Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১১ জুন ২০২৪, ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভারতে পানি সঙ্কট

পাঁচ বছরে সমাধান না হলে কোটি কোটি মানুষের বিপদ

সিএনএন | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারতে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সারা ভারতে ১০ কোটি লোক ভয়াবহ পানি সঙ্কটের সম্মুখীন। সরকার পরিচালিত থিংকট্যাংক এনআইটিআই আয়োগের ২০১৮ সালের রিপোর্টে বলা হয়, আগামী বছর মোট ২১টি প্রধান শহর ভূগর্ভস্থ পানিশূন্য হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি সঙ্কট সমাধানের জন্য ভারতের হাতে মাত্র পাঁচ বছর সময় আছে। তা করা না হলে কোটি কোটি মানুষের জীবন সঙ্কট দেখা দেবে।
এবারের গ্রীষ্মে ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাপদাহের কারণে কমপক্ষে ১৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে অত্যন্ত প্রয়োজনী মৌসুুমি বৃষ্টি কয়েক সপ্তাহ দেরি করে সবে কিছু কিছু স্থানে দেখা দিতে শুরু করেছে। ভারতে মোট পানির ৪০ শতাংশ সরবরাহের উৎস হচ্ছে ভূগর্ভস্থ থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে একটানা ভ‚গর্ভস্থ পানি কমে আসছে। শুধু ভূগর্ভস্থ পানিই নয়, পানির অন্যান্য উৎসও শুকিয়ে যাচ্ছে। দেশের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন গত বছরের জুনে বলেছিল, ভারতের দুই তৃতীয়াংশ জলাধারের পানি স্বাভাবিক উচ্চতার নিচে নেমে গেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য সম্প্রতি জলশক্তি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতিটি গ্রামীণ বাড়িতে পানি দেয়ার তার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তবে অনেকেরই আশঙ্কা যে অঙ্গীকারই যথেষ্ট নয়। একটি মানবাধিকার রিপোর্ট মতে, বিশ্ব দ্রুত ‘জলবায়ু বৈষম্যে’র দিকে এগোচ্ছে যেখানে মারাত্মক খরা, দুর্ভিক্ষ ও তাপদাহের মুখে শুধুমাত্র ধনীরাই মৌলিক সম্পদ সমূহ পেতে পারবে।
ভারতের কোনো কোনো স্থানে ইতোমধ্যেই বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ভারতের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর চেন্নাইতে পানির উৎস চারটি জলাধার প্রায় শুকিয়ে গেছে। লাখ লাখ অধিবাসী তাদের পানির পাত্র ভরে আনতে সরকারি পানির ট্যাংকারগুলোতে গিয়ে লাইন ধরে দাঁড়াচ্ছে। ভীষণ সমস্যায় পড়েছে হাসপাতাল ও স্কুলগুলো। লোকজন রান্নার জন্য পরিষ্কার পানি বাঁচাতে নোংরা পানিতে জিনিসপত্র ধুতে বাধ্য হচ্ছে।

ভারতে পানির সঙ্কট বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে এটি ভবিষ্যতের এক টুকরো ছবি হতে পারে। এনআইটিআই আয়োগ রিপোর্ট অনুযায়ী দেশব্যাপী ছয় কোটি লোক ভয়াবহ পানি সঙ্কটের শিকার হয়েছে। প্রতি বছর দুই লাখ অপর্যাপ্ত বা অনিরাপদ পানি সরবরাহের কারণে মারা যায়। পানি সঙ্কটের কারণে ভারতকে অতিরিক্ত কিছু সমস্যার মোকাবেলা করতে হতে পারে। যেমন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, তাপদাহের সময়ের দুর্বলতা, খারাপ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জনিত অসুস্থতা এবং পানির প্রবেশাধিকার নিয়ে আঞ্চলিক যুদ্ধ।

প্রধান নগরগুলো পানি সঙ্কটে : ভারতের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য পানি সরবরাহ অপ্রতুল। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ভারত এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে তার নগরগুলোতে জনসংখ্যা ৪১ কোটি ৬০ লাখ বৃদ্ধি পাবে। কম অবকাঠামো পরিকল্পনার সাথে বছরের পর বছর দ্রুত নগরায়ণের অর্থ অধিকাংশ প্রধান শহরেরই অতিরিক্ত জনসংখ্যা সামাল দেয়ার সামর্থ্য নেই। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়, ২০৩০ সাল নাগাদ পানির বর্তমান চাহিদা দ্বিগুণ বাড়বে। ফলে কোটি কোটি মানুষ বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন হবে।

ভারতের পানি সম্পদ ইনস্টিটিউশনের নগর পানি কর্মসূচির পরিচলক সম্রাট বসাক বলেন, ১৯৯০ সালের পর থেকে ভারতে শহরগুলো খুব দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু তারা বাড়ছে এ কথা বিবেচনা না করেই যে সম্পদ কোথা থেকে আসছে। শহরের লেক ও খাঁড়িগুলো শহরের ক্রমবিস্তৃতি ও পরিবেশ অবনমনের শিকার হয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে। তার অর্থ শহরগুলোতে ব্যবহারযোগ্য পানি মজুদ রাখার জায়গা নেই। তাদের পানি সংরক্ষণের অবকাঠামো, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ব্যবস্থা, পানি পুনর্ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা এবং বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনাও সীমিত। ট্যাংকার মাফিয়াদের উদ্ভব ঘটেছে যারা নির্ধারণ করছে কারা পানি পাবে ও কি মূল্যে পাবে।

চেন্নাইয়ের পাশে কিলপকে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন তাদের তিনটি ২৪ হাজার লিটার ট্যাংকের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার রুপি (২১৬ ডলার) ব্যয় করে। স্বল্প আয়ের লোকেদের এ সুবিধা নেই। অলাভজনক সংস্থা ওয়াটারএইড ইন্ডিয়ার সিইও ভি কে মাধবন বলেন, এটা যারা অর্থ দিতে পারে সে রকম মানুষদের জন্যই ব্যবস্থা। পানি সংরক্ষণে কাজ করা ভারতীয় এনজিও ফোর্স-এর সভাপতি জ্যোতি শর্মা বলেন, নগর জনসংখ্যার কমপক্ষে ৬০ শতাংশই সরকার নির্ধারিত আবাসিক এলকার বাইরে অননুমোদিত বসতিগুলোতে বাস করে।

বেসরকারি পানির ট্যাংকার বা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার বিহীন এসব স্বল্প আয়ের পরিবাররা তাদের মৌলিক চাহিদা মিটাতে সম্পূর্ণরূপে ভ‚গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। এ ধরনের সঙ্কটে তারাই সবচেয়ে মারত্মক সমস্যার সম্মুখীন। জাতিসংঘ মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন দরিদ্র লোকদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। এতে বলা হয়, আমরা জলবায়ু বৈষম্যের ঝুঁকির মুখে। এ সময় ধনীরা তাপদাহ, ক্ষুধা ও বিরোধ থেকে মুক্ত থাকতে অর্থ ব্যয় করছে। পক্ষান্তরে বাকিরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

ভারতে পানির ভবিষ্যত : ভারতের নগরগুলো দ্রুত পানি সঙ্কটের দিকে ধেয়ে চলেছে। কিন্তু তারা কি সেই ভয়াবহ দিনে পৌঁছবে যখন ট্যাপগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়বে? সম্ভবত না, বলেন মাধবন। সরকারের জলশক্তি মন্ত্রণালয় আশার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে আমরা শুধু আশার উপর নির্ভর করে বাঁচতে পারি না। তবে ভারত যদি পানিশূন্য অবস্থায় নাও পৌঁছে তাহলেও সারা ভারতে লাখ লাখ মানুষের জীবন মানের অবনতি ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাতে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে।

মোদি তার নির্বাচনী অঙ্গীকারে যে ব্যাপক উচ্চাশা প্রদর্শন করেছেন, পরিস্থিতি হবে তার একেবারে বিপরীত। নাগরিকরা যদি জীবন রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তখন ভারতের উন্নয়ন ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। মাধবন বলেন, যখন পরিষ্কার খাবার পানি থাকবে না তখন অনিরাপদ পানির উপর নির্ভর করা ছাড়া মানুষের উপায় থাকবে না। তখন অসুখ ও অসুস্থতার লাগামহীন বিস্তার ঘটবে। অনেক বেশি মৃত্যু ও উচ্চহারে শিশু মৃত্যু ঘটবে।

মাধবন আরো বলেন, গ্রামীণ এলাকাগুলোতে স্কুল থেকে অধিক সংখ্যক মেয়ে শিশু ঝরে যাবে। কোনো পরিবারের মেয়ে ঐতিহ্যগতভাবে পানি সংগ্রহ করে আনে। এখন পানির উৎস দূরবর্তী হয়ে পড়লে পরিবারকে সাহায্যের জন্য তাকে আরো দূর এলাকায় হেঁটে যেতে হবে যাতে অনেক বেশি সময় লাগবে।

সে সাথে পানি সঙ্কট যত বেশি হবে তত ইতোমধ্যে জনসংখ্যা বেশি হয়ে পড়া এবং কম সম্পদ সম্পন্ন নগরগুলো থেকে মানুষজন অন্যত্র চলে যাবে। অধিক সংখ্যক মানুষ কম সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে সম্পদ বিভাজন গভীরতর হবে এবং খাদ্য ও পানির মূল্য বাড়বে। জাতিসংঘ মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, হতাশার সম্মুখীন হয়ে নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনও বিপদের সম্মুখীন। রিপোর্টে হুঁশিয়ার করা হয় যে আসন্ন বিপর্যয়ের মধ্যে মানবাধিকারের অস্তিত্ব থাকবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি সঙ্কট সমাধানের জন্য ভারতের হাতে মাত্র পাঁচ বছর সময় আছে। তা না করা হলে কোটি কোটি মুনষের জীবনে সঙ্কট দেখা দেবে। তারা যদি পরিহার অযোগ্য সঙ্কটের ক্ষতি সীমিত করতে চায় তাহলে এখনি কাজ করতে হবে। বসাক বলেন, এটা এই নয় যে আমরা ভবিষ্যতে পানি চ্যলেঞ্জের জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা ইতোমধ্যেই সে চ্যালেঞ্জের শিকার হয়েছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ