অনুমোদিত এবং ২০১৬ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা রুটে চারটি প্যাকেজে এই মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পটির বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আগামী বছরের জুনে এ মহাসড়কটি উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তার আগেই সড়কটির কোনো কোনো অংশ দেড় থেকে দুই ইঞ্চি পর্যন্ত দেবে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় এসব ত্রুটি কার্পেটিং করে সারানো হয়েছে। নতুন করে নির্মাণাধীন একটি মহাসড়কে এমন ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং জোড়াতালি দেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। নির্মাণের আগেই এমন পরিস্থিতি বিশ্বের কোথাও দেখা যায় কিনা আমরা জানি না। মহাসড়কটি দেবে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা নিম্নমানের কাজকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, সড়কের পিচের জন্য পাথর ও বিটুমিনের যে মিশ্রণ তৈরি করা হয়, তার আনুপাতিক হার ঠিকমতো না হলে সড়ক দেবে যায়। আবার দুর্বল নকশা ও নিম্নমানের কাজের পাশাপাশি ওভারলোড যানবাহনের কারণে এমন হয়ে থাকে। অবশ্য প্রকল্প পরিচালক এ কারণ মানতে নারাজ। তিনি অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল ও ওভারলোডিংকে দায়ী করছেন। ওভারলোডিং যানবাহন চলাচলের বিষয়টি দেখাশোনার ব্যাপার হলেও সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলের বিষয়ের কারণটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। সড়ক-মহাসড়কে কি যানবাহন চলাচলের সংখ্যা নির্ধারণ করা থাকে? এ ধরনের যুক্তি দায় এড়ানোর কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
গত এক দশক ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একের পর এক মেগা প্রজেক্টের কাজ চলছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দশটি মেগা প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। বলা যায়, দেশ এখন মেগা প্রজেক্টের যুগে আছে। এসব মেগা প্রজেক্ট নিয়ে কম-বেশি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠছে। এমন একটি কথা প্রবাদ বাক্যের মতো হয়ে গেছে যে, মেগা প্রজেক্ট মানে মেগা দুর্নীতির সুযোগ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এমন অভিযোগ বেশি তোলা হচ্ছে। অনেকে আবার অনুচ্ছস্বরে এ কথাও বলেন, এত বড় বড় প্রকল্প, সবই যে শতভাগ স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে হবে তা নয়, কিছু দুর্নীতি হতেই পারে। এসব অভিযোগ-অনুযোগ মাথায় নিয়েই বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে চলছে। তবে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতার ঘাটতির অভিযোগ অহরহই উঠছে। যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া এবং অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি প্রায় নিয়মিত হয়ে পড়েছে। জনগণের অর্থের টাকায় নির্মাণাধীন এসব অনিয়ম ও অপচয়কে অনুমোদন করেই মেগা প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে চলছে। আবার কোনো কোনো মেগাপ্রজেক্টের কাজ শেষ কিংবা নির্মাণাধীন অবস্থায়ই ভয়াবহ ত্রæটি ও অনিয়ম ধরা পড়ে। নির্মাণাধীন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যে ত্রæটি দেখা দিয়েছে তা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যত যুক্তি দেয়া হোক না কেন তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। চার লেনের কাজটির নকশা, উপকরণ, মাটির ধরণ ইত্যাদি নিরুপণে যথার্থতার অভাব যে রয়েছে, তা বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকেই বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশে যে খরচ হয়, তা বিশ্বের কোথাও হয় না। পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, প্রতিকিলোমিটার সড়কের নির্মাণ ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। পার্শ্ববর্তী দেশে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় এক কোটি টাকার মতো। শুধু সড়ক নয়, ব্রিজ-কালভার্টসহ অন্যান্য স্থাপনার নির্মাণ ব্যয়ও বেশি। ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রতিকিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ৫৮ কোটি টাকার বেশি। এক কিলোমিটারে এত টাকা ব্যয় হচ্ছে, অথচ তার কাজ নিম্নমানের-এই দুরাচার কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা গেছে। উদ্বোধনের এক বছরের মাথায় সংস্কার কাজে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিছু লোকের দুর্নীতি ও স্বার্থের কারণে জনগণের অর্থের এই অপচয় দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! বলা হয়, বৃষ্টির কারণে সড়কের বেহালদশা হয়ে পড়ে। আমরা যদি থাইল্যান্ড, সিঙ্গুপুর, মালয়েশিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখব সেখানে প্রায় সারাবছরই বৃষ্টিপাত হয়। এসব দেশে তো বাংলাদেশের সড়কের মতো নির্মাণকালে বা নির্মাণের বছর পার না হতে এমন দুর্দশা দেখা যায় না। তারা এই বৃষ্টি বা অন্যান্য সমস্যার কথা মাথায় রেখেই সড়কের রোডম্যাপ ঠিক করে। বাংলাদেশে তা করা হয় না, এ সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজের কারণে। তারা ভাল করেই জানে, সড়ক টেকসই হলে তাদের দুর্নীতির সুযোগও কমে যাবে।
দেশে মেগা প্রজেক্ট হোক, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা উন্নত হোক-তা সকলেরই কাম্য। তবে এসব প্রকল্প যথাযথভাবে নির্মাণের মাধ্যমে টেকসই করার বিষয়টি কতটা নিশ্চিত করা হচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ও নির্মাণাধীন সড়ক-মহাসড়ক কতটা টেকসই হবে, তার গ্যারান্টির কথা শোনা যায় না। এসব ক্ষেত্রে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে সড়কের স্থায়িত্ব সম্পর্কে নির্দিষ্ট এবং যৌক্তিক সময় বেঁধে দেয়া হলে তা যেমন টেকসই হবে তেমনি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাট এবং অপচয়ও অনেক কমে আসবে। উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য ভ্যাট-ট্যাক্সের মাধ্যমে সরকারকেও জনগণের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে না। আমরা মনে করি, দেশে যেসব মেগা প্রজেক্টের কাজ চলছে, সেগুলো যথাযথ ও মানসম্পন্নভাবে হচ্ছে কিনা, এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়মিত তদারকি করা দরকার। কাজ হবে, মান ঠিক থাকবে না, কিংবা যত বড় প্রজেক্ট তত বেশি দুর্নীতি-এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।