চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা আব্দুল হান্নান তরুকখলী
মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেনÑ ‘তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৫২)। দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি ও মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে আল্লাহর জিকির। বেশি বেশি করে মহান আল্লাহর জিকির করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেনÑ ‘হে ঈমানদানগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে এবং সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে’ (সূরা আহযাব : আয়াত ৪১-৪২)। মানবাত্মার শান্তির একমাত্র পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর জিকির। আল্লাহর জিকিরের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে অগণিত হাদীস রয়েছে। এ সম্পর্কে নি¤েœ কয়েক খানা হাদীস উপস্থাপন করা হলো :
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনÑ আল্লাহপাক বলেছেন, আমি আমার বান্দার কাছেই থাকি যখন সে আমার জিকির করে এবং আমার জিকিরের জন্য তার ওষ্ঠ নড়ে (বুখারী)।
(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলেপাক (সা.) ইরশাদ করেনÑ প্রত্যেক জিনিসের একটি মাজন রয়েছে, আর অন্তরের মাজন হলো আল্লাহর জিকির (বায়হাকী দাওয়াতুল কবীর)।
(৩) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) ও হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলেপাক (সা.) ইরশাদ করেনÑ যে কোন মানব দল আল্লাহ জিকির করতে বসে, নিশ্চয়ই আল্লাহর ফেরেস্তাগণ তাদেরকে ঘিরে নেয়, তার রহমত তাদেরকে ঢেকে ফেলে এবং তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হয়। অধিকন্তু আল্লাহ স্মরণ করেন তাদেরকে আপন পার্শ্বচরদের কাছে (মুসলিম)।
(৪) হযরত আবু মুসা আমআরী (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলেপাক (সা.) ইরশাদ করেনÑ যে আল্লাহর জিকির করে এবং যে জিকির করে না তাদের উদাহরণ হচ্ছে যথাক্রমে জীবিত ও মৃতের ন্যায় অর্থাৎ যে আল্লাহর জিকির করে তার অন্তর জীবিত এবং যে আল্লাহর জিকির করে না তার অন্তর মৃত (বুখারী ও মুসলিম)।
(৫) হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ আমরা একবার রাসূলেপাক (সা.)-এর দরবারে ছিলাম। এ সময় তিনি আমাদেরকে বললেন, তোমাদের কেউ কি দৈনিক এক হাজার নেকী অর্জন করতে সক্ষম? তখন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে একজন আরজ করলেনÑ ইয়া রাসূলাল্লাহু! আমরা দৈনিক এক হাজার নেকী কিভাবে লাভ করতে পারবো? রাসূলেপাক (সা.) জবাবে বললেনÑ তোমাদের যে কেউ দৈনিক একশ’ বার ‘সুবাহানাল্লাহ’ বলবে তার আমলনামায় এক হাজার নেকী লেখা হবে এবং তার এক হাজার গুনাহ ক্ষমা করা হবে (মুসলিম)।
(৬) হযরত আবুযর গেফারী (রা.) বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন, একবার রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলোÑ কোন বাক্য শ্রেষ্ঠ? রাসূল (সা.) বললেন, শ্রেষ্ঠ বাক্যটি হচ্ছে ‘সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ (মুসলিম)।
(৭) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনÑ “যে দৈনিক একশ’ বার বলবে ‘সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে যদিও তার গুণাহ সমুদ্রের ফেনা রাশির ন্যায় বেশি হয়” (বুখারী ও মুসলিম)।
(৮) হযরত সামুরা ইবনে জনদুব (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলেপাক (সা.) ইরশাদ করেন শ্রেষ্ঠ বাক্য হলো চারটিÑ ‘সুবহানাল্লাহি, ওয়াল হামদুলিল্লাহি, ওয়া লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ (মুসলিম)।
(৯) হযরত জাবের (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনÑ শ্রেষ্ঠ জিকির হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আর শ্রেষ্ঠ দোয়া হলোÑ ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ (তিরমীজি ও ইবনে মাজাহ)।
(১০) হযরত আমর ইবনে শুআইব (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলেপাক (সা.) ইরশাদ করেনÑ যে ব্যক্তি সকালে একশ’ বার ও বিকালে একশ’ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে সে তার ন্যায় হবে যে একশ’ বার হজ করেছে। যে ব্যক্তি সকালে একশ’ বার ও বিকেলে একশ’ বার ‘আলহামদু লিল্লাহি’ বলবে সে তার ন্যায় হবে যে একশ’ ঘোড়ায় একশ’ মুজাহিদ রওয়ানা করে দিয়েছে। যে ব্যক্তি সকালে একশ’ বার ও বিকেলে একশ’ বার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলবে সে তার ন্যায় হবে যে ইসমাঈল বংশীয় একশ’ দাস মুক্ত করেছে। যে ব্যক্তি সকালে একশ’ বার ও বিকেলে একশ’ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে, সে দিন তার অপেক্ষা অধিক সওয়াবের কাজ আর কেউ করতে পারবে না। অবশ্য সে ব্যক্তি ব্যতীত, যে এরূপ বলেছে বা এ অপেক্ষা বেশি বলেছে (তিরমীজি)।
(১১) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনÑ যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা একশ’ বার বলবে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ কিয়ামতের দিন তার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বাক্য নিয়ে কেউ উপস্থিত হতে পারবে না, কেবল সে ব্যক্তি ব্যতীত, যে এর মতো বা এর অপেক্ষা অধিক বলবে (বুখারী ও মুসলিম)।
(১২) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনÑ দুটি সংক্ষিপ্ত বাক্য যা বলতে সহজ অথচ পাল্লাতে ভারী এবং আল্লাহর নিকট অতি প্রিয় তা হলো ‘সুবাহাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম’ (বুখারী ও মুসলিম)।
(১৩) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেনÑ ‘লা হাওয়লা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ বাক্যটি নিরানব্বইটি রোগের ওষুধ, যাদের সহজটা হল চিন্তা (বায়হাকী দাওয়াতুল কবীর, মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-২০২)।
মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি প্রতিটি লোম ও চুল আল্লাহর জিকির করে থাকে। ইরশাদ হচ্ছেÑ ‘এমন কিছু নেই যা তার তাসবীহ বা জিকির করে না’ অর্থাৎ সব কিছুই তার জিকির করে (সূরা বনিইসরাইল : আয়াত-৪৪)। শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সচল রাখতে হবে একমাত্র আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই। মানব দেহের মূল হলো ক্বালব বা অন্তর। এই ক্বালব পবিত্র হলে সমস্ত শরীরই পবিত্র হয়ে যায়। আর এই ক্বালব (অন্তর) আল্লাহর জিকির করলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গই আল্লাহর জিকির করে থাকে। পক্ষান্তরে ক্বালব নষ্ট হলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়Ñ ফলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ আল্লাহর জিকির করতে পারে না। এই ক্বালব বা অন্তরকে বিশুদ্ধ রাখার একমাত্র পন্থা হলো আল্লাহর জিকির। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ ‘আল্লাহর জিকিরেই ক্বালব বা অন্তর প্রশান্ত হয়’ (সূরা রা’দ : আয়াত ২৮)। নিজে নিজে জিকির করলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। তবে আল্লাহর জিকিরের পূর্ণ সওয়াব পেতে হলে ইলমে শরীয়ত ও ইলমে তাসাউফে অগাধ পা-িত্যের অধিকারী কোন বুজুর্গের সাহচর্যে বা সুহবতে যেতে হবে এবং তার নিকট থেকে জিকিরের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। যেমনÑ একজন চিকিৎসক রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ। কিন্তু তিনি যখন অসুস্থ হবেন তখন তার সুস্থতার জন্য অন্য যে কোন উচ্চমানের চিকিৎসকের নিকট তাকে অবশ্যই যেতে হবে। অনুরূপ জিকিরের পূর্ণ সওয়াব পেতে হলে ইলমে শরীয়ত ও ইলমে তাসাউফে অগাধ পা-িত্যের অধিকারী কোন বুজুর্গানে দ্বীনের সুহবতে বা সাহচর্যে যেতে হবে এবং তার নিকট থেকে জিকিরের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। হযরত হানজালা ইবনে রাবিয়া উসাইদী (রা.) বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেনÑ আমার সাথে হযরত আবু বকর (রা.)-এর সাক্ষাৎ হলো। তিনি বললেনÑ কেমন আছ হানজালা? আমি বললাম হানজালা মুনাফিক হয়ে গেছেন। তিনি বললেনÑ সুবহানাল্লাহ! এ কি বল হানজালা? আমি বললামÑ আমরা যখন রাসূল (সা.)-এর কাছে থাকি, তিনি আমাদেরকে বেহেশত-দোযখ স্মরণ করিয়ে দেন যেন আমরা এসব চোখে দেখি, কিন্তু আমরা যখন রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে বের হয়ে আসি এবং বিবি-বাচ্চা ও ক্ষেত-খামারে লিপ্ত হই তখন তা অনেকটা ভুলে যাই। তখন আবু বকর বললেনÑ আমরাও অনুরূপ অনুভব করি। অতঃপর আমি ও আবুবকর রাসূলেপাক (সা.)-এর দরবারে গেলাম এবং আমি আরজ করলামÑ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা যখন আপনার পবিত্র সুহবতে থাকি আর আপনি আমাদেরকে বেহেশত-দোযখের কথা স্মরণ করিয়ে দেন যেন তা আমরা আমাদের চোখে দেখি। কিন্তু যখন আমরা আপনার কাছ থেকে বের হয়ে যাই এবং বিবি-বাচ্চা ও ক্ষেত-খামারে লিপ্ত হই তখন তা আমরা অনেকটা ভুলে যাই। তখন রাসূল (সা.) বললেনÑ তার কসম যার হাতে আমার জান রয়েছে, যদি তোমরা সর্বদা আমার সুহবতে থাকতে। যেরূপ তোমরা আমার কাছে থাক এবং সর্বদা আল্লাহর জিকিরে থাক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।