Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরবন রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

সুন্দরবন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবনের চির সবুজ সুদৃশ্য গহীন বনানীর পার্শ্বে সাগরের মাঝে স–র্যোদয় ও স–র্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। বিশালায়তনের সুন্দরবনে অসংখ্য বৃক্ষরাজির মাঝে বসবাস করে অসংখ্য প্রজাতির অগনিত প্রাণিকূল। এ বনে বাস করছে বর্তমান পৃথিবীর সব চেয়ে সম্পদশালী ও নামকরা বন্য প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

অত্যন্ত সৌন্দর্যমন্ডিত এ বনে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক ধন ভান্ডার। আর এখানকার ধন ভান্ডার সদ্ব্যব্যবহারের জন্য সুন্দর বনের মধ্যে জালের মত ছড়িয়ে আছে প্রায় চার শতাধিক ছোট-বড় নদী ও খাল।

সুন্দরবনের পর্যটন, চিত্ত বিনোদন এবং শিক্ষা অতি চিত্তাহর্ষক। বন বনানীর শোভাময়ী দৃশ্য, পাখির কলকাকলী, হরিণের ঝাঁক, গাছে গাছে বানরের ক্রীড়া কৌতুক, নদীর কিনারে সকাল বেলায় অলস কুমিরের ঘুমন্ত দশা, বাঘের ঘাপটি মেরে থাকা এবং জ্যান্ত প্রাণী শিকার করে ভক্ষণ করা, নদ-নদীতে জোয়ার ভাঁটার খেলা, দুবলার চরের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও রাস মেলার জনতার ঢল। গাছপালা ও প্রাণী স¤পদের নানারূপ বৈচিত্র, কটকা ও হিরণ পয়েন্টের সমুদ্র সৈকত ও অভয়ারণ্যে প্রাণিক‚লের অবাধে চলাফেরা সবই উপযুক্ত পর্যটন ও শিক্ষা বিনোদনের জন্য অতি সহায়ক উপকরণ।

সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার দক্ষিণ ভাগও সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনের অনুপাত মূলত ৬ঃ৪। বাংলাদেশের সুন্দরবন দক্ষিণ বঙ্গের তিনটি জেলা যথা- সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের দক্ষিণে ব্যাপক অঞ্চল নিয়ে ব্যাপৃত। এর উত্তরে সাতক্ষীরা জেলার শ্যাম নগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি, খুলনার কয়রা পাইকগাছা ও দাকোপ এবং বাগেরহাট জেলা মংলা, রামপাল, মড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা থানা অবস্থিত। পূর্বে পিরোজপুর জেলা মঠবাড়িয়া, ইন্দুরখানা, বরগুনার পাথরঘাটা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার দক্ষিণাঞ্চলীয় সুন্দরবন ভ‚মি।

সুন্দরবনের নামকরণের মূলে কয়েকটি ধারণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য (ক) এ বন দেখতে সুন্দর (খ) সমুদ্রের নিকটে অবস্থিত, সমুদ্র শব্দ হতে যার উৎপত্তি (গ) সুন্দরী গাছের আধিক্য অর্থাৎ সমগ্র অঞ্চল ব্যাপী সুন্দরীগাছ দেখা যায়। (ঘ) কথিত আছে ইংরেজ আমলের বহু পূর্বে বিদেশী পর্যটকেরা সুন্দরবন দেখে একে “জংগল অফ সানডে ট্রিজ” নামে অভিহিত করতেন।

“সুন্দরী” অর্থ নানা প্রকার। এ সুন্দরী শব্দ হতে জঙ্গলের নাম হয়েছে সুন্দরবন। (ঙ) বরিশালের সুন্দা নামক নদী আছে ও সুন্দারক‚লের বন বিভাগকে সুন্দারবন বলা হতো এবং কালক্রমে উক্ত নাম সুন্দরবনে পরিণত হয়েছে। নামকরণে সুন্দরী গাছের আধিক্য। এ মতবাদটি সর্বাধিক সমর্থন যোগ্য।

নিম্নবঙ্গের গঙ্গার বহুশাখা প্রশাখা বিস্তৃত লবণাক্ত পল্লবময় অসংখ্য বৃক্ষ গুল্ম সমাচ্ছাদিত শ্বাপদ সংকুল-ভ‚-ভাগ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে স¤পূর্ণ ব্যতিক্রম ধর্মী। এখানে দু’বেলা জোয়ার ভাটা চলে, তকতকে পেড়ি কাদা দিয়ে চর বেষ্টিত। নদী ভাঙ্গন নিত্যদিনের ঘটনা। সাথে সাথে নতুন চরও গড়ে উঠেছে। এখানকার ভ‚-ভাগ দেশের উত্তরাঞ্চলের চেয়ে কয়েক মিটার নীচু। জঙ্গলের অধিকাংশ স্থান নদী বা খালের দ্বারা বহু বিভাজ্য।

সুন্দরবনের উদি¢দ বড় বৈচিত্র্যময়। এখানে দু’বেলা জোয়ারে বন-বনানী পানিতে থৈ থৈ করে। সারা জঙ্গল যেন পানির উপর ভাসতে থাকে। তবুও চারা গাছের অংকুর উদগম ঘটে, ছোট গাছ বড় হয় এবং শেষ পর্যন্ত বেড়ে উঠে স^চ্ছন্দে। কতকগুলো প্রজাতির ফল-বীজ গাছে থাকা অবস্থায়ই অংকুর উদগম ঘটে এবং নরম মাটিতে ফলবীজ পতিত হয়ে আটকে যায় পরে নীচ থেকে শিকড় ও উপরের দিক থেকে পাতা গজিয়ে গাছের বৃদ্ধি শুরু হয়। সুন্দরবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গাছের প্রজাতি হলো সুন্দরী। এখানকার অন্যান্য প্রজাতির গাছ গুলো হলো- গেওয়া, গোলপাতা, গরান, বাইন, কাকরাম ভাতকাঠী, খলসি, কেওড়া, ওরা, পশুর, ধন্দুল হ্যাঁতল, আমুর কিরপা, শিংড়া, ঝানা, হুদো, ধানসি, বলা, হারগোজা, সুন্দরী তলা, নলখাগড়া প্রভৃতি। এসব কারণে সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে প্রকাশ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান এলাকার পরিবেশকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে- এ দিকে হাইকোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দাখিল করা প্রতিবেদনে জানানো হয় যে সুন্দরবনের আশ-পাশ এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মধ্যে ২৪ টি লাল চিহ্নিত।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমম্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার পর এ বিষয়ে জারি করা রুলের শুনানির জন্য প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলেছেন ৯ মে ২০১৮ শুনানির দিনও ধার্য করা হয়।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয় হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সুন্দরবন সংলগ্ন সংকটাপন্ন এলাকার বিদ্যমান শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকাসহ পূর্ণাঙ্গ তথ্যাদির বিবরন দাফতরিক নথি পর্যালোচনা ও সরেজমিনে পরিদর্শন কালে দেখা যায় খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় ৭৮ টি, খুলনা জেলায় ৯২টি এবং সাতক্ষীরায় ২০ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে অবশ্য ৪০টির মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে পরিবশেবাদীদের মতামত ব্যক্ত করেেছন।

উল্লেখ্য ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। পরিবেশ দূষণ যাতে ভয়াবহ রুপ নিতে না পারে এবং সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যে যাতে কোন রূপ নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে এ লক্ষ্য সামনে রেখে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা হিসাবে ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেষ্টের চারদিকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

এ বিষয়ে রিট আবেদনের পক্ষে ব্যারিষ্টার মো. জাকির হোসেন বলেন সরকার আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করে বলেছে যে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে ২৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাটি, পানি ও বায়ু দূষণকারী অর্থাৎ লাল শ্রেণির অর্ন্তভুক্ত। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান কোন ভাবেই সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে পারবেনা। পরিবশেগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (অ্যানভায়রনমেন্টাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) অর্ডিন্যান্স ১৯৯৯ অনুযায়ী প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার মধ্যে এ ধরণের শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকার সুযোগ নেই। এ ছাড়া বাকি যে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাব এর থেকেও বেশি।

রিট আবেদনটিতে বলা হয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুন্দরবনের সংরক্ষিত বন এলাকা এবং এর চার পাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন ্এলাকা ঘোষণা করে। এ প্রজ্ঞাপন অনুসারে, সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকায়, ভ’মি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। পরিবেশ অধিদফতর এরই মধ্যে প্রায় ১৫০ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প করার জন্য অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে যার মধ্যে জাহাজভাঙা শিল্পসহ পরিবেশ দূষণকারী প্রকল্প রয়েছে বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এসব শিল্প কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ ও পরিবেশ আইন ১৯৯৫-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তা ছাড়া এসব শিল্প কারখানা সুন্দরবনের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে রিটে দাবি করা হয়।

এদিকে সুন্দরবনের পাশেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ইতিমধ্যেই পরিবশেবাদীরা প্রতিবাদে সোচ্ছার হয়েছেন। পরিবেশ নিয়েই প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় থেকে আমিও গবেষণা ও লেখালেখি করে আসছি, পেয়েছি জাতীয় পুরষ্কারও। আমারও সরকার বরাবরে বিনীত আবেদন থাকলো দেশের পরিবেশ বিনষ্ট হয়, সুন্দরবন তথা সারা দেশের ক্ষতি হয় এমন কাজটি করতে সংশ্লিষ্ট মহল যেন বার বার চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে স্থাপনের পর যদি দেখা যায় আমাদের উপকার না হয়ে অপকার হয় তাহলে তা আগেভাগেই বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। পরিবশেবাদীদের দাবীর প্রতি সরকারের বিশেষ বিবেচনার অনুরোধ আমার পক্ষ থেকেও থাকলো।

এছাড়া মাত্র ক‘বছর আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বাঘ দেখা যেত হরহামেশাই। ইদানিং সুন্দরবন ছাড়া কোথাও বাঘের আনাগোনা নেই। বিভিন্ন সুত্রে জানা যায় বন রক্ষকদের অবহেলা আর দূর্ণীতির কারণে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। বাঘ শিকারীরা বাঘ নিধনে তৎপর কিন্তু যারা নিধন করছে তাদেরকে সামাল দেয়া যাদের কর্তব্য, তারা নিরব। এদিকে বনভুমি সংকুচিত হওয়ার ফলে পরিবেশগত কারণে এবং খাদ্যাভাবে দিনে দিনে বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। আমরা পত্র-পত্রিকায় প্রায় দেখি আমাদের মাননীয় মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকতারা দেশে যতটা বাঘ আছে বলে জানান দিয়ে থাকেন বাস্তবের সাথে তার মোঠেই মিল নেই। উল্লেখ্য দিনে দিনে সারা দেশেই বনভমি সংকুচিত হচ্ছে আর এর সঙ্গে বাঘসহ সকল বনজ প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সোজা ও সরল ভাষায় বলতে হয় আমাদেরকে অবশ্যই বাঘসহ সকল প্রকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষনে আন্তরিকতার সাথে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের এমন ভাবে কথা বলতে হবে, কাজ করতে হবে যাতে কথা ও কাজে মিল থাকে। আমরা এখনই তৎপর না হলে অথবা রক্ষককে সততার পরিচয় না দিলে পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সচেতন করা না হলে একদিন হয়ত বাঘ নামক হিংস্র হলেও প্রিয় এ জন্তুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ব্যপারে আর বিলম্ব করা মোঠেই ঠিক হবেনা।

উল্লেখ্য সারা বিশ্বে বছরে সমুদ্রতল বাড়ছে দুই মিলিমিটার করে। কিন্তু সুন্দরবনের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির মাত্রা অনেক বেশি। সুন্দরবন অঞ্চলের দ্বীপের মানুষের মনে দেখা দিয়েছে মৃত্যুভয়। জানা যায় ইতিমধ্যে সুন্দরবনের মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছে বেশ ক’টি ছোট্ট দ্বীপ। ক’লক্ষ হেক্টরের সমুদ্র তীরবর্তী বদ্বীপ অঞ্চল সুন্দরবন ভারত আর বাংলাদেশের যৌথ সম্পত্তি। এই অঞ্চলটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান। ইতিহাস প্রমাণ দেয় ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ অঞ্চলে মানুষের অনুপ্রবেশ ও বসবাস ঘটেছে। আজও সুন্দরবনের মাটি খুঁড়লে প্রাচীন মানব সভ্যতার অংশবিশেষের অস্তিত্ব মিলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় থেকেই (১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) এ অঞ্চলে বসবাসের তাগিদে মানুষ তৎপর হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সুন্দরবনের অংশ দ্বীপের মধ্যে মানুষ নিজেদের বাড়িঘর বানিয়ে বসবাস করছে। সুতরাং এখানকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ নিদারুণভাবে মানুষের দ্বারা বিনষ্ট ও নিজস্ব বাস্ততন্ত্রের কাজকর্ম বিঘিœত হয়েছে। ফলস্বরূপ প্রকৃতিও বহুবার এ অঞ্চলে আঘাত হেনেছে এবং ভবিষ্যতেও হানবে এ কথা অনস্বীকার্য।

আমাদের কাজকর্মে প্রকৃতির সঙ্গে এই সংঘাত আমরা যদি বাড়িয়ে চলি তবে আমাদের পরাজয় ঠেকানো অসম্ভব, কেন-না প্রকৃতির সঙ্গে কোনও যুদ্ধেই এ যাবৎকাল মানুষ জয়ী হতে পারেনি। এই রকম মনোভাব থেকে গত তিন-চার দশক ধরে সুন্দরবনের মনুষ্য বসবাসকারী অংশে সরকারি উদ্যোগে বিপর্যয়ের পর ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সঙ্গে পরিবেশ বান্ধব কিছু কাজকর্ম শুরু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা মিলিয়ে করা হয়নি।

সুন্দরবনের বদ্বীপ অঞ্চল কৃষিক্ষেত্র উর্বর পলিমাটিতে তৈরি, যদিও মাটিতে নোনাভাবের প্রভাব কৃষিকাজের প্রতিবন্ধক। এই বাধাগুলো মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা দূর করার চেষ্টা করছে। সরকারিভাবে অবশ্য এ নিয়ে খুব বড়ো প্রকল্প বা সহায়তার কথা শোনা যায়নি। অথচ বহু প্রকল্পে সরকারি তরফে গবেষণা হয়েছে এবং তার অনেকগুলো নিদানের প্রয়োগও খুব সহজভাবেই সেখানে করা যায়। যেমন অগভীর পুকুর খুঁড়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, কৃষিভূমির সামগ্রিক উচ্চতা বাড়িয়ে তাতে চাষ করা। এ ছাড়া মাটির নীচের কৈশিক পানির চলন নিয়ন্ত্রণ করে মাটির নোনাভাব দূরীকরণ। আবার পরিবেশবান্ধব কিছু রাসায়নিক ব্যবহার করে মাটির নোনাভাব দূরীকরণ ইত্যাদি। এ ব্যবস্থাগুলোর বর্তমান অবস্থায় থাকা সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। কিন্তু সুন্দরবন প্রকৃতপক্ষে সমুদ্রের জোয়ার-ভাঁটার উপর বেঁচে থাকা বদ্বীপ-অঞ্চল, যা দিনে দু’বার সমুদ্রের জোয়ার ও ভাঁটার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই বিষয়টিই সুন্দরবনের টিকে থাকার ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। কেন-না বিশ্ব উষ্ণায়ন সমুদ্রকে স্ফীত করে তুলছে এবং এই উচ্চ পানিতল সমুদ্রতল থেকে মাত্র ৩০ ফুট উঁচু সুন্দরবনকে নিমজ্জিত করার প্রয়াসে অনায়াসেই সফল হতে পারবে। কেন-না সারা বিশ্বে প্রতিবছর সমুদ্রতল ২ মিমি করে বেড়ে চলছে, আর সুন্দরবনের অংশে প্রতিবছর ৩.১৪ মিমি করে বাড়ছে। এইভাবে চললে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সুন্দরবনের অধিকাংশ অংশই পানির তলায় তলিয়ে যাবে। এসব চিন্তা-ভাবনা থেকে আমরা যদি এখনই কিছু করতে শুরু না-করি তবে বিপর্যয় তীব্র হবে, সাধারণ মানুষের হয়রানি বাড়বে এবং ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের চাপে মূল ভূখন্ডের মানুষেরও সমস্যা হবে। কেন-না জনগণনা থেকে দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপে প্রচুর মানুষের বসবাস। সেই অঞ্চলটি ভীষণভাবে নিমজ্জমান ও ভূমিক্ষয় প্রভাবিত অঞ্চল। এ অঞ্চলের সাগর আগামী দশ বছরে তলিয়ে যেতে পারে। প্রমাণস্বরূপ ইতিমধ্যে বেশ ক’টি দ্বীপ সাগরে হারিয়ে গেছে সুন্দরবনের মানচিত্র থেকে। ১৯৬৯ সাল থেকে ২০০১ সাল অবধি সময়কালে এখানে আমরা হারিয়েছি ১৫০ বর্গকিমি অঞ্চল যদিও কিছুটা আমরা ফিরেও পেয়েছি, তবে তা মনুষ্য বসবাসের যোগ্য এখনও হয়নি। সুতরাং নিমজ্জমান এখানকার ভয়ঙ্কর সমস্যা।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা আগামী দশ বছরে এই অঞ্চলের মানুষগুলো হয়ে যাবেন শরণার্থী। বিশ্ব-উষ্ণায়নের শরণার্থী। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের উদাহরণ হিসাবে পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়টি বিশ্বে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংযোজিত হবে। এখনই এ অঞ্চলের মানুষের মূল ভূখন্ডে কাজ খুঁজতে আর আশ্রয়ের তাগিদে চলে আসা দেখলে আন্দাজ করা যায় বিষয়টির অনিবার্যতা আর নিশ্চিত গুরুত্ব। ক’টি দ্বীপ ছাড়া মানুষের বসবাসের নূন্যতম সুবিধা নেই। নেই স্বাস্থ্য, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বিদ্যুৎ সংযোগ, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ বা চিত্ত বিনোদনের স্থান। সরকারকে এসব অঞ্চলের জন্য গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। যেমন মূল ভূখন্ড সংলগ্ন দ্বীপগুলোকে সরাসরি রাস্তার মাধ্যমে যোগাযোগ বা ব্রিজের মাধ্যমে সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অন্যান্য দ্বীপ থেকে এই শরণার্থী মানুষগুলোকে আশ্রয় ও তাদের জীবন বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। পরিবর্তে সরকার তাদের বসত জমিসহ সমস্ত দ্বীপ ফেরত পেতেন। এতে করে সুন্দরবনের সর্বত্র উন্নয়ন করার মতো অসম্ভব অলীক ভাবনার বাস্তবায়নের প্রয়াস নিতে হত না। গড়ে উঠত প্রাকৃতিক পরিবেশের সুন্দরবন, তার জীবসম্পদ। আর ট্যুরিজম থেকে আয় হত আরও রাজস্ব। দ্বীপভূমির বনজ সম্পদ, কৃষিজ উৎপাদন ও জৈববৈচিত্র বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চয় এনে দিত, যা কিনা সরকারি উন্নয়নের ব্যয়ের চেয়েও অনেক বেশি হত বলে গভীরভাবে বিশ্বাস করি যুক্তি মেনেই।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন