পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দুই প্রতিবেশী দেশ চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস বহু পুরনো। ষোড়শ শতকেরও আগেকার সময় থেকে এই দুই দেশের মধ্যে চলমান সম্পর্কের ইতিহাসের কথা জানতে পারা যায়। তখন চীন ও রাশিয়া সাইবেরিয়ার দুই বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত ছিল। ১৬৪০ সাল নাগাদ রাশিয়ার জনগণ রাশিয়ার দূরপ্রাচ্য ও চীনের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে চলা বিশ্বের দশম বৃহত্তম নদী, আমুর নদীর দুই পাড় ঘেঁষে বসতি স্থাপন করে।
মূলত তখন থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে। ১৬৫২ থেকে ১৬৮৯ সাল পর্যন্ত চীনা সেনাবাহিনী তাদেরকে সেখান থেকে উৎখাত করে। পরবর্তীতে সে বছরেই (১৬৮৯ সালে) তাদের মধ্যে এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর দুই শতকেরও বেশি সময় পরে জনতার উত্তেজনা বিপ্লবে রূপ নিলে চীনে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়। উল্লেখ্য যে, চীন-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সিনো-রাশিয়ান সম্পর্ক (Sino-Russian Relationship) নামেও পরিচিত।
এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার শুরুতেই আসে এদের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা। এই সম্পর্কের মূল বিষয় হচ্ছে তাদের মধ্যকার বাণিজ্যে অসমতা। ২০১৭ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে পরিমাণ শক্তি সম্পদের আদান-প্রদান হয়েছে, তার মধ্যে ৬০ ভাগের বেশি অংশ রপ্তানি করেছে রাশিয়া। ২০১৭ সালে তাদের মধ্যকার এই লেনদেন শতকরা ২০ শতাংশ বেড়েছে আগের তুলনায়, যা অর্থমূল্যে ৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। ২০১৭ সালে চীনে সর্বাধিক পরিমাণে অপরিশোধিত তেল রপ্তানিকারক দেশের নাম রাশিয়া। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, এর পরিমাণ ৬০ মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের তুলনায় শতকরা ১৪ ভাগ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক বছরে এই রপ্তানির পরিমাণ আরো বাড়বে। চার বছর আগে গ্যাস রপ্তানি সংক্রান্ত ৩০ বছর মেয়াদী এক চুক্তি তাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। চীন-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসে এই চুক্তিকে শতাব্দীর সেরা চুক্তি বলে অভিহিত করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার পরেই আসে তাদের মধ্যকার শক্তি সম্পদ কেন্দ্রিক সম্পর্কের কথা। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে চীন ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তাদের পার¯পরিক সহযোগিতার আলোকে চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের অভিন্ন ভ‚রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান সমানভাবে বিবেচ্য। চীনের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে যেখানে বিদ্যমান শক্তি সম্পদের দ্রুত চাপ বাড়ছে এবং ফলশ্রুতিতে আমদানির চাহিদা বাড়ছে, সেখানে রাশিয়ার অর্থনীতিতে শক্তি সম্পদ রপ্তানির উপর সব সময় বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। ১৯৯৩ সালে তেল আমদানিকারক দেশ হিসেবে নাম লেখানো চীন মাত্র আঠারো বছরের মাথায় ২০১১ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তেল ব্যবহারকারী দেশে পরিণত হয়। সাম্প্রতিককালে চীনে তেলের চাহিদা কী হারে বেড়েছে ও বাড়ছে, তা এই একটি পরিসংখ্যান থেকেই ¯পষ্ট হয়।
চীন-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাদের সামরিক স¤পর্ক। আশির দশকে যখন এই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হতে থাকে, মূলত তখন থেকেই তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূচনা হয়। ১৯৯১ সালে চীনের তিয়েনমেন স্কয়ারে সংঘটিত হত্যাকান্ডে রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ১৯৯৬ সালে সীমান্ত হত্যা বন্ধ সংক্রান্ত এক চুক্তি এই দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত হয়। ১৯৯২ সালে আন্তঃসরকার সহযোগিতা কমিশনের অধীনে সামরিক ও কৌশলগত সহযোগিতা কমিশন গড়ে তোলা হয়। এই কমিশন দুই দেশের মধ্যকার চলমান সামরিক সম্পর্ক জোরদারে জোরালো ভ‚মিকা পালন করে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্জেই সরজুর দেয়া এক তথ্যমতে, ১৯৮১ সালের পর থেকে চীনে এ যাবতকালে মোট প্রায় তিন লক্ষ রাশিয়ান সৈন্য, এক হাজারের উপরে যুদ্ধবিমান, ৩৬০০০ ট্যাংক ও ৮০টি যুদ্ধজাহাজ চীনের সামরিক বহরে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন যাবত এই দুই দেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সামরিক প্রশিক্ষণে ৩২০০ চীনা সৈন্য অংশ নেয়।
তবে ইদানীং চীন নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্ত্র উৎপাদনের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে, যদিও জেট বিমানের মতো ভারী অস্ত্রশস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে এখনো তাকে রাশিয়ার শরনাপন্ন হতে হয়। বিশ্বের অস্ত্রবাজারে উদীয়মান অস্ত্রনির্মাতা দেশ হিসেবে চীনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। এক্ষেত্রে নিজেরা পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করতে না পারলেও যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের মতো ভারী অস্ত্র এখন চীনেই তৈরি হচ্ছে। এমন অর্জন প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া অঞ্চলে তাদেরকে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ভূ-রাজনৈতিক স¤পর্ক এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। নিজেদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে একে অপরের কাছে তারা কৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টি এ দুই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকেও অনেকাংশে প্রভাবিত করে থাকে। অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় চীন ও রাশিয়ার অন্যতম নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বীর নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই দেশের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা কতোটা জোরালো, তা আলাদা করে বলাই বাহুল্য। এশিয়াসহ বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। কেন্দ্রীয় ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রভাব যাতে কমানো যায়, সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে চীন ও রাশিয়া বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগ থেকে একত্রে কাজ করে আসছে।
যেকোনো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বেলায় তাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক একটি বড় জায়গা দখল করে থাকে। চীন-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায় না। সম্প্রতি পরিচালিত এক প্রত্মতাত্তি¡ক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, চীন-রাশিয়ার সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ইতিহাস তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসের চাইতেও ঢের পুরনো। প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে তাদের মধ্যে অপ্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় এ গবেষণার মধ্য দিয়ে। দশম শতাব্দীতে কেন্দ্রীয় এশিয়ার ব্যবসায়ীরা চীনা সিল্ক রাশিয়াতে রপ্তানি করতেন বলে জানা যায়।
তবে বর্তমান সময়ে তাদের অন্যান্য সম্পর্ক অত্যন্ত জোরদার হলেও সাংস্কৃতিক স¤পর্কের ক্ষেত্রে সে দাবি জোর গলায় করা যায় না। তাদের মধ্যে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক চর্চার আদান-প্রদান প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। রুশ ভাষায় অনুবাদকৃত কোনো চীনা সাহিত্য খুব একটা পাওয়া যায় না।
রাশিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো কোনো সাংস্কৃতিক উৎসব ১৯৯১ সালের পর চীনে হয়নি আর। এমন পরিস্থিতি দুই দেশের তরুণ প্রজন্মের পার¯পরিক বোঝাপড়া ও সাংস্কৃতিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।
পরিশেষে বলা যায়, চীন-রাশিয়ার মধ্যে সার্বিক দিক দিয়ে সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও তা মূলত প্রয়োজনের সম্পর্ক, স্বার্থের সম্পর্ক। ফিনান্সিয়াল টাইম এর মতো জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ সম্পর্ককে ‘Friendship with benefits’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এদের পার¯পরিক সম্পর্ক এখন কেমন যাচ্ছে, সে প্রসঙ্গে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে চীনা প্রবাসীমন্ত্রীর সিএনএন-কে দেয়া এক বক্তব্য স্মরণযোগ্য। সেখানে তিনি বলেন, ‘স্মরণকালের ইতিহাসে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক এখন সবচেয়ে সুন্দরতম সময় পার করছে।’
এক কথায় বলতে গেলে, চীনের সাথে বিদ্যমান সম্পর্ককে রাশিয়ার সরকার পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বিদ্যমান সম্পর্কের চাইতেও বেশি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে এখন। পাশাপাশি, এশিয়াসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেক কিছুই এখন এ দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।