Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনৈতিক অরাজনৈতিক বখাটে সহ ছিচকে মাস্তানদের তৎপরতায় দক্ষিণাঞ্চলের সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা জিম্মি

সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করছে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৯, ৫:৩৬ পিএম | আপডেট : ৬:৩৮ পিএম, ২৯ জুন, ২০১৯

দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বখাটেরাজ কায়েম সহ আইন শৃঙ্খলার বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতার সর্বশেষ নজির বরগুনা শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত হত্যাকাণ্ড। এ অভিমত বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ ছাড়া আমজনতারও। গত কয়েকটি বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ছিচকে মাস্তান, উঠতি মাস্তান সহ বখাটেদের দৌরত্বের কাছে সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়লেও তা থেকে উত্তরণের কোন উদ্যোগ নেই। এমনকি অনেক এলাকাতেই এসব বখাটে ও ছিচকে মাস্তানরাই সমাজ সহ আমজনতার ভাগ্য নিয়ন্তা বলেও অভিযোগ রয়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ে এসব বখাটেদের নানামুখী অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজকে কলুষিত করার পাশাপাশি সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করলেও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় অসহায় সাধারণ মানুষ। বরিশাল মহানগরী সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ইভটিজিং ইতোমধ্যে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেও কোন প্রতিকার নেই। মাদক ব্যবসাও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। 

গত ২৬জুন বরগুনা শহরে কলেজ থেকে বাড়ী ফেরার সময় প্রকাশ্য দিবলোকে স্ত্রী সহ কয়েক’শ লোকের সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে রিফাতকে জখম করার পরে ঘাতকের দল সদর্পে এলাকা ত্যাগ করে। ঘটনাস্থল থেকে বরগুনা সদর থানার দূরত্ব দশ মিনিটের বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। ঘাতকরা রিফাতকে কুপিয়ে জখম করে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে যাবার পরে এলাকাবাসী ও তার স্ত্রী হাসপাতালে নেয়ার পরেই সেখানে পুলিশ পৌঁছে। তবে বরগুনার এসপি দাবী করেছেন, ‘পুলিশই রিফাতকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়’। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, ‘গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণাঞ্চলের কোন শহরে বিরোধী রাজনৈতিক দল সভা সমাবেশ বা মিছিল বের করতে পারেনি। অতি দ্রুত ও কঠোর তৎপরতার সাথে পুলিশ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার কৃতিত্ব অর্জন করলেও পূর্ব পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে নারকীয় হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা নিরাপদে চলে গেলেও সেই পুলিশের তৎপরতা চোখে পড়েনি’।
প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েক’শ মানুষের সামনে ১২-১৪টি বখাটে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করলেও কেউ এগিয়ে না আসার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাক্তি জানিয়েছেন, ‘হামলাকারী নয়ন বন্ড সহ তার সহযোগীদের ‘গড ফাদার’ বরগুনা শহরে এতটাই প্রভাবশালী যে কেউ ঐসব খুনিদের কাছ থেকে রিফাতকে উদ্ধারে এগিয়ে যাবার সাহস করেনি’।

রিফাতের হত্যাকাণ্ডের পরে দেশ জুড়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। দেশের উচ্চ আদালত থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এপর্যন্ত এজাহারভূক্ত এক আসামী সহ সন্দেহভাজন চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ৩জনকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি বরগুনায় ছুটে গিয়ে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে সরেজমিনে খোজ খবর নিয়েছেন। এমনকি এক ঘাতকের সাথে চেহারায় মিল থাকায় সন্দেহজনকভাবে বরিশাল নৌ টার্মিনাল থেকে তিন কিশোরকে আটক করলেও পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
রিফাতের এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড দক্ষিণাঞ্চলে সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের স্বরূপ কিছুটা হলেও প্রকাশ্যে এনেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। কিন্তু এতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বর্তমান অবস্থান কতদিন অব্যাহত রাখবেন সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
গত কয়েক বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে এক শ্রেণীর বখাটে সহ ছিচকে মাস্তানের যে অভ্যুদয় ঘটেছে, তা নিয়ন্ত্রনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা নিয়েও বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রশ্ন উঠেছে। আর এত দিনের উদাসীনতায় এসব মাস্তান ও বখাটেরা ক্রমশ নিয়ন্ত্রনের বাইরেই চলে গেছে। সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে এসব মাস্তানরা বৈধ অবৈধ মোটার বাইক নিয়ে দিন রাত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে ট্রাফিক আইনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

এমনকি নিকট অতীতে যে বৃহত্তর বরিশাল শিক্ষা ক্ষেত্রে সারা দেশের শীর্ষে অবস্থান করত, ইতোমধ্যে তা ক্রমাবনতির দিকে। গত কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল নিয়েও হতাশা রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ বোর্ডের পাশের হার সারা দেশের মধ্যে নিচের দিকে। কৃতকার্য ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে জিপিএ-৫’এর হার ৩%’এর বেশী নয়। বছরের পর বছর ধরে ছাত্ররা ছাত্রীদের চেয়ে পিছিয়ে পরছে। আর যে বরগুনা এখন সর্বাধিক আলোচিত, সেখানে পাশের হার শিক্ষা বোর্ডের ৬টি জেলার মধ্যে নিচের দিকে। এমনকি গত দশ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে কোন কোন বছর বরগুনা জেলায় পাশের হার সারা দেশের মধ্যে ১০%-এরও কম দেখা গেছে।

তবে শুধু বরগুনাই নয়, বরিশাল মহানগরী সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়েই সামাজিক অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। মাদক, ইভটিজিং সহ সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার বিরোধী কর্মকাণ্ড ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করছে। বরিশাল মহানগরীর বিভিন্ন পার্ক ও মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে দিনরাত স্কুল ও কলেজগামী ছাত্র ছাত্রীরা আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে। বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি শহরের পার্কগুলোতে অনেক রাত পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। খোদ বরিশাল মহানগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ও স্বাধীনতা পার্ক সহ বিভিন্ন পার্কে অনেক রাত পর্যন্ত যেভাবে স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীদের আড্ডা চলে, তাতে ঐসব স্থানে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ বিলুপ্ত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু উদ্যানের ছাতার নিচে অনেক রাত পর্যন্ত কারা কিভাবে অবস্থান করে তা নিয়ে একাধিকবার পুলিশ প্রশাসনের সভায় প্রশ্ন উঠলেও প্রতিকার হয়নি। ফলে ঐ উদ্যানের ওয়াক ওয়েতে হাটার পরিবেশ ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বরগুনায় নৃশংসভাবে রিফাত হত্যাকাণ্ড গোটা দেশকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে, তার পেছনের সবগুলো কারণ খতিয়ে দেখে অবিলম্বে প্রতিকারে তৎপর হলে পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। এ বিষয়ে জোড় তাগিদ রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের আম জনতারও।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দক্ষিণাঞ্চল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ