পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ বাহন হিসেবে রেলকে বিবেচনা করা হয়। ঝুঁকিমুক্ত এবং আরামদায়ক পরিবহন হওয়ায় সারাবিশ্বেই একে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। রেলের উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নসহ গতি বৃদ্ধির নিত্য-নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করা হচ্ছে। এর ঠিক বিপরীতচিত্র দেখা যায় আমাদের দেশে। নিরাপদ যাতায়াত এবং পণ্যপরিবহনের এই মাধ্যমটি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। এর উন্নয়নে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও তার ছিঁটেফোটা দেখা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হিসেবে রেলের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দুর্নীতি এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি চিহ্নিত হয়ে থাকলেও তা কোনোভাবেই দূর করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট রুটে কুলউড়ায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর রেলের ঝুঁকিপূর্ণ চলাচলের বিষয়টি বের হয়ে এসেছে। দৈনিক ইনকিলাব ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেলপথ ও সেতু দিয়েই চলছে ট্রেন। নামমাত্র সংস্কারের মাধ্যমে রেল যোগাযোগ চালু রাখা হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে রেলপথের সেতুগুলো। রেলওয়ের তথ্যমতে, ২ হাজার ৯২৯ কিলোমিটার রেলপথে ছোট-বড় মিলিয়ে সেতু রয়েছে ৩ হাজার ১৪৩টি। এসব সেতুর ৯০ শতাংশের আয়ুষ্কাল প্রায় ১০০ বছর হওয়ায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ এসব সেতুর উপর দিয়েই চলছে ট্রেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিরাপদ বাহন হিসেবে পরিচিত রেল কতটা ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্য দিয়ে চলছে। ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ এবং সেতু যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে নিরাপদ না করার কারণে যে কোনো সময় আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
রেলের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আমরা অনেক বড় বড় কথা শুনছি। অথচ যে পথ দিয়ে ট্রেন চলাচল করে সেই পথই নিরাপদ করা হচ্ছে না। পর্যাপ্ত নতুন রেলপথ ও সেতু নির্মাণ ও সংস্কার করা দূরে থাক, বিদ্যমানগুলোই সংস্কার করা হচ্ছে না। ২০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা রেলের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক টাকা ব্যয় করা হয়েছে ইঞ্জিন, কোচ ক্রয় ও ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ বাবদ। বাকি অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় করা হয়েছে বা হচ্ছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, রেলপথে যেসব সেতু রয়েছে সেগুলো সংস্কার বা নতুন সেতু নির্মাণে কোনো বিশেষ প্রকল্প নেয়া হয়নি। ফলে সেতুগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ই রয়েছে। রেলচালকরা এই ঝুঁকির কথা ভালভাবেই অবগত। সেতুর উপর দিয়ে যেখানে ট্রেন ঘন্টায় ৪৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে চলার কথা সেখানে তাদেরকে সেতু পারের সময় চালাতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার গতিতে। সেতু যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তবে তাতে ট্রেনের উঠারই কথা নয়। স্বাভাবিক বা কম গতিতে চালানো তো অনেক পরের কথা। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের রেল ব্যবস্থা কতটা জরাজীর্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও তার ছোঁয়া রেলে দেখা যায় না। সরকার রেলের উন্নয়নে বরাদ্দ দিলেও তা একশ্রেণীর রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারির দুর্নীতি ও উদাসীনতার কারণে এতে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে আমরা রেলের নতুন নতুন কোচ ও ইঞ্জিন কেনার কথা শুনি। প্রশ্ন হচ্ছে, যে পথে ট্রেন চলবে, সেই পথই যদি চলাচল উপযোগী না হয়, তবে এগুলো কিনে কী হবে? কোন পথে এগুলো চালানো হবে? দেখা যাচ্ছে, রেলের নিরাপদ পথ ঠিক না করেই এসব কোচ, ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রচলিত কথা রয়েছে, যত বেশি কেনাকাটা, তত বেশি কমিশন, দুর্নীতি এবং অর্থ লুটপাটের সুযোগ। এ কথাটি রেলওয়ের ক্ষেত্রে যেন বাস্তব হয়ে ওঠেছে। রেলের একটি শ্রেণী নতুন কোচ, ইঞ্জিন কিনে দেখাতে চাচ্ছে, এর শনৈশনৈ উন্নতি হচ্ছে। কী উন্নতি হচ্ছে, কীভাবে উন্নতি হচ্ছে, তা রেলের ঝুঁকিপূর্ণ পথ এবং ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। নিরাপদ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশসহ উন্নত দেশগুলো এখন রেলের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। এর উন্নয়নে নিত্য-নতুন ব্যবস্থা যুক্ত করছে। শব্দের গতির সমান দ্রæত গতির বুলেট ট্রেন ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। আমাদের দেশেও দ্রæতগতির ট্রেন যুক্ত হওয়ার কথা আমরা অনেকবার শুনেছি। স্বল্প সময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে চলে যাওয়া যাবে এমন ট্রেন চালু করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, রেলের যে দৈন্যদশার চিত্র বের হয়ে আসছে, তাতে এসব যে এখন কথার কথা, তা বুঝতে বাকি থাকে না।
আমরা কথায় কথায় নিজেদের উন্নয়নশীল দেশ বলছি। অথচ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ এবং সশ্রয়ী রেল ব্যবস্থার কোনো উন্নতি করতে পারছি না। এটা দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছ নয়। সরকার সড়ক পথকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন করছে, রেল খাতটির উন্নয়নে সেভাবে মনোযোগ দিচ্ছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে না। তবে সরকার এ খাতের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও তার ছোঁয়া এ খাতে না লেগে একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজের ঠিকই উন্নতি হচ্ছে। সরকারের এই উন্নয়ন কাজ যদি সংশ্লিষ্ট খাতে দায়িত্বশীলরা বাস্তবায়ন না করে, তবে কোনো দিনই উন্নতি হবে না। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে সেই ভূত তাড়ানো যায় না। রেলের উপর যেন এমন ভূত যুগের পর যুগ চেপে বসে আছে। এ ভূত তাড়াতে সরকারের কঠোর অবস্থান নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অর্থ বরাদ্দ হবে, সে অর্থের সদ্ব্যবহার হবে না, তা চলতে দেয়া যায় না। রেলকে আধুনিক এবং যুযোপযুগী করে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যারা প্রতিবন্ধক হয়ে আছে, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রেলকে দুর্নীতিমুক্ত করতে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।