পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যশোরের মনিরামপুরে একটি বাসচাপায় স্থানীয় ধলিগাতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ফার্স্ট ও সেকেন্ড বয় নিহত হয়েছে। গত ২০ জুন যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কে উপজেলার খইতলা নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলো- উপজেলার ধলিগাতি গ্রামের খাইরুল বাশারের ছেলে আশিকুর রহমান ও জামলা গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে আল-আমিন। নিহত দুইজনই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র ছিল। ক্লাসে আশিকুরের রোল নম্বর ছিল ১ ও আল আমিনের রোল নম্বর ছিল ২। আশিকুর এবং আল আমিনের মতো এমন কত মেধাবী যে প্রতিনিয়ত ঝড়ে যাচ্ছে সড়ক দুঘর্টনায় তার হিসাব নেই। প্রতিদিনই সড়ক দুঘর্টনার মর্মান্তিক খবর আমাদের পড়তে হয়। ঈদ আমাদের প্রধান উৎসব। এ সময় নাড়ীর টানে লাখ লাখ মানুষ ছুটে শহর ছেড়ে স্বজনদের সাথে মিলিত হতে বাড়ি যায়। দুঃখের বিষয়, এই আনন্দযাত্রায় দুর্ঘটনায় অনেকের জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। উৎসবের পরিবর্তে স্বজন হারানোদের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। আহতদের পরিবারের সদস্যদের ছুটতে হয় চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে, তাদের ঈদ কাটে হাসপাতালের বারান্দায় ছুটাছুটি করে। ব্যতীক্রম ছিল না এবারের ঈদযাত্রাও। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, এবারের ঈদযাত্রার ১৩ দিনে ২৫৬টি দুর্ঘটনায় ২৯৮ জন নিহত ও ৮৬০ জন আহত হয়েছেন। সংগঠনটির তথ্য বলছে, ঈদুল ফিতরে ঘরে ফেরার পথে ২০১৬ সালে সড়কে প্রাণ হারান ১৮৬ জন। ২০১৭ সালে সংখ্যাটি বেড়ে হয় ২৭৪। ২০১৮ সালের ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৩৩৯ জন। সব মিলিয়ে গত চার বছরে শুধু ঈদুল ফিতরেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০৯৭ জন। ঈদের ছুটিতে গড়ে দিনে ২০ থেকে ২৩ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। শুধু ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার এই ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় না। সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৫ হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ২০ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৬২ হাজার ৪৮২ জন।
প্রতিদিন যারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন, যারা আহত বা পঙ্গু হচ্ছেন তারা আমাদেরই কারো ভাই, বোন, মা, বাবা কিংবা আত্মীয়-স্বজন। তাদের মধ্যে আছে সরকারি-বেসরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নপদস্থ কর্মচারী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, হেলপার, চালক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষ। এসব মেধাবী, সৃষ্টিশীল ও কর্মজীবী মানুষের স্ব স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় এসব মানুষের মৃত্যু অর্থনীতিতে ভয়াবহ ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে রাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। দুর্ঘটনায় মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদের ক্ষতির পরিমাণ মোট জিডিপির দেড় থেকে ২ শতাংশ। এটা আর্থিক ক্ষতির হিসাবে এক বিরাট অংক। যদিও সবার আগে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে ব্যক্তি, তারপর তার পরিবার, সবশেষে রাষ্ট্র। এই যে প্রতিনিয়ত মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে, এ নিয়ে রাষ্ট্র কতটা সচেতন কিংবা আহত-নিহতদের পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়? প্রতিনিয়ত শত শত পরিবার কর্মক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে যে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কি কোনো মায়া-মমতা, সহমর্মিতা কাজ করছে? করছে না। যে পরিবারটি স্বচ্ছলভাবে দিনাতিপাত করেছিল, সে পরিবারটিই একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে-এ বোধ কয়জনের মধ্যে কাজ করে? কিংবা যে মানুষটি পঙ্গু হয়ে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছে, তার খোঁজই বা কয়জন নেয়? প্রতিটি নাগরিকের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দুঃখের বিষয় আমাদের রাষ্ট্র এ কাজটি যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাষ্ট্র যারা চালান, তারা এ দায়িত্ব পালনে কতটা আন্তরিক, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। প্রতিনিয়ত মানবিক এবং আর্থিক এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি অবলীলায় মেনে নেয়া হচ্ছে। যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সচেতন হচ্ছে না পরিবহন মালিক, শ্রমিক সংগঠনগুলো, সচেতন হচ্ছে না যাত্রীরাও। অনেক ক্ষেত্রে আইন যথপোযুক্ত নয়, আবার যে আইন আছে তা মানা হচ্ছে না। ফলে অদক্ষ চালক গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে, ফিটনেসহীন গাড়ি রাস্তায় নামার সুযোগ পাচ্ছে। এক ধরনের অরাজকতার মধ্য দিয়ে পরিবহন খাতটি চলছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, লাইসেন্সধারী চালকের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। ফলে লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়েই চালানো হচ্ছে অসংখ্য বাস-ট্রাক। দুর্ঘটনার পর প্রায়ই জানা যায় যে চালকের লাইসেন্স ছিল না, অথবা চালক ছিলেন মাদকাসক্ত। এটা সত্য যে, সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে পরিবহন মালিক, শ্রমিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিআরটিএ এবং সর্বোপরি দেশের মানুষ সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনকে আইনের গতিতে চলতে দিলে অদক্ষ চালক যেমন লাইসেন্স পাবে না, তেমনি ফিটনেসবিহীন গাড়িও রাস্তায় নামতে পারবে না। এ ব্যাপারে সরকারের কিছু পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা গেছে। যদিও তা শতভাগ চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। তাছাড়া শুধু দক্ষ ও লাইসেন্সধারী চালকের সংকট এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে না। সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে আরো নানা কারণ রয়েছে। সেসব কারণও কারো অজানা নয়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সেসব সমস্যারও প্রতিকার করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে চালকের প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স ইস্যু পদ্ধতি আধুনিকায়ন, যানবাহনের ফিটনেস প্রদান পদ্ধতি আধুনিকায়ন, রাস্তায় ফুটপাথ-আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণ, জেব্রা ক্রসিং, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও গবেষণা, ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ সড়ক নিরাপত্তায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে মানসম্মত পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন দেশের অধিকাংশ মহাসড়ক উন্নত এবং মসৃণ হওয়ায় দূরপাল্লার গাড়ির গতি অতিমাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। তাই গতি নিয়ন্ত্রণ করা, ধীরগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা আলাদা লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকাসক্ত অবস্থায় যেন চালকরা কোনোভাবেই গাড়ি চালাতে না পারে সে ব্যাপারেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তবে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে যা প্রয়োজন তা হলো দেশের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। দুঃখের বিষয়, আমরা সবকিছু দেখছি, শুনছি কিন্তু প্রতিকারের চেষ্টা করছি না, প্রতিরোধের কথাও ভাবছি না। সড়ক দুর্ঘটনাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নিচ্ছি। এটা আসলে এক ধরনের অসুস্থতা। আর এ অসুস্থতার শিকার শুধু পরিবহন মালিক, শ্রমিক, চালকরাই নয়, বরং সমাজের প্রতিটি মানুষ কিংবা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা। যদিও কিছু ব্যতীক্রম ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং গুণী টেলিভিশন সাংবাদিক মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার পর গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন সংগঠন যেভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে সোচ্চার হয়েছিল সেটা যদি অব্যাহত থাকত তাহলে এতদিনে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসত- এটা নিশ্চিত। শুধু তাই নয়, সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সৌরভ নিহত হওয়ার পরও সড়ক দুর্ঘটনা বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। বিশেষ করে শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মিমকে হারানোর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র সমাজ যেভাবে জেগে উঠেছিল তা আমাদের গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। এটা যদি অন্যান্য সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অব্যাহত থাকত তাহলে নিশ্চিতভাবেই কমে আসত সড়কে মৃত্যুর ঘটনা। যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেখানে স্বাভাবিক বিষয় হওয়ার কথা, তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিশেষ বিশেষ কিছু ঘটনার প্রতিবাদ হলেও অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে। এটা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও নির্বিকার থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনের অন্যায় দাবিকেও মেনে নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদেরকে অবশ্যই বের হতে হবে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার শুধু সাধারণ মানুষ নন, সকল স্তরের মানুষই শিকার হচ্ছে। এমনকি পরিবহন শ্রমিকরাও হারাচ্ছে তাদের মূল্যবান জীবন। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গু হওয়া অনেক পরিবহন শ্রমিককে আজকাল ভিক্ষাবৃত্তি পর্যন্ত করতে দেখা যায় নানা জায়গায়। এটা চালক এবং হেলপারদেরও যেমন উপলব্ধি করতে হবে, তেমনি মালিকদেরও সচেতন হতে হবে। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হতাহতদের পরিবারগুলো যেমন নিঃস্ব হচ্ছে, তেমনি মালিকদের বাস-ট্রাকগুলোও ধ্বংস হচ্ছে, ফলে তারাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই নিজেদের স্বার্থেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকদের সচেতন হওয়া উচিত। পাশাপাশি সচেতন হবে পথচারী এবং সাধারণ যাত্রীদেরও।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।