পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাজনীতি নিয়ে আর কি লিখবো? শুধুমাত্র ইনকিলাবেই দীর্ঘ ২৯ বছর রাজনীতি নিয়ে লিখছি। তার আগে অন্তত আরো ১১ বছর অন্যান্য পত্র পত্রিকায় লিখেছি। ৪০ বছর ধরে রাজনীতি নিয়ে অনেক কথাই লিখলাম। কিন্তু কী লাভ হলো? এখন আর রাজনীতি নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না। কারণ আমার মতে, রাজনীতি পচে গেছে। কিন্তু আমি কলম ছাড়তে চাইলে কী হবে, কলম যে আমাকে ছাড়ে না।
বলেছি, রাজনীতি পচে গেছে। আন্দাজে কথাটি বলিনি। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বিশেষে দলের পদ নিয়ে বাণিজ্য হয়, অর্থাৎ টাকা পয়সার দর কষাকষি হয় এবং লেনদেন হয়। আর ইলেকশন এলে তো পোয়াবারো। এমপির নমিনেশন পেতে হলে ৫ কোটি টাকারও বেশি লাগে। তাহলে এখন বুঝুন ব্যাপারটা। শুধু কিছু সংখ্যক এমপিকে নমিনেশন দিতে পারলে শত কোটি টাকা কামাই হয়। এত সহজে এত কম সময়ে এত বিশাল ধনী হওয়ার আর কি কোনো সোজা পথ আছে? প্রিয় পাঠক, এগুলো আমার কোনো মনগড়া কথা নয়। এরশাদের জাতীয় পার্টির নমিনেশন বাণিজ্য নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে এসব কথা বেরিয়েছে। পার্টির পদ পাওয়া বা এমপির নমিনেশন পাওয়ার বিনিময়ে টাকা পয়সার লেনদেনকে আামার কাছে ঘৃণ্য এবং নোংরা মনে হয়। আমরা যখন ছাত্র আন্দোলন করতাম, এমনকি ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দল না করলেও যখন রাজনীতি নিয়ে সেই পাকিস্তান আমলে আমি লেখালেখি শুরু করি এবং সেই সুবাদে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার কাছে আসা যাওয়া করি, তখন থেকে দেখছি সেই রাজনীতির ভিন্নরূপ। তখনও ইলেকশন হয়েছে, তখনও নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তখন টাকার বিনিময়ে নমিনেশন দেওয়া হয়নি। টাকার বিনিময়ে পার্টিতে বড় বড় পদ দেওয়া হয়নি। বরং কোনো এলাকায় কোনো জনদরদী নিঃস্বার্থ ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া গেলে নেতারাই তার কাছে ছুটেছেন নমিনেশন দেওয়ার জন্য। আমি এরকম একাধিক ব্যক্তির কথা জানি, যাদেরকে নমিনেশনের অফার দেওয়া হলে তারা অফার গ্রহণ করতে রাজি হননি। প্রথম কারণ হলো, তারা সবিনয়ে বলেছেন যে ইলেকশন করার মতো অত টাকা পয়সা তাদের নাই। সারা জীবন তারা উন্নত চিন্তা করেছেন এবং সৎ ও সরল জীবন যাপন করেছেন। ইলেকশন করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তারা পাবেন কোথায়? দলের সর্বোচ্চ নেতারা তখন বলেছেন, আপনি সৎ মানুষ। মানুষ আপনাকে চায়। ইলেকশন করতে আপনার বেশি টাকা লাগবে না। যেটুকু লাগে আমরাই সেটার ব্যবস্থা করবো।
আবার অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়েছে যে, দলের বড় বড় নেতারা অনেক সাধাসাধি করার পরেও তারা নমিনেশন নেননি। কারণ তাদের মতে, নমিনেশন নিলে নেতাদের কথা শুনতে হবে। এখন বরং তারা স্বাধীন। নিজের ইচ্ছে মতো জনসেবা করতে পারেন।
দলের উচ্চ পদ গ্রহণের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা গেছে। দলের অনেক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী রয়েছেন। তাদেরকে দলে সিনিয়র পজিশন নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে সবিনয়ে তারা সেটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলেছেন, এই দলটিকে আমি ভালবাসি। এই দলের আদর্শকে আমি ভালবাসি। তাই সেই আদর্শের জন্যই আমি দলটিতে আছি এবং যতটুকু সামর্থ্য আছে, সেই মোতাবেক দলে অবদান রাখছি। তাদেরকে বলা হয়েছে, সেই দলের বৃহত্তর স্বার্থেই তাদেরকে সিনিয়র পজিশনে যেতে হবে।
কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। নেতা বা পাতি নেতারা দলে সিনিয়র পজিশন না পেলে মারামারি করেন। যারা বড় বড় পদ পেয়েছে তাদের ওপর পদবঞ্চিতরা হামলা করেন। চেয়ার ভাঙাভাঙি করেন। আবার যারা পদ পেয়েছেন তারাও পদবঞ্চিতদের ওপর হামলা করেন। যারা পদ পেয়েছেন তারা পদ ধরে রাখার জন্য হামলা করেন, আর যারা পদবঞ্চিত তারা পদ পাওয়ার জন্য হামলা করেন। এক বিচিত্র রাজনীতির সন্মুখীন আমরা।
দুই
এতক্ষণ ধরে যেসব কথা বললাম তার সপক্ষে দুই একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বলা বাহুল্য, এসব উদাহরণ এরশাদের জাতীয় পার্টির। আর ছাপা হয়েছে দৈনিক ‘ইত্তেফাকে’। এই কলাবাগানে ১৪তলা বা ১৬তলা ভবনের মালিক একজন জাতীয় পার্টির নেতা। তিনি জাতীয় পার্টির একজন এমপিও বটে। তিনি নিজের কন্যাকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নমিনেশন দেওয়ার জন্য দলের হাই কমান্ডকে ৫ কোটি টাকা সেধে ছিলেন। ঐ এমপিটি বলেন, তার পরেও আমি আমার কন্যার জন্য এমপির নমিনেশন আদায় করতে পারিনি। কারণ অন্য কেউ হাই কমান্ডকে ৫ কোটি টাকারও বেশি দিয়েছে।
দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ মহিলা আসনে নমিনেশন দেওয়ার বেলায় ঘুষের টাকা লেনদেনের কদর্য কাহিনী দু’দিন ধরে বর্ণনা করেছে। এসম্পর্কে দৈনিক ‘ইত্তেফাকে’র ২ ও ৩ জুন প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে দুটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২ তারিখে দ্বিতীয় প্রধান খবরের শিরোনাম, ‘নারী এমপিদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছিল জাপা’। আর ৩ তারিখের দ্বিতীয় প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘চুক্তি করে নারী এমপিদের মনোনয়ন/ জাপায় তোলপাড়। অনেকেই বিব্রত।’ ২ তারিখের খবরে যাওয়ার আগে ইত্তেফাকের ৩ তারিখে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত কতগুলি উপ শিরোনাম দেখুন, ‘আমার মেয়েকে মনোনয়নের জন্য ৫ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলাম: ফিরোজ রশীদ/ জি এম কাদেরের নেতৃত্বে কমিটি সবকিছু নির্ধারণ করেছে: রাঙ্গা/ আরেক নারী এমপি রওশন আরা মান্নান বললেন: আমি আমার অঙ্গীকার পূরণ করে দিয়েছি।’
২ তারিখের খবরে বলা হয়েছে,‘অঙ্গীকার রক্ষা না করায় এমপি মাসুদা রশীদ চৌধুরীকে নোটিশ/ দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি লিখিত অঙ্গীকারের বিষয়টি স্যার ও কাদের মামাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন: রাঙ্গা। এতদিন এই দলটা করি, কোনোদিন এমপি হতে পারিনি, এবার এমপি হয়ে এসব কী দেখছি। বিষয়টা আমার ব্যারিস্টার ছেলেকে দেখতে বলেছি: মাসুদা রশীদ চৌধুরী।’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘অঙ্গীকার’ বাস্তবায়ন না করায় সংরক্ষিত আসনে দলের মহিলা এমপি অধ্যাপিকা মাসুদা এম রশীদ চৌধুরীকে নোটিশ পাঠিয়েছেন জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। অঙ্গীকার ভঙ্গ করায় কেন তাকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সকল পদ পদবি থেকে বহিষ্কার করা হবে না, ১০ দিনের মধ্যে তা লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছে মাসুদা রশীদ চৌধুরীকে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, মাসুদা রশীদ চৌধুরীকে গত ২০ মে ‘সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত) হওয়ার পর অঙ্গীকার ভঙ্গের নোটিশ প্রসঙ্গে’ বিষয় সংবলিত পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন রাঙ্গা। ইত্তেফাকের কাছে থাকা চিঠির কপিতে দেখা যায, এই চিঠি লেখার বিষয়ে জাপা মহাসচিব লিখেছেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে আপনাকে জানাচ্ছি’।
ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিষয়টি সম্পর্কে এই প্রতিবেদককে বিস্তারিত বলেন নোটিশদাতা মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেন, ‘সংরক্ষিত আসনে মহিলা এমপি হিসেবে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের কারো কারো সঙ্গে নির্বাচনের আগে দলের কিছু ছোটখাটো কমিটমেন্ট ছিল। এই ধরেন কেউ হয়তো অফিসকে এটা দেবে, কেউ ওইটা দেবে... এই আর কি। বিষয়টি স্যার (এরশাদ), কাদের মামা (জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের) এবং ওই মনোনয়নের সঙ্গে আমরা যেই আটজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম সবাই জানেন।’
রাঙ্গা আরো বলেন, ‘মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী এমপি হওয়ার পর অঙ্গীকার রাখেননি। আমি অনেকবার তাকে ফোন করেছি, তিনি ফোন ধরেন না। অনেকবার মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছি, তাও তিনি রেসপন্স করেননি। পরে একদিন আমি ওনার বাসায় যাই। তখনো ওনাকে অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। তখন উনি বললেন যে, তিনি গলব্লাডারের সমস্যায় ভুগছেন, সুস্থ হলে যা বকেয়া সেটা দিয়ে দেবেন।’
জাপার মহাসচিব বলেন, ‘এখন ঈদের সময়। দলের অনেক খরচ। দলের দুটি কার্যালয়ে স্টাফ আছেন ৫২ জনের মতো, তাদের বেতন-বোনাস মিলিয়ে প্রায় ১৬ লাখ টাকা লাগে। এরকম নানা খরচ রয়েছে।’
তিন
৩ জুন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় অত্যন্ত ফলাও করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, লিখিত দলিল করে শর্ত সাপেক্ষে মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনা রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের জন্য লজ্জার।
ঐ রিপোর্টে বলা হয়, গতকাল প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-৬ আসনের জাপা দলীয় সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘যখন সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল, তখন আমি ছিলাম সৌদিআরবে। সেখান থেকে দলের কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাকে ফোন করে বলেছিলাম, আমি পাঁচ কোটি টাকা দেব, আমার মেয়েকে মনোনয়ন দিন। বলেছিলাম, স্যার (এইচএম এরশাদ) অসুস্থ, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি দলের নামে নেই। যে চারজনকে মনোনয়ন দেওয়া হবে প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ কোটি করে ২০ কোটি টাকা দিয়ে সেটি পার্টির নামে দলিল করে সেখানে ‘এরশাদ ভবন’ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিন। তারা দুজন আমাকে বলেছিলেন ঠিক আছে। আমি এটাও বলেছিলাম, টাকাটা দলের ব্যাংক তহবিলে আমরা জমা দেব। দেশে ফিরেও তাদের দু’জনকে আমি একই কথা বলি। বলেছিলাম, পাঁচ কোটি টাকার কমে কিন্তু কাউকে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। আমার মেয়ে মনোনয়ন পেতে সাক্ষাতকারও দিয়েছিল। কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সেই কারণে আমি ধরে নিয়েছি, হয়তো আরও বেশি টাকার প্রার্থী পাওয়া গেছে বিধায় আমার মেয়ে মনোনয়ন পায়নি।’
সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য জাপার যে আটজনের সমন্বয়ে কমিটি করে দিয়েছিলেন দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, সেটির প্রধান ছিলেন দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের। অন্য সাতজন সদস্য ছিলেন- দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম কিবরিয়া টিপু, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি ও অ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম।
চার
এই দুটি রিপোর্টের পর এরশাদের জাতীয় পার্টি যে কী চিজ সেটি আর খুলে বলার অবকাশ রাখে না। সবক্ষেত্রেই কি আঁটি ভেঙে শাঁস দেওয়ার প্রয়োজন আছে? আমার ব্যক্তিগত মতে, জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দলের কোনো সংজ্ঞাতেই পড়ে না। জেনারেল এরশাদ প্রথম থেকেই ছিলেন একজন ক্ষমতা লিপ্সু সামরিক অফিসার। সুযোগ বুঝে জাস্টিস সাত্তার যখন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তখন বন্দুকের জোরে তার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন। পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। বাংলাদেশের যতো বসন্তের কোকিল রয়েছে সকলেই হালুয়া রুটির লোভে এরশাদের পার্টিতে এসে জড়ো হন। কিন্তু কতজনকে আর হালুয়া রুটি বিলানো সম্ভব? সবশেষে তো তারা হয়েছিল মৎস কন্যা। অর্ধেক মাছ আর অর্ধেক মানুষ। অর্থাৎ বেশি অর্ধেক সরকার আর কম অর্ধেক বিরোধী দল। এবার শেখ হাসিনা মন্ত্রিত্ব থেকেও তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন তারা না ঘরকা না ঘাটকা। অকূল পাথারে তারা হাবুডুবু খাচ্ছেন। দলটির বিলুপ্তি এখন সময়ের ব্যাপার।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।