পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইদানীং লেখার আর কোনো টপিক পাওয়া যায় না। সেই পবিত্র রমজান মাসের আগে থেকেই টপিকের খরা চলছে। রমজান গেলো। ঈদ এলো। ঈদের ছুটিটাও ছিল খুব লম্বা। সেই লম্বা ছুটিও শেষ হলো। ঢাকা এখন পুরোনো রূপ ফিরে পেয়েছে। কিন্তু প্রায় আড়াই মাস হলো দেশে রাজনীতির কোনো ছোঁয়া নাই। এর মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যে এবছরের শেষের দিকে বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন হবে। কাউন্সিল অধিবেশনে স্বাভাবিকভাবেই নতুন কমিটি হবে। সেই কমিটি গঠনের আগে তো আর বিএনপি মাঠে নামবে না। এমনি করে এবছর চলে যাবে। ইতোমধ্যেই এই বছরের অর্ধেক চলে গেছে। বাকি অর্ধেকটাও তেমনি কেটে যাবে। কিন্তু বিএনপির ঘর গোছানোর কাজ আর শেষ হবে না। আর খালেদা জিয়াও ততদিন জেলে পচবেন।
এখন পেছনে ফিরে দেখছি যে, এই ঘর গোছানোর কথা বিএনপি বলছে বিগত ৪/৫ বছর হলো। কিন্তু সেই ঘর গোছানোর কাজ আর শেষ হয় না। বিএনপি অতীতে বহুবার বলেছে যে, ঈদের পরেই আন্দোলন শুরু হবে। প্রতিপক্ষ হিসেব করে দেখিয়েছেন, ইতোমধ্যেই বছরে দুটি করে ঈদ ধরলে ৮টি ঈদ চলে গেছে। তারপরেও বিএনপির রাস্তায় নামা হয়নি। কিন্তু তাই বলে কি বিএনপির মল্লযুদ্ধ থেমে গেছে? তাদের যুব এবং ছাত্রফ্রন্টের পেশি সঞ্চালন কি থেমে গেছে? কথায় বলে, ‘ভাই মরদ ভাবির কাছে’। বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল- আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না। তাদের যত মরদানি সব নিজেদের বিরুদ্ধে। ছাত্রদলের এক গ্রুপ ভালো ভালো পদ পায়নি তাই তারা বিএনপি অফিসে তালা লাগিয়ে দেয়। তার আগে অতীতে আমরা যুবদলের বেলাতেও এই খেলা দেখেছি। কয়েকদিন আগে দেখলাম ছাত্র দলের বীর পুঙ্গবরা বিএনপি অফিসে তালা দিয়েছে এবং তাদের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। জনাব রিজভী তখন অসুস্থ হয়ে স্যালাইন নিচ্ছিলেন।
আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গ সংগঠনের ব্যাপারে ছাত্রদল ও যুবদলের এই বাহাদুরি দেখা যায়নি। এক সময় বিএনপি দাবি করতো যে ছাত্রদল নাকি দেশের সবচেয়ে বড় দল। আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য ছাত্রদলই যথেষ্ট। অথচ এবারে ডাকসু নির্বাচনে দেখা গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজার ছাত্রের মধ্যে ছাত্রদল পেয়েছে মাত্র ৬শত ভোট।
এই হলো ছাত্রদলের বর্তমান অবস্থা। অথচ আওয়ামী লীগ অতীত এবং বর্তমান উভয় সময়েই রাজপথ দখলে রেখেছিলো। বলা হয় যে, পুলিশি জুলুমের কারণে বিএনপি বা ছাত্রদল রাজপথে নামতে পারে না। কিন্তু অতীতে আমরা দেখেছি, যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিলো তখনও আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলো। আবার ছাত্রলীগ যখন ক্ষমতার বাইরে তখনও আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রেখেছে। অর্থাৎ কি ক্ষমতায়, বা কি বিরোধী দলে, আওয়ামী লীগ সব সময় রাজপথ দখলে নিয়েছে। বিএনপি কোনো সময় রাজপথ দখলে নিতে পারেনা কেন?
এর একটি কারণ সম্ভবত এই যে বিএনপি আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো নির্বাচন মুখী একটি ভদ্রলোকের পার্টি। ঐসব দেশে যেমন সরকার বা বিরোধী দল তাদের বক্তব্য সব সময় প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেয় তখন তাদের বক্তব্য অনুযায়ী জনমত গড়ে ওঠে। কেউ তাদের বক্তব্য পছন্দ করে না, কেউ করে। এভাবেই সেখানে জনমত সৃষ্টি হয়। আর সেই জনমতের প্রতিফলন ঘটে তাদের জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে বা পার্লামেন্ট নির্বাচনে।
দুই
আমি ঈদের আগে থেকেই অসুস্থ। বিছানায় শয্যশায়ী। তবুও ঐ যে কথায় বলে, ঢেকি স্বর্গে গেলেও বারা বানে, আমার হয়েছে সেই অবস্থা। সুস্থ থাকি আর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি, আমি প্রতিদিন কারো না কারো সাহায্যে পত্র পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন, অন লাইন নিউজ পোর্টাল এগুলো পড়ি বা কেউ আমাকে পড়িয়ে শোনায়। রোজার আগে থেকে আমি অসুস্থ। এই সময়টায় আমি পেছনে ফিরে তাকাই এবং নিরাসক্ত মনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অতীত পর্যালোচনা করি। এই পর্যালোচনায় আমার কাছে একটি জিনিস অকস্মাৎ ফ্ল্যাশ অফ লাইটের মতো জ¦লে ওঠে যে এক মাত্র এরশাদের বিরুদ্ধে ছাড়া বিএনপি কোনো দিন রাজপথে নামে নি। আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় গেছে তার কোনো সময়েই বিএনপি রাজপথে আওয়ামী লীগের মোকাবেলা করেনি। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে বিএনপি প্রথম আওয়ামী লীগ আমলে রাজপথে নেমেছিলো। কিন্তু রাজপথে নেমে আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় সমাবেশ করা, বড় মিছিল করা এককথা আর বিকল্প রাস্তায় ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা আরেক কথা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা হলেন ড. আব্দুল মঈন খান। তাকে দেখি প্রতিটি ঈদ হলেই তার বাড়িতে বিদেশী কূটনীতিকদের নিয়ে জমকালো পার্টি থ্রো করেন। এগুলো করে তিনি যে কি মজা পান আর কি লাভ হয় সেটি আমাদের ছোট মাথায় আসে না। কিন্তু তিনি প্রতিটি ঈদে এমন পার্টি থ্রো করেই যাচ্ছেন। এই খরচ কি উনি ব্যক্তিগত ভাবে বহন করেন? নাকি তার পার্টি বহন করে সেটি আমরা জানি না। যিনিই বহন করুক না কেন, পার্টি দেয় বিএনপি আর আখেরে লাভ হয় আওয়ামী লীগের। এসব কথা আমরা অতীতে অনেক বার বলেছি। বিএনপি কি জনতার ওপর নির্ভর করে, জনতার সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়? নাকি বিদেশী কূটনীতিকদেরকে খোশামোদ করে ক্ষমতায় যেতে চায়? যদি তারা বিদেশীদেরকে তোষামোদ করে ক্ষমতায় যেতে চায় তাহলে তারা অত্যন্ত ভুল করছে। কারণ একমাত্র সামরিক অভ্যুত্থান ছাড়া বিদেশিরা রেজিম চেঞ্জ করতে পারে না। যেখানে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রশ্ন নাই সেখানে তারা প্রথম দেখে, মাঠ কাদের দখলে আছে। আজ যদি মাঠ বিএনপির দখলে থাকতো তাহলে বিদেশি দূতাবাসগুলো সরকারের ওপরে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারতো। কিন্তু বিদেশীরা দেখছে যে বিএনপি একটি পেপার টাইগার। তাই বিএনপিও আর তেমন বিদেশী সমর্থন পাচ্ছে না।
বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারবাসের ১৬ মাস হয়ে গেলো। কে যে তাদের মাথায় নিয়মতান্ত্রিকতায় ভূত ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে সেই ভূত আর বিএনপির মাথা থেকে বের হচ্ছে না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বললেও হুটমুট করে বিএনপি রাজপথে নামার হুঙ্কার দেয়। এসব হুঙ্কারকে আওয়ামী লীগ এক ফোটাও পাত্তা দেয়না। আজ যখন এই কলামটি লিখছি তখন দেখলাম আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের বিএনপির প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।
গত রবিবার একশ্রেণীর পত্র পত্রিকায় ওবায়াদুল কাদেরের এই চ্যালেঞ্জটি ছাপা হয়েছে। এসম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্টে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি বারবার আন্দোলনের কথা বলে বেড়াচ্ছে। বিএনপির যদি সেই সক্ষমতা থাকে, সাহস থাকে, তাহলে আন্দোলন করে দেখাক। ১০ বছরে তো ১০ মিনিটের একটি আন্দোলনও দেখা যায়নি। ‘দলীয় চেয়াপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে বিএনপি আন্দোলন-সংগ্রাম আরও বেগবান করবে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনেও যাবে’- দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলন করে তারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করুক! এমন আন্দোলনের কথা তো তারা বারবারই বলে বেড়াচ্ছে। এখনও পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি শুনতে পাচ্ছি।
তিন
ওবায়দুল কাদেরের এই চ্যালেঞ্জ কি বিএনপি গ্রহণ করতে পারবে? মাত্র ১০ মিনিটের একটি আন্দোলন করবে। তেমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চ্যালেঞ্জও কি বিএনপির গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে? জনগণ মনে করেন যে, ১০ মিনিট কেন ১০ দিনের আন্দোলন করার সক্ষমতা বিএনপির রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু ক্ষমতা থাকলেই হবে না, সাহসও থাকতে হবে। এটাতো এখন দুনিয়া জোড়া জানে যে এই সরকার একটি নিকৃষ্ট ধরনের ফ্যাসিস্ট সরকার। এই সরকার একটি চরম জুলুমবাজ সরকার। এই সরকার জনগণের রায়ে দেশ চালাচ্ছে না। চালাচ্ছে প্রশাসনের ক্ষমতাকে ভিত্তি করে। সুতরাং আন্দোলনে নামলেই শুরু হবে ধরপাকড় জেল জুলুম। চলবে রিমান্ড। অনেককে আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হবে। এই ধরণের জেল জুলুম এবং অন্যান্য অত্যাচার সহ্য করার মানসিকতা এখন বিএনপির সিনিয়র নেতাদের আছে কিনা। আজ এই প্রশ্নটি প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, বিএনপির মধ্যে যে অন্তর্দ¦›দ্ব দৃশ্যমান সেটি ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বল জেলাতেও।
বগুড়া বিএনপির দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। অথচ সেই বগুড়াতে বিএনপি এখন সুস্পষ্ট ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। বগুড়া বিএনপি অফিসেও তালা মারা এবং তালা খোলা- এই খেলা ৪/৫ দিন ধরে চলেছে। কেন্দ্র থেকে বগুড়া জেলা কমিটি বাতিল করে দেওয়া হয়। সেই বাতিলকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় উপদলীয় কোন্দল। সেই কোন্দল থামাবার জন্য তারেক রহমান লন্ডন থেকে পুরানো সব গুলো কমিটি ভেঙে দেন এবং বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক জি এম সিরাজকে জেলা কমিটির আহবায়ক বানান। তার নেতৃত্বে একটি আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়। শুধু তাই নয়, মির্জা ফখরুলের ছেড়ে দেওয়া আসনটিতে জি এম সিরাজকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি যদি আন্দোলনে নামে, তখন কি হবে? জি এম সিরাজের মতো শত কোটি টাকার মালিকেরা কি জেল জুলুম, হুলিয়া আন্ডারগ্রাউন্ড সহ্য করতে পারবেন?
আসল কথা হলো বিএনপিকে বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে হবে। এখানে ইংল্যান্ড আমেরিকার বাস্তবতা দিয়ে চলবে না। অতীতে আমি বিএনপির বিভিন্ন গোল টেবিল বৈঠক এবং সেমিনারে বক্তা হিসাবে থাকতাম। আমি যখন বলেছি যে আপনারা মাথা তুলে দাঁড়ালেই আওয়ামী লীগ মার দেবে। সুতরাং সেই মার মোকাবেলা করার জন্য আপনারা সংগঠনকে সেভাবে দাঁড় করান। অনেকে আমাকে বলেছেন, আমরা পেশি শক্তিতে বিশ্বাস করি না। এখনতো বিএনপি দেখছে যে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথে প্রধান বাধাই হলো পেশি শক্তি। বিএনপি ক্ষমতার প্রায় দোর গোড়ায় পৌঁছে যায়। ঠিক তখনই আওয়ামী লীগ তাদেরকে মেরে তক্তা করে দেয়। আর মার খেয়ে তারা লেজ গুটিয়ে পালান। আওয়ামী লীগের এই পেশি সঞ্চালন আমরা তো দেখেছি পাকিস্তান আমলে মওলানা ভাসানী যখন ন্যাপ গঠন করেন, যখন জামায়াতে ইসলামী পল্টনে জনসভা করে, যখন সিপিবি এবং ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীনতার পর মার্কিন বিরোধী র্যালি করে তখন-সহ বিভিন্ন অকেশনে এই পেশি শক্তির নির্মম ব্যবহার আমরা দেখেছি। তারপরেও কি বিএনপির সম্মানিত নেতা ও কর্মীরা, আপনাদের হুঁশ হবে না?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।