পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বর্তমান বিশ্বের প্রধান ক্ষতিকর হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি। তারপর ক্ষতিকর জিনিষ হচ্ছে প্লাস্টিক, বিশেষ করে রিসাইকেল অনুপযোগী প্লাস্টিক। কারণ, এই প্লাস্টিক গলে না, পচে না- থেকে যায় অনন্তকাল পর্যন্ত। তাই বিশ্বের জল ও স্থলের সর্বত্রই মিশে গিয়ে মারাত্মক ক্ষতি সৃষ্টি করছে। এমনকি মানুষেরও। কারণ, খাদ্য চক্রের প্রক্রিয়ায় এই প্লাস্টিক মিশে যাচ্ছে, যা খেয়ে মানুষ ও প্রাণীকুল নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে এক মরা তিমি ভেসে উঠেছিল। তার পেট থেকে পাওয়া গিয়েছিল অনেক প্লাস্টিকের কণা। এরূপ অবস্থা জলজ সব প্রাণীকুলেরই, এমনকি মানুষেরও। তবুও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। বরং দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা ব্যাপকহারে। কারণ, প্লাস্টিক পণ্য দামে সস্তা, ওজনে হালকা এবং সহজে বহনযোগ্য যত্রতত্রই। তাই মানুষ ঘরে-বাইরের বহু কাজে এই পণ্য ব্যবহার করে। বিশেষ করে খাবারের পাত্র ও আসবাবপত্র। কিন্তু এসব যখনই নষ্ট হয়ে যায়,তখনই ফেলে দেওয়া হয়। যা কখনোই পচে না। মাটি ও পানিতে মিশে গিয়ে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করে। সর্বোপরি এর বিরাট অংশ পানিতে ভাসতে ভাসতে প্রথমে নদীতে,তারপর সাগরে পতিত হয়। বর্তমানে যার পরিমাণ ব্যাপক। দ্য গ্লোবাল অ্যালাইন্স ফর ইনসাইনারেটর অল্টারনেটিভস (জিএআইএ) এর মতে, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পতিত হয়। অপরদিকে, জাতি সংঘের মতে, ‘প্লাস্টিক বর্জ্য এখন মহামারীর রূপ নিয়েছে। মহাসাগরে অন্তত ১০ কোটি টন প্লাস্টিক পাওয়া যায়। যার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ভূমি উৎস থেকেই পতিত হয়’। স্মরণীয় যে, যেসব দেশ প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার কম করে, তারাও এর ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়না। কারণ, ধনী দেশগুলো তাদের প্লাষ্টিক বর্জ্য গরীব দেশগুলোতে রফতানি করে। চীন আগে এই পণ্য আমদানি করে রিসাইকেল করতো। কিন্তু তাদের উন্নতির সাথে সাথে তারা এই কাজটি ত্যাগ করেছে। ফলে ধনী দেশগুলো,বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের প্লাস্টিক বর্জ্য এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে রফতানি করছে। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া,থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়। ফলে এ দেশগুলো এখন প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগারে পরিণত হয়েছে ! তাতে কৃষি ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে হিমালয় পর্বতও রক্ষা পাচ্ছে না। তাই নেপাল সরকার সে বর্জ্য সরানোর চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে সিএনএন’র খবরে প্রকাশ, প্রতি বছর কয়েক শ’ মানুষ ও শেরপা এভারেস্ট জয়ের জন্য অভিযানে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অক্সিজেন সিলিন্ডার, টিনের পাত্র, প্লাস্টিক ব্যাগ, জিনিসপত্র, বিয়ারের বোতল ফেলে রেখে চলে আসেন তারা। তাই গত ১৪ এপ্রিল থেকে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে এভারেস্ট পরিষ্কারের অভিযান শুরু করেছে নেপাল প্রশাসন।
তাদের অভিযানে এখন পর্যন্ত পাঁচ টন ময়লা উদ্ধার হয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই শৃঙ্গ থেকে। এ ছাড়াও চারটি লাশ চিহ্নিত করেছে উদ্ধারকারী দল। ৮ মে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কেজি বর্জ্য পাওয়া গিয়েছে। আকাশপথে ওই আবর্জনা সরিয়ে আনা হয়েছে। আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই অভিযান শেষ হবে।
রিসাইকেল অনুপযোগী প্লাস্টিক মারাত্মক ক্ষতি করছে, তাই এর ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্যাপীই। এমনকি কোথাও কোথাও প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনও হচ্ছে। পরিবেশবিদ ও পরিবেশবাদীরা এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপরন্তু বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ এর ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করছে এবং নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। গত ১১ মে ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস- ২০১৯’ উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, ‘যেখানে সেখানে প্লাস্টিক পণ্য ফেলার কারণে সব জলজ প্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে’। তিনি আরও বলেন, ‘পানির বোতল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেটসহ উড়ে বেড়ানো প্লাস্টিকগুলো আমাদের অনেক ক্ষতি করে। এই বিষয়গুলোতে যদি আমরা সচেতন হই তাহলে ৭৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে দূরে থাকতে পারবো। একইসঙ্গে জলজ প্রাণীগুলোকে হুমকির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো। সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হওয়ার উপযোগী প্লাস্টিক উদ্ভাবনে কাজ করা জাপানি কোম্পানিগুলোকে সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে দেশটির সরকার।প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে সমুদ্র দূষণ একটি প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়ায় জাপান, জার্মানি এবং ইতালির কয়েকটি রাসায়নিক কোম্পানি বায়োডিগ্রেডেবল বা মাটি ও পানিতে মিশে যাওয়ার উপযোগী প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেছে।সমুদ্রের অণুজীবের এনজাইম বা জৈবরাসায়নিক পদার্থ নতুন ধরনের এই প্লাস্টিককে ভেঙ্গে প্রধানত পানি এবং কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিণত করে-জাপান বেতার। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যেমন: এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এ ব্যাপারে সম্প্রতি এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ৫২তম বার্ষিক সম্মেলনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব কটি সদস্য দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে বেশ কিছু নতুন প্রকল্প ও প্রকল্পের ব্যয় সংকুলানের জন্য ঋণ অনুমোদনের বাইরে প্রধান একটি দিক ছিল সমুদ্র-দূষণ এবং দূষণ মোকাবিলার পদক্ষেপের ওপর আলোকপাত। সমুদ্রের স্বাস্থ্য রক্ষার একটি কর্মপরিকল্পনার জন্য ৫০০ কোটি ডলার অনুমোদনের মধ্যে দিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পরিবেশ দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত চোখের আড়ালে থেকে যাওয়া এই সমস্যার দিকে নজর দিতে শুরু করেছে।’ এমনকি খোদ জাতি সংঘেও এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে গত ১০ মে। এ ব্যাপারে দ্য গার্ডিয়ানের খবরে প্রকাশ, বিশ্বের প্রায় সব দেশ দূষিত প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস করতে একটি আইনগত বাধ্যতামূলক কাঠামোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য যাতে গরিব রাষ্ট্রগুলোকে ময়লার স্তূপে পরিণত করতে না পারে সেজন্য চুক্তিটির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের প্রধান রফতানি-কারক যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ এতে স্বাক্ষর করেনি। এর আগে বিশ্ব জলবায়ু চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেনি যুক্তরাষ্ট্র। প্লাস্টিক বর্জ্য এবং বিষাক্ত ও বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের ওপর জাতিসংঘ সমর্থিত দুই সপ্তাহের বৈঠক শেষে প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাসের জন্য বাধ্যতামূলক চুক্তিটি অনুমোদিত হয়। বিপুল পরিমাণ বাতিল প্লাস্টিক পদার্থ সাগর, মহাসাগরে ভেসে বেড়ায়। এর প্রভাবে বন্য ও জলজ প্রাণীগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয়। জাতি সংঘর পরিবেশ কর্মসূচীর রোলফ পায়েট বলেন, ‘জাতিসংঘ সমর্থিত বাসেল কনভেনশনের ঐতিহাসিক চুক্তির সঙ্গে বিশ্বের ১৮৬টি দেশ সম্পর্কযুক্ত। দেশগুলোকে প্লাস্টিকের বর্জ্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও চিহ্নিত করতে হবে।তিনি আরও বলেন, এই চুক্তিটি স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি, মহাকাশ, ফ্যাশন এবং খাদ্য ও পানীয়র মতো বিস্তৃত শিল্পে ব্যবহৃত পণ্যগুলোকে প্রভাবিত করে। প্লাস্টিক বর্জ্য এখন মহামারীর রূপ নিয়েছে। মহাসাগরে অন্তত ১০ কোটি টন প্লাস্টিক পাওয়া যায়। যার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ভূমি উৎস থেকেই পতিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক বর্জ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গিয়ে জমা হচ্ছে। দ্য গ্লোবাল অ্যালাইন্স ফর ইনসাইনারেটর অল্টারনেটিভস জানায়, পরিস্থিতি এমন হচ্ছে যে, বছর শেষে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের গ্রামগুলো বর্জ্যস্তূপে পরিণত হচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানিতে নতুন নীতিমালা আগামী এক বছরের মধ্যে কার্যকর হতে যাচ্ছে। অপরদিকে, ভোয়ার খবর প্রকাশ, স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
প্লাস্টিক পণ্য যতই ক্ষতিকারক হোক না কেন, তা একেবারে বন্ধ করা দূরহ। কারণ, এই পণ্য খুবই সস্তা,হালকা,সহজে বহনযোগ্য এবং মানুষ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই এর ব্যবহার চলতেই থাকবে এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিই পাবে। সে সাথে ক্ষতিও বাড়তে থাকবে। কিন্তু সেই প্লাস্টিক পণ্য যদি রিসাইকেল উপযোগী হয়,তাহলে সেটা ক্ষতিকারক হবে না। কারণ, এই বর্জ্য রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। এভাবে চলতেই থাকবে। এর দ্বিতীয় উপকারিতা হচ্ছে এডিবি প্লাস্টিক পণ্যকে রিসাইকেল করার ক্ষেত্রে ৫শ’ কোটি ডলারের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এরপর হয়তো বিশ্ব ব্যাংক,আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাও এ ক্ষেত্রে সহায়তায় এগিয়ে আসবে। তাই রিসাইকেল অনুপযোগী প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে রিসাইকেলযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করতে হবে। এছাড়া, বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ও উৎপাদন করা দরকার। জাপানসহ কয়েকটি ধনী দেশ এ ক্ষেত্রে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অপরদিকে, প্লাস্টিকের বর্জ্যগুলো যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে নির্দিষ্ট-স্থানে জমা করে রাখা দরকার। যাতে রিসাইকেলকারী কারখানার জন্য সংগ্রহ করতে সহজ হয়। আর এটা হলে প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো মাটি ও পানির সাথে মিশে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। অপরদিকে,স¤প্রতি জাতি সংঘে সম্পাদিত প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে এবং যা আগামী বছর থেকে বাস্তবায়নযোগ্য,তা যে কোন মূল্যেই হোক না কেন, তা পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। এতে আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশ সন্মত না হলেও তা পালন করতে বাধ্য হবে তারা। কারণ,তাদের প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কোন দেশই গ্রহণ করবে না। ফলে তারা প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হ্রাস করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পন্ন হয়েছে। উপরন্তু প্রচুর পরিমাণে রফতানি করছে বিভিন্ন দেশে। এতে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং অনেক বৈদেশিক মুদ্রাও আয় হচ্ছে। এটা অব্যাহত রাখা দরকার। সে লক্ষ্যে রিসাইকেলযোগ্য বা বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করা আবশ্যক। কারণ, বাংলাদেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশও রিসাইকেল অনুপযোগী প্লাস্টিকের কারণে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়, আর যাওয়াও উচিৎ নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।