পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ এবং ‘গো মাতা কি জয়’ স্লোগান দিতে বাধ্য করায় ভারতজুড়ে তোলপাড় চলছে। নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করছেন ড. অমর্ত্য সেন, শাবানা আজমী, অরুন্ধতী রায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকেই। কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলগুলো নীরব।
পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো ধর্মের মানুষ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বা যেকোনো কারণে বিপন্নবোধ করলে তাদের পাশে দাঁড়ানো বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি। ঢাকার রাজপথে নেমে পড়েন প্রতিবাদী মানুষ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকে সেটাই দেখা যায়।
এমনকি দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে প্রতিবাদে হইচই যারা করেন; তারা ভারতে ধর্মের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বিপন্ন মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করছেন না। ভারতের মুসলমানদের কি নাগরিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদাবোধ নেই? রোহিঙ্গাদের জায়গা দিয়েছি; ভারতের বিপন্ন মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি না কেন? তাহলে কি মুসলমানদের ভারতে জন্ম নেয়া পাপ!
বিজেপি সরকারের ‘এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম’ দর্শনই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে করে তুলেছে বেসামাল। ২০১৯ সালের ৩০ মে মোদির শাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রথমেই শুরু হয় ‘পাবলিক লিঞ্চিং’। বাস, ট্রেনে বা রাস্তায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধরে নির্যাতনের মাধ্যমে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়। ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘গো মাতা কি জয়’ স্লোগান না দিলে পাবলিক লিঞ্চিংয়ের তীব্রতায় বেদম প্রহার করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ স্টেশনে বিজেপি সমর্থিত হিন্দু সংহতি নামের একটি কট্টর হিন্দু সংগঠনের নেতারা মুসলমান যাত্রীদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেয়ার নির্দেশ দেয়। স্লোগান না দেয়ায় মারধর করে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়া হয়। গত ৭ জুলাইও মধ্যপ্রদেশে গোরক্ষকদের হাতে মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ওই প্রদেশের খান্ডোয়া জেলার সাভালিকেন্ডা গ্রামে ৬ জন মুসলিম যুবককে নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাস্তায় হাঁটু মুুড়ে কান ধরে বসিয়ে রাখা হয়; জোর করে ‘গো মাতা কি জয়’ বলতে বাধ্য করা হয়।
সংখ্যালঘু মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করার তীব্র প্রতিবাদ করে ভারতের প্রথিতযশা অভিনেত্রী শাবানা আজমি ৫ জুলাই শনিবার মধ্যপ্রদেশে এক অনুষ্ঠানে মোদি সরকারের প্রতি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এসব কী হচ্ছে? যখন ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হয়, তখন সে ঘটনাটি প্রভু রামের জন্য অবশ্যই বেদনার ছিল।
বিজেপিকে উদ্দেশ করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান মানুষ প্রহার করার জন্য ভারতে আমদানি করা হয়েছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, মাদরাসা মানেই টেররিস্ট হবে তা বলা যায় না। যারা সমাজবিরোধী, তাদের কোনও ধর্মের সঙ্গে মিলি য়ে দেখা ঠিক নয়।
এর দুই দিন আগে মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষণ রেড্ডি বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মাদরাসাগুলো জঙ্গি কার্যকলাপের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে।’ কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের যুৎসই জবাব দিয়েছেন মমতা। তবে ভারতে বিরোধী দল কংগ্রেসের লেজেগোবরে অবস্থা। তারা ভারতকে বিজেপির ‘রামরাজ্য’ কায়েমের প্রতিবাদে কিছুই করতে পারছেন না। তবে সে দেশের বিবেকবান বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিকরা মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদ করছেন। ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান কেন মুসলমানদের দিতে বাধ্য করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ! আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ নীরব! আফ্রিকায় কোনো জাতি বিপদে পড়লে প্রতিবাদ করেন; ভারতে মুসলিমবিদ্বেষের প্রতিবাদ করেন না। দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ উঠলেই যারা হইহই করে প্রতিবাদী হয়ে উঠে সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেন; তারা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের পর মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন।
ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন নতুন ঘটনা নয়। যুগের পর যুগ ধরে সে দেশে মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতিত চলে আসছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির ফাদার সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) দর্শন হলো ‘সবার উপর গরু সত্য তাহার উপর নেই’। তাদের মুখপত্র ‘স্বস্তিকা’য় বলা হয়েছে ‘ভারতের মুসলমানরা ধর্মের বিধান মেনে যদি গরু জবাই করেন, তাহলে গরু হত্যাকারীকে হত্যা করার অধিকার অন্যদের রয়েছে। আরএসএস, বিজেপি, বিশ্বহিন্দু পরিষদ, শিবসেনা, বজরং দল ঐক্যবদ্ধভাবে সারা ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করে মুসলমান নাগরিকদের হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
ভারতের মুসলিম নেতা তাজুদ্দিন আহমেদ ২০১৯ সালের ২ জুন দেশ পত্রিকায় ‘ঊষা-দিশাহারা নিবিড় তিমির আঁকা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গো-রক্ষকদের তান্ডবে ভারতে কত সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণ গেছে তার ইয়ত্তা নেই। আহার নিদ্রার মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ‘পাবলিক লিঞ্চিং’।
ঈদের বাজার করে ফেরা মুসলিম কিশোরকে বন্ধুদের সামনেই ছুরিকাঘাত করে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্যে নাগরিক পুঞ্জি চলার সমস্যায় বিধ্বস্ত মানুষ। মুসলমানদের দেশ হারানোর শঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন করেছেন ধর্মের ভিত্তিতে। ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে। মুসলিম অনুসঙ্গ ঐতিহাসিক স্থানের নাম বদলে যাচ্ছে।
তাজুদ্দিন আহমেদের এই প্রবন্ধে ভারতের মুসমিল নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গরুর গোশত খাওয়া নিয়ে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ‘ভারতে নারী হয়ে জন্ম না নিয়ে গরু হয়ে জন্ম নেয়া অনেক সম্মানের’। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে(?) বেশ কয়েকজন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া সে দেশে স্বাভাবিক ঘটনা। এমনকি আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) নামে ৪০ লাখ মুসলিম তাড়ানোর ফন্দিফিকির করা হয়েছে।
এখন তেলেঙ্গানাসহ বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যেও মুসলমানদের বিতাড়নের নতুন নীলনকশা হচ্ছে। শুধু কি তাই! ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কারগিল যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াই করা অনারারি লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ সানাউল্লাহকে আসাম পুলিশ গ্রেফতার করেছিল বিদেশী নাগরিক তকমা দিয়ে। তার অপরাধ(!) তিনি মুসলমান।
অথচ ভারতের মুসলিম নাগরিকরা সব সময় দেশপ্রেমী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের মুহম্মদ ফারহাদ মালিকের খুনের কথা মনে আছে? বিজেপির গুন্ডারা ২০১৮ সালে ৩০ মার্চ তাকে হত্যা করে। ফারহান হত্যার পর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মুসলিম লাঠি, বল্লম, সরকি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তখন উগ্র হিন্দুদের হাতে নিহত মুহম্মদ ফারহাদের পিতা আসানসোলের নূরানী মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ শহরের অলিগলি মাইকিং করে শান্তির বার্তা দেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ঠেকিয়ে দেন। সারাবিশ্বের মিডিয়াগুলোয় সে খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়।
প্রতিবেশী ভারতে যখন সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে বিপর্যয়কর অবস্থা তখন বাংলাদেশ নীরব! গেরুয়াধারী বিজেপির ‘এক দেশ এক জাতি এক ধর্ম’ দর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ দেশটির বিরোধী দল কংগ্রেস। নেহরু-গান্ধীর হাতে গড়া কংগ্রেসের এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। বামদলগুলো শক্তিহীন পঙ্গু। তবে সে দেশের বিবেকবান মানুষ বিজেপির এই ‘মুসলিম নির্যাতন’যজ্ঞের প্রতিবাদ করছেন।
অথচ বাংলাদেশ রাজনৈতিক দলগুলো যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ক্ষমতাসীন দল দিল্লি অখুশি হয় এমন কিছু করতে নারাজ। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মেরুদন্ডহীন কার্যত ক্ষমতাসীনদের ‘পাপেট’। জাতীয়তাবাদী ধারার বিএনপির নীরবতার রহস্য কী? জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব কী আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে দিল্লির কাছে আদর্শ বিষর্জন দিয়েছেন?
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেখা গেল ঐক্যজোট, ঐক্যফ্রন্ট, মহাজোট, মহাফ্রন্ট, বাম জোট, ইসলামী ফ্রন্ট, মোর্চা, ৮ দলীয় জোট, ১৫ দলীয় ফ্রন্ট, ৫০ দলীয় জোট, ৬০ দলীয় ঐক্য; কত নামে রাজনৈতিক জোট-ঐক্য! প্রায় দেড় শতাধিক রাজনৈতিক দল গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করেছে। মানবতার রাজনীতি করার দাবিদার দলগুলোর কেউই প্রতিবেশি দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ করছেন না। আর বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ, পেশাজীবী, শিক্ষাজীবীরা যেন বিজেপির কাছে ‘বিবেক বন্ধক’ রেখেছেন।
বিগত শতকের ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও দেখা গেছে মানুষের অধিকার রক্ষায় যুদ্ধবাজ আমেরিকার বিরুদ্ধে কেঁপে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ, মধ্যপ্রাচ্যে বুশের হিংস্রতায় চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে লাখ লাখ মানুষ। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে পথে পথে ‘মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য’ গান গেয়ে অর্থ তুলে হাজার হাজার মাইল দূরের বিপন্ন মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা। এখন তারা পাল্টে গেছেন।
প্রতিবেশী ভারতে মুসলিমদের ওপর চলছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। আসামে নাগরিকদের তালিকা তৈরির নামে ৪০ লাখ মুসলমানকে দেশছাড়া করার চেষ্টা চলছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবীরা এখনো উটপাখির মতো বালুতে মুখ লুকিয়ে রেখেছেন। ডান-বাম, মধ্যপন্থী শতাধিক রাজনৈতিক দল, হাজার হাজার সামাজিক সাংস্কৃতির সংগঠন, কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী সবাই নীরব!
বিশ্বের শেষ প্রাপ্তে কোনো ধর্মের মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, জুলুম-নির্যাতন হলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মানুষ। যুগের পর যুগ ধরে সে চিত্র দেখে আসছি। কিন্তু বন্ধুপ্রতিম ভারতে মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন দেখেও নীরব দর্শক হয়ে রয়েছি। তাহলে কি ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি আমাদের দায়দায়িত্ব নেই?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।