পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পলিটিক্স শব্দটি কিভাবে যেন একটি নেতিবাচক শব্দ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ‘রাজনীতিতে পলিটিক্স ঢুকে গেছে’ বলে কেউ কেউ গণমাধ্যমের টক শো ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্রুপাত্মক ট্রল করতে দেখা যায়। রাজনৈতিক অপপ্রচার, মিথ্যাচার, সন্ত্রাস-নিষ্ঠুরতার ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও একবিংশ শতকে এসে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের ধ্বজাধারি পশ্চিমা সাম্রাজ্যদের রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও নিষ্ঠুরতা ইতিহাসের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। গত এক শতাব্দীতে রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের উপর ভিত্তি করে পশ্চিমারা যে সব যুদ্ধ-সংঘাতের জন্মদিয়েছে ইতিপূর্বে হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসেও তা ঘটেনি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যদের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির ভাগাভাগি আধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ন্যাস্ত হওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে মার্কিনীদের সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি। যুদ্ধের মূল প্রতিপক্ষ হিটলারের নাৎসী বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে অ্যাটম বোমা ফেলে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং শহর দুটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। বৃহত্তম রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ইউরোপের সমর্থন প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে থ্কালেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব বলয় ইউরোপ-এশিয়ায় ক্রমে বিস্তুৃত হয়ে পড়ার পাশাপাশি রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম সামরিক-পারমানবিক শক্তিতে পরিনত হওয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের ভ’-রাজনৈতিক এজেন্ডা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে বাধ্য হয়। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের উপর ইঙ্গ-মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং সেই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ামক শক্তিগুলোকে বিভাজিত ও বৈরি শক্তিতে পরিনত করার নীলনকশা গ্রহণ করা হয়েছিল। ইহুদি ব্যাংকারদের সঞ্চিত অর্থ এবং সমর্থন নিশ্চিত করে যুদ্ধজয়ের বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভ’মি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে উঠে। এ কারণেই গত ৭০ বছরেও ইসরাইল কোনো স্বাভাবিক রাজনৈতিক রাষ্ট্রশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বতস্ফুর্ত পরিনতি এবং প্রতিবেশীদের সাথে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলার পরিবর্তে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে একটি পশ্চিমা গ্যারিসন স্টেট বা মার্কিনীদের স্বার্থের লাঠিয়াল হিসেবে টিকে আছে। জাতিসংঘ এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে অধবা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা-সমঝোতার মধ্য দিয়ে গত ৭০ বছরে বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়েছে। আমেরিকা-রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট ইউরোপে জার্মানী এশিয়ায় কোরিয়ার মত দেয়াল ঘেরা ভাগাভাগির পরও দেয়াল ভেঙ্গে একত্রিত হওয়া অথবা নিজেদের মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ তৈরী করতে পারলেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং জেরুজালেমের মর্যাদার প্রশ্নে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে শান্তি ও সমঝোতার টেবিলে বসানো যায়নি কেন? এই প্রশ্নের জবাব এখন অনেকটাই পরিস্কার। মূলত: মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থেই এই সমঝোতার প্রচেষ্টাকে কৃত্রিমভাবে আড়াল করে বা ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। প্রথমে আরবদের নতুন ভূমি দখল, অত:পর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি, অসলো শান্তি চুক্তির মত চুক্তিগুলো হয়েছিল শক্ত প্রতিপক্ষ মিশর ও জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের গোপণ সমঝোতার পথ সৃষ্টি করে সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে ইসরাইলকে অপ্রতিদ্বন্দি পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপকৌশল মাত্র।
এখনো পশ্চিমাদের শিল্পায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের চাকা সচল রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি একমাসের মধ্যেই পাল্টে দেয়া অসম্ভব নয়। এটা ওদের জানা আছে বলেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে মুসলিম উম্মাহ ও আঞ্চলিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে একত্রিত হতে না দেয়া এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও হোস্টাইল করে রাখার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সবকিছুই করে যাচ্ছে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ, তালেবানদের প্রতি সমর্থন দিয়ে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীর বিদায়, সাদ্দাম হোসেনকে কুয়েত দখলের প্ররোচনা অত:পর কুয়েত মুক্ত করতে প্রথম গাল্ফ ওয়ারের সূচনা এবং ইরাকের উপর দীর্ঘ মেয়াদী অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে সন্ত্রাসী বিমান হামলার দায় আল কায়েদার উপর চাপিয়ে ওয়ার অন টেররিজমের ঘোষণা দিয়ে মূলত বিশ্বের মুসলমানদের যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া, আফগানিস্তান, ইরাক দখল এবং সন্ত্রাসবাদ দমন ও আইএস জুজু মোকাবেলার নামে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর ওয়ারফ্রন্ট গড়ে তোলার উদ্দেশ্য প্রথমত: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পশ্চিমা বশংবদ শাসকদের সন্ত্রস্ত করে রাখা এবং তাদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে অস্ত্র বিক্রির নামে তেল রফতানী থেকে সঞ্চিত হাজার হাজার কোটি ডলার লুটে নেয়া। তবে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রচুক্তি হলেও ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন কোনো অস্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশকে কখনো দেয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি পশ্চিমা অন্য দেশগুলোকেও সব সময় মেনে চলতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া সেই অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে চীন, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরাণে প্রতিরক্ষা ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা বিক্রি করতে শুরু করায় মার্কিনীদের পুরনো এজেন্ডা ভেস্তে যেতে বসেছে। অন্যদিকে ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইরান ও তার ইসলামি রেভুলেশনারি গার্ড বাহিনী গত চার দশকে সবর্ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা অর্জনের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের পরোক্ষ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনের হামাস এবং লেবাননের হেজবুল্লাহ মিলিশিয়াদের হাতে বিশ্বের পরাক্রান্ত শক্তি হিসেবে পরিচিত আইডিএফ(ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্স) অন্তত দুইবার চরমভাবে মার খেয়ে মিলিশিয়াদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়ার সামরিক অভিযান ত্যাগ করে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ থেকেই তারা ইরানের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে নিজেরা যতটা উদ্বিঘ্ন তার চেয়ে অনেক বেশী উদ্বেগ সউদি আরব, সংযুক্ত আমিরাতের মত প্রতিবেশিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে একটি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার বাতাবরণ তৈরী করতে বেশী তৎপর রয়েছে। ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ ৬ জাতির সমঝোতা চুক্তির কারণে ইরানের পারমানবিক প্রকল্পকে ঘিরে পশ্চিমাদের অপপ্রচারের রাস্তা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরী হওয়ার কারণে ইসরাইলপন্থি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খোঁড়া অজুহাতে ৬ জাতির চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আবারো ইরানের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধসহ সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছেন। তবে রাশিয়া, জার্মানী, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ চুক্তির অন্য অংশীদাররা চুক্তির শর্ত মেনে চলার ঘোষণায় অটল থাকায় এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা ব্যর্থ হতে চলেছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিন সংকটের দ্বি-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ও দূতিয়ালি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরব-ইসরাইল সংকট ও বিশ্বশান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই বছর আগে ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় বলা হয়েছিল, জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের কোনো অধিকার নেই। এ কারণে ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একযোগে ইউনেস্কোর সদস্যপদ ত্যাগ করার ঘোষণা দেয়। এভাবেই ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জায়নবাদী ইসরাইলের বিচরণক্ষেত্র।
মার্কিনীরা কি শান্তিকামী বিশ্বের উপর যেনতেন প্রকারে একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাইছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও তার বশংবদ শাসকদের সাম্প্রতিক অপতৎপরতা দেখে এমন আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর দুই মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে ওয়ার অন টেররিজম পর্যন্ত প্রতিটি অন্যায় যুদ্ধ যারা শুরু করেছিল সকলেই ফল্স ফ্লাগ অথবা মিথ্যা অভিযোগ ও অপ্রপচার চালিয়ে যুদ্ধকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে। এতে তারা সফলও হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে অপ্রতিদ্বন্দি শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হলে তারা প্রথমেই হামাস-হেজবুল্লাহর মত অপরাজেয় সামরিক শক্তিসহ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। সেই সাথে হামাস-হেজবুল্লাহ ও রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনী ধ্বংস করতে ইরানে রিজাইম চেঞ্জ করেন সেখানে ইরানের সাবেক শাহদের মত পুতুল সরকার কায়েম করতে হলে সম্ভবত একটি বড় ধরনের যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলের জায়নবাদি পরিকল্পনা অনুসারে এই যুদ্ধ আরো অনেক আগেই শুরু করার কথা ছিল। হামাস ও হেজবুল্লাহর নেটওয়ার্ক ভাঙ্গতে না পারা এবং ব্যাপক আকারের প্রক্সি ওয়ারের পরও সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জেব্যর্থতার কারণে তাদেরকে নতুনভাবে হিসাব নিকাশ করতে হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা অনুসারে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনী সংকটের সমাধান প্রক্রিয়া এবং ইরানের সাথে ৬ জাতির সমঝোতা চুক্তি বহাল রেখে যুদ্ধের দামামা বাজানো মার্কিনীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে কোনো বাস্তব কারণ ছাড়াই ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়া ভন্ডুল করে দিয়ে নিউ প্যালেস্টাইন নাদ দিয়ে ইসরাইলের একটি ভ্যাসাল স্টেট গঠনের অবাস্তব প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ইতিমধ্যে ফাঁস হওয়া একটি খবরে এই প্রস্তাবকে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে জুনমাসের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাবের রূপরেখা প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হলেও রোজার আগেই ইসরাইলের একটি পত্রিকায় এর অংশ বিশেষ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি সম্ভবত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সমঝোতায় ইচ্ছাকৃত বিষয়। বিশ্ব সম্প্রদায় ও মুসলিম বিশ্বের প্রত্যাশার সাথে সাংঘর্ষিক বিপরীতমুখী একটি প্রস্তাবকে ফিলিস্তিন, আরব ও বিশ্বসম্প্রদায় কিভাবে গ্রহন করবে তারা হয়তো তারই একটি প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছে। বলাবাহুল্য, ট্রাম্পের এই প্রস্তাব সর্ব মহলে সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ছাড়া আর কোনো পক্ষই এমন প্রস্তাবকে ফিলিস্তিন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান দিতে পারে বলে মনে করছে না। ট্রাম্পের ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির কাউন্টার হিসেবে রিটার্ন অব দ্য সেঞ্চুরি নামের একটি পাল্টা ক্যাম্পেইন শুরু করতে যাচ্ছে ইরান। এটি কোনো পাল্টা প্রস্তাব নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির বিপজ্জনক দিকগুলো তুলে ধরে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানামাত্রিক ওয়ার্কশপ ও শৈল্পিক উদ্যোগ গ্রহণ করাই রিটার্ন অব দ্য সেঞ্চুরির প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ইরান।
ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে, হরমুজ প্রণালী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তেল রফতানীর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য ইরানের হাতে চলে যাওয়া। এর ফলে তেলের বিশ্ববাজারের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বঅর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে। এমন বাস্তবতায় হরমুজ প্রনালী ও ওমান উপসাগরের উপর প্রখর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে ভ’মধ্যসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর শক্ত ও সরব উপস্থিতি রয়েছে। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর, ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি ইরানকে আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি বলে প্রমান করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে। গত এক মাসে হরমুজ প্রনালীতে দুই দফায় অন্তত চারটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার ক্ষেপনাস্ত্র হামলার শিকার হওয়া এবং এসব হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তাৎক্ষনিকভাবে ইরানের উপর দায় চাপানোর জোর তৎপরতা থেকে মার্কিনীদের উদ্দেশ্য অনেকটা পরিস্কার হয়ে গেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরাক যুদ্ধ এবং ওয়ার অন টেররিজম পর্যন্ত যেভাবে প্রতিটা যুদ্ধ শুরুর আগে মার্কিনীরা একেকটা রহস্যজনক দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছে এবং নিজেদের সুবিধামত প্রতিপক্ষের উপর দোষ চাপিয়ে যুদ্ধকে জায়েজ করার চেষ্টা হয়েছে, এবারো তার ব্যতিক্রম নেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিকে ইরানের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তির হুমকি দিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, একইভাবে মার্কিনীরা ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়াতে চায় না বলেও বিবৃতি দিয়েছে। ইরানকে ভয় দেখিয়ে ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও জায়নবাদের নতুন এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথকে নিস্কন্টক করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ইরানের সামরিক-অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে একটি যুদ্ধের অজুহাত খাড়ার করতে চাইছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জাপানি তেল টেঙ্কার ও পাইপলাইনে হামলার মাধ্যমে এসব দেশকে ইরান বিরোধি যুদ্ধে জড়ানোর মওকা তৈরী করা হচ্ছে বলে প্রতিয়মান হয়। এ ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রচারনা, ফল্স ফ্লাগ অপারেশন ও ব্লেইম গেম হচ্ছে তাদের প্রাথমিক প্রধান অস্ত্র। গাল্ফ অব ওমানে জাপানী মালিকানাধীন ওয়েল ট্যাঙ্কারে বিস্ফোরণ ঘটার পর মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেও তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইরানের উপর দোষ চাপিয়ে যুদ্ধের নতুন হুমকির বাতাবরণ তৈরী করতে শুরু করেছেন। কোনো তথ্য প্রমান ছাড়াই ইরানের উপর দোষ চাপালেও ইন্সিডেন্টের ভিকটিম অন্য কুশীলবদের সাথে মার্কিনীদের বক্তব্যের তেমন সাজুয্য দেখা যাচ্ছে না। ইরানের পেতে রাখা মাইনে জাপানী জাহাজে বিস্ফোরণ ও আগুন ধরে যাওয়ার মার্কিন অভিযোগের সাথে জাপানি জাহাজ ককোকা করেজাস’র মালিকপক্ষ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। উড়ে আসা ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে গাল্ফ অব ওমানে জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এমন সময় জাপানি মালিকানধীন জাহাজকে হরমুজ প্রনালীতে টার্গেট করা হয়েছে যখন জাপানী প্রধানমন্ত্রী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারী সফরে ইরান সফর করছিলেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ডর ট্রাম্পের অনুরোধে জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ৬ জাতির পারমানবিক চুক্তির পরিবর্তনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে ইরান এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পরই গাল্ফ অব ওমানে জাপানি তেলবাহী জাহাজ আক্রমনের শিকার হয়েছে। গত ১০-১২ দিনে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে পশ্চিমা লেখক-নিবন্ধকাররা ট্রাম্প-পম্পেওর মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট কেইটলিন জনসনের একটি নিবন্ধ গত শনিবার আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি পম্পেও বোল্টনসহ মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারাবাহিক মিথ্যাচারের বিবরণ তুলে ধরেছেন। একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, টেক্সাসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রোতাদের সামনে মাইক পম্পেও বলছেন, সিআইএ কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে প্রচুর মিথ্যা বলতে হয়েছে এবং চুরি- প্রতারণাও করতে হয়েছে। আমাদের পুরো প্রশিক্ষণ কোর্সটাই ছিল এমন। গাল্ফ অব ওমানে তেলবাহী জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার পর ইরানকে জড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগগুলো খন্ডিত হয়ে এখন ভিত্তিহীন গলাবাজি ও মিথ্যাচার হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। মধ্যপন্থি পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই এসব বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরে অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বাস্তবতায় লন্ডন ভিত্তিক সংবাদপত্র আল কুদস আল আরাবীর সাবেক সম্পাদক এবং বর্তমানে রাই আল ইয়ুম অনলাইনের চীফ এডিটর আবদেল বারী আতোয়ান তার সাম্প্রতিক এক নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন, আরব গর্ভমেন্টস হার্ম দেয়ার ওউন ইনটেরেস্ট বাই কোউ-টোয়িং টু ট্রাম্প। অর্থাৎ ট্রাম্পের প্রতি নতজানু নীতি গ্রহণ করে আরব নেতারা নিজেদের স্বার্থের ক্ষতি করে চলেছেন। আরব নেতারা এ পথ পরিহার না করলে ফিলিস্তিনের মুক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।