Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

মাছের পেটে ও খাদ্য লবণে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব

বঙ্গোপসাগরে বাড়ছে প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ

বিশেষ সংবাদদাতা, কক্সবাজার | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০১৯, ৫:৩৮ পিএম

প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে আমাদের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন তথ্যই জানিয়েছেন, আমাদের মৎস্য ও কৃষি বিজ্ঞানিরা।

এক গবেষণা রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে বছরে ২০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ছে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল - ভূটান থেকেও এসব প্লাস্টিক বর্জ্য এসে পড়ছে আমাদের বঙ্গোপসাগরে। ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অনুজীবের পেটে ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এমনকি পরিশোধিত-অপরিশোধিত উভয় প্রকার লবণেই ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে বলে জানান তারা।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের এক যৌথ গবেষণায় সম্প্রতি এই ঘটনা ধরা পড়ে। প্লাস্টিকের কনার উপস্থিতির কারণে মানব শরীরে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য নানা
ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।বঙ্গোপসাগরে এই প্লাস্টিক দূষণের ঘটনাকে ভবিষ্যত জনস্বাস্থের জন্য একটি ভয়াবহ ও মারাত্মক হুমকী হিসাবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীরা জানান, মাইক্রো প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক কনা আকারে খুবই ছোট বলে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণি এগুলোকে নিজেদের খাবার ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলে। আর প্লাস্টিক খাওয়া সেই মাছ আমরা ভক্ষণ করি। মানে পরোক্ষভাবে আমরাও প্লাস্টিক ভক্ষণ করি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. হারুণুর রশীদ বলেন, প্লাস্টিক কনা বর্জ্যের কারণে আমাদের বঙ্গোপসাগরে পরিবেশ দূষণের মাত্রা নির্ণয় করতে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে যৌথভাবে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় এ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আতকে ওঠার মতো, অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমরা যেখানেই প্লাস্টিকের দূষণ করিনা কেন, তা সাগরে গিয়ে পৌঁছায়। আর এসব প্লাস্টিকের মধ্যে বড় আকারের যেমন আছে, তেমনি আছে ৫ মাইক্রোমিটার বা তারও চেয়ে ক্ষুদ্র। আবার বড় প্লাস্টিকও সমুদ্রে গিয়ে ক্ষুদ্র আকারে ভেঙ্গে যায়।

সাগরে কিছু প্লাস্টিক ভাসমান আর কিছু প্লাস্টিক তলদেশে থাকে। এ উভয় প্রকার প্লাস্টিকই আমাদের সমুদ্রের প্রাণিকূলের জন্য ক্ষতিকর।
ড. হারুনুর রশীদ বলেন, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের পর তা পানির তোড়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙ্গে। ভাঙ্গা অংশগুলো পুনরায় সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে পুনরায় ভেঙ্গে ন্যানো, মাইক্রো ও ম্যাক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়।
তিনি বলেন, এই ভাঙ্গনের ফলে সৃষ্ট প্লাস্টিকের কিছু উপাদান (ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, যেমন- বিসফিনল-এ নির্গত হয়) মানুষের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর । প্লাস্টিক-দূষিত মাছ খাওয়ার ফলে আমরা বিসফিনল-এ দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। মাছ ছাড়াও সমুদ্রের অমেরুদন্ডী প্রাণিও মাইক্রোপ্লাটিক ‘ফিল্টার করে’ গ্রহণ করে বলে জানান তিনি।
এছাড়া সমুদ্রের ক্ষুদ্র প্রাণিকণা বা জু-প্লাঙ্কটন এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ভক্ষণ করে। আবার এসব ক্ষুদ্র প্রাণিকণা বিভিন্ন মাছের খাদ্য বলে মাছ এদেরকে ভক্ষণ করে। আর আমরা সেই মাছ খেতে গিয়ে আমরাও মাইক্রোপ্লাস্টিক খাই।
বিজ্ঞানী হারুন জানান, মাছের পেটে ছোট-বড় প্লাস্টিক পাওয়া থেকে বুঝা যায়, কিছু কিছু মাছ সরাসরি প্লাস্টিক ভক্ষণ করে থাকে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী বলেন, কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের -এর অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণায় বাঁকখালী নদীর মোহনা ও সোনদিয়ার পাশে সমুদ্রের উপরিভাগের পানি থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক সেম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে, লাবনী পয়েন্ট সৈকতের ও কাঁকড়া বীচের বালিতে প্লাস্টিকের দূষণ নির্ণয় করা হয়েছে এবং অপরিশোধিত ও পরিশোধিত (বাণিজ্যিক) লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পরীক্ষা করা হয়েছে।

গবেষক দলে ছিলেন- ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর, কক্সবাজারের সন্তান ড. হারুনুর রশীদ, একই বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. কাইজার আহমদ সুমন এবং কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহনুর জাহেদুল হাসান।

চলমান গবেষণার এই পর্যন্ত গবেষণালব্দ ফলাফল সম্পর্কে গবেষক দলের প্রধান ড. হারুনুর রশীদ বলেন, বাঁকখালী নদীর মোহনার পানির উপরিভাগে ভাসমান অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২০ হাজারেরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া মহেশখালী, টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে সংগৃহীত অপরিশোধিত লবণে কেজিতে প্রায় ১০০০টি এবং দেশের নাম করা বাণিজ্যিক কোম্পানীর পরিশোধিত লবণে প্রতি কেজিতে পাওয়া গেছে ৭০০ থেকে ৯০০ টি মাইক্রোপ্লাস্টিক।

তিনি জানান, কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্ট সমুদ্র সৈকত ও উখিয়া-রামুর সংযোগস্থল কাঁকড়া বীচেও প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে। যেখানে দেখাগেছে, কাঁকড়া বীচে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা কক্সবাজার শহরের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। মূলত কাঁকড়া বীচটি রেজু নদীর মোহনায় হওয়ায় এ নদীর দীর্ঘ পথ দিয়ে নেমে আসা বিশাল এলাকার প্লাস্টিক বর্জ্য এখানে এসেই বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হচ্ছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু আমাদের বঙ্গোপসাগরের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর নদ-নদী ও সমুদ্রগুলোর দূষণের জন্য প্রধান দায়ী। পৃথিবীর নদীগুলো থেকে সমুদ্রে প্রতিবছর ১২ থেকে ২৪ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বলে জানান বিজ্ঞানীরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দূষণ

২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
৪ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ