Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

প্রকৃতি পরিবেশ কীটপতঙ্গ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষার দায়ভার যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সমগ্র মানবজাতির, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই গুরুত্ব আমাদের উপলদ্ধি করতে বহু যুগ অতিক্রম করে আসতে হয়েছে নিঃসন্দেহে। সভ্যতার অগ্রগতির নেশায় বুঁদ হয়ে মানুষ উপলদ্ধি করতে পারেনি যে বিকাশের উদভ্রান্ত লোভে সে ধীরে ধীরে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রতি বছর জুন মাসের ৫ তারিখ বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তার দু‘বছর পর ১৯৭৪ সালে যখন প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয় তার মূল বিষয় ছিল ‘অনলি ওয়ান আর্থ’। আমাদের ‘একটাই মাত্র পৃথিবী’- এই বোধ দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গত কয়েক দশকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস বিশ্বব্যাপী একটা মঞ্চ হিসেবে গড়ে উঠেছে, যেখানে এখন অবধি ১৪৩টি দেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশ সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পৃথিবী জুড়ে এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতি বছর পরিবেশ দিবস উদযাপনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ বছর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজক দেশ চীন। এবারকার আলোচনার মূল বিষয় ‘বায়ু দূষণ’ যা আজকের পৃথিবীতে মারাত্মক একটি সমস্যা। ভাবলে অবাক লাগে, আজ সারা পৃথিবীর শতকরা ৯২ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ বায়ু থেকে বঞ্চিত। এই আলোচনার শিরোনাম দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয় যে, পৃথিবী জুড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় তথাকথিত ‘সর্ব শ্রেষ্ঠ জীব’ মানুষের যে ভূমিকা, সেই তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ ও নগণ্য উপস্থিতি ও ভূমিকা যেখানে কীট ও পতঙ্গের, সেখানে কোনও আলোচনার কেন্দ্রে এদের উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয় নয় কি? তা যে নয় তার সমর্থন মিলে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী ও গবেষক ফ্রান্সিস্কো সানচেজ বেও-র লেখায়। তাঁর মতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমান ভূমিকা, কারণ সবাই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে বেও বলেন, কীট পতঙ্গের বিলুপ্তি হওয়া যদি খুব সত্বর বন্ধ করা না যায় তাহলে তা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করবে এবং মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য মহাপবিপর্যয় ডেকে আনবে।

কীট পতঙ্গের সঙ্গে মানব সভ্যতা, জীবন-যাপন আদিকাল থেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মৌমাছির কথাই ধরা যাক। এদের শরীরে সৃষ্টি হওয়া মধু বিভিন্ন সামাজিক কাজে ব্যবহৃত হয়। মধুকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম প্রাণীজাত মিষ্টি দ্রব্য। একটি মানুষ জন্মের পর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি অনুষ্ঠানে মধুর ব্যবহার অপরিহার্য। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় মৌমাছির চাষ হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলেই বেশি মধু উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের অর্থনীতিতে মৌমাছির অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশকে ‘ল্যান্ড অফ হানি’ বলা চলে। বাংলাদেশে পাঁচ প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়। পাঁচ প্রজাতির মধ্যে এপিস মেলিফেরা থেকে সব থেকে বেশি মধু পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশে মৌমাছি নামে পরিচিত। আমাদের দেশে প্রায় লক্ষাধিক চাষি এই মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তার মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার মধু সংরক্ষণকারী ৭৫ হাজার মৌচাকের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। চাষিদের নিজের জমি না থাকলেও মধু চাষ করা সম্ভব। মৌমাছি জঙ্গলেও চাষ করা যায়। তাই বনবাদারে বাঘ বা অন্য বন্য প্রাণীর আক্রমণে মধু সংগ্রহকারীর মৃত্যুর খবর মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় খবর হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে মৌমাছি চাষের প্রচার, প্রসার ও নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গে চাষিদের পরিচিত করে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৬২ সালে দ্য সেন্ট্রাল বী রিসার্চ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমাদের দেশেও কৃষি বিজ্ঞানীরা মৌচাষে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ এ দেশেও মধু চাষ করার ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। মৌমাছিদের লাইফ স্টাইল কিন্তু সুন্দর এবং চমৎকার। একটি মৌচাকের মধ্যে একটি রানী থাকে আর কয়েক হাজার পুরুষ কর্মী মৌমাছি থাকে। পুরুষ মৌমাছিরা প্রজননের ঠিক পরেই মৌচাক থেকে বেরিয়ে পড়ে। কর্মী মৌমাছিরা ভীষণ পরিশ্রমী হয়। সাধারণত বসন্তকালে ওরা ফুল থেকে প্রোবোসিস দিয়ে নেক্টার বা মধু সংগ্রহ করে। মৌমাছির দুটো পাকস্থলী। একটাতে প্রাত্যহিক খাবার জমা থাকে, আরেকটাতে ফুল থেকে নেক্টার সংগ্রহ করে তা জমা রাখে। পরে এই নেক্টার আর ওদের শরীরের উৎসেচক বা এনজাইম মিলে মধু তৈরি হয়। তারপর মৌচাকে এক একটা কোঠাতে সেই মধু জমিয়ে রাখে। কর্মী মৌমাছিরা দুরদরান্ত থেকে নেক্টার সংগ্রহ করে আনে। এদের মধ্যে কেউ আবার অনেক দূর অবধি উড়ে গিয়ে নতুন জায়গার সন্ধান নিয়ে এসে মৌচাকে থাকা অন্য সকল কর্মীদের এক ধরনের বিশেষ নৃত্যের সাহায্যে সেটা জানিয়ে দেয়। মৌমাছিদের সঙ্গবদ্ধ গোষ্ঠিজীবন এইভাবে পরোক্ষ মানুষেরই বিভিন্ন চাহিদার জোগান দেয়। প্রকৃতিতে আরও এমন অনেক ধরনের কীট ও পতঙ্গ আছে যাদের গুরুত্ব মানুষের জীবনে অপরিসীম। এড়ি এবং মুগা এক ধরনের প্রজাপতি যার থেকে সিল্ক বা রেশম সুতা উৎপাদন হয়। এই শুয়োপোকা জাতীয় পতঙ্গ ডিম থেকে ফুটে সম্পূর্ণ বড় হতে প্রায় ৪২-৪৫ দিন লাগে। এরা একসঙ্গে ৪০০-৫০০ ডিম পাড়ে। ৯-১১ দিনের মধ্যে ডিম ফেটে গুটিপোকা বেরিয়ে আসে। এই গুটিগুলো থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পোকা সরিয়ে সিল্ক বা রেশম সুতা উৎপন্ন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে, এই ধরনের পোকা চাষ হয়। এর ফলে এড়ি এবং মুগা পোকা থেকে উৎপাদিত রেশম শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে প্রচুর প্রভাব পড়ে। তাই সরকারি উদ্যোগে এই পোকাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। রেশম গুটি ও সুতা আবিষ্কার নিয়ে একটা মজার গল্প প্রচলিত আছে। বহু যুগ আগে নাকি কাশ্মীরের এক যুবকের সঙ্গে চীন দেশের এক রাজকন্যার বিয়ে হয়। নববিবাহিত সেই কন্যা বাপের বাড়ি থেকে আসার সময় নিজের চুলের খোপার ভিতরে কাঁচা রেশম গুটি নিয়ে আসে, যা থেকে পরবর্তীকালে রেশম শিল্পের সূত্রপাত হয়।

রেশম সিল্ক থেকে তৈরি বস্ত্র আভিজাত্যের পরিচায়ক। ১৭৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে বাংলায় এর চাষ শুরু করে । ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে এর নিয়মিত চাষ ছড়িয়ে পড়ে। আজ ভারতের কর্নাটকে সব থেকে বেশি রেশম গুটি থেকে সিল্ক উৎপাদন হয়। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বরাক উপত্যকার দুর্লভছড়া, ঝাঁপিরবন্দ, আদরকোণা, পয়লাপুল, দর্মিখাল, ঠালিগ্রাম ইত্যাদি স্থানে এড়ি এবং মুগা চাষ হয়। দেশের অর্থনীতিতে এই শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সেরিকালচার বিভাগে চাকরির সুযোগ রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এড়ি এবং মুগা চাষে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হয়, যার ফলে এই শিল্পকর্ম সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরমুখী যাত্রাতে বিরতি আনার ব্যাপারে একটি বড় ভূমিকা নিতে পারে। ২০১৭ সালের সেরিকালচার স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ার বুক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৫-১৬ সালে সারা দেশে সিল্ক উৎপাদন ছিল ২৮,৫২৩ মেট্রিক টন যা থেকে ২৫০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে।

আরও এক ধরনের পোকা মানুষের জীবন-যাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের লাক্ষাপোকা বলা হয়। এ ধরনের পোকার মুখ থেকে যে রস নিঃসৃত হয় তা থেকে লাক্ষা তৈরি হয়। এই লাক্ষা পোকার চাষ প্রথমে অবিভক্ত ভারতবর্ষে শুরু হয়। ভারতবর্ষ থেকে বছরে প্রায় চারশ’ মিলিয়ন পাউন্ড লাক্ষা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রফতানি করা হয়। ঝাড়খন্ড সে দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি লাক্ষা উৎপাদনকারী রাজ্য। সে রাজ্যে লাক্ষা উৎপাদন মোট উৎপাদনের ৫৭ শতাংশ প্রায়। এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্রে লাক্ষা চাষ হয়। খুব স্বল্প পুঁজিতে এই শিল্প শুরু করা যায়। এই শিল্প উৎপাদনে পলাশবৃক্ষ বা কুসুম বৃক্ষের মতো পোকার অতিথি গাছ বা হোস্ট প্লান্ট প্রয়োজনীয়। ইন্সুলেটর, ঘরের মেঝে পালিশ, জুতো পালিশ, কসমেটিকস ইত্যাদি বানানোর মত কাজে লাক্ষা ব্যবহৃত হয়।

কীটপতঙ্গের উপস্থিতিতে এভাবে শুধু মানবজাতি নয়, সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমই ভীষণভাবে উপকৃত হয়। মৌমাছি ও প্রজাপতির মতো পতঙ্গ ফুল এবং ফলের প্রজননে সাহায্য করে। কীট-পতঙ্গ, মানুষ ও পশু-পক্ষীর খাদ্যের চাহিদা মিটায়। আবর্জনা থেকে সার তৈরি করতে কীটপতঙ্গের বিশাল ভূমিকা আছে। কিছু কিছু পোকা ইন্ডিকেটর স্পেসিস নামে পরিচিত। এদের উপস্থিতি থেকে জলাশয়ের পানি পরিষ্কার না দূষিত তা বোঝা যায়।

আশঙ্কার কথা, সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় আড়াই শতাংশ হারে কীটপতঙ্গের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই হারে হ্রাস পেতে থাকলে অচিরেই পৃথিবী থেকে কীটপতঙ্গ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কীট পতঙ্গ বাঁচিয়ে রাখা যে কত জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রসঙ্গে ড. ফ্যান্সিস্কো সানচেজ বেও-র প্রণিধানযোগ্য সাবধানবাণী, ‘ইফ উই ডোন্ট স্টপ ইট, এন্টায়ার ইকোসিস্টেমস উইল কলাপস ডিউ টু স্টারভেশন’। কীটপতঙ্গের সংখ্যা লোপ পাওয়ার কারণের মধ্যে উষ্ণায়ন, নগরায়ন, অরণ্যবিনাশ, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য।

অতএব কীটপতঙ্গ, পশু-পাখী, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, গবাদীপশুসহ সকল প্রকার প্রাণীর সংরক্ষণ করার ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে, অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের একটি-ই পৃথিবী এবং তা লালন-পালন করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন