পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঈদুল ফিতরের উৎসব। সুদীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ যে উৎসব পালন করে তার নাম ‘ঈদুল ফিতর’। শাওয়ালের নতুন চাঁদ পশ্চিমাকাশে উঁকি দিলেই সবার মুখে মুখে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, রেডিও-টেলিভিশনে, পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে সর্বত্র ঘোষিত হতে থাকে মহাখুশির বার্তা ‘ঈদ মোবারক’।
এ উৎসবে মুসলমানদের মাঝে বইতে থাকে আনন্দের স্রোতধারা। মুসলিম বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠে উচ্চারিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় ইসলামী সংগীত- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ...।’
মুসলিম জাতির ধর্মীয়, জাতীয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব হলো ‘ঈদ’। ঈদ মানে আনন্দ, হাসি-খুশির উৎসব। এটি এমন একটি উৎসব- যা ফিরে ফিরে আসে। প্রতি বছর দু’টি ঈদ আসে মুসলিম উম্মাহের ঘরে ঘরে। সিয়াম সাধনার মাস রমজানের পর শাওয়ালের প্রথম তারিখ ‘ঈদুল ফিতর’ আর হজের মাস জিলহজের ১০ম তারিখ উদযাপিত হয় ‘ঈদুল আজহা’। প্রতিটি ঈদ নিয়ে আসে মুসলমানদের মাঝে আনন্দের ফাল্গুধারা। ভ্রাতৃত্ব, শান্তি-সম্প্রীতি ও সংহতির বার্তা।
জাহেলিয়াতের যুগেও উৎসব পালন করা হতো। এসব উৎসবে লোকেরা মদ্যপান, কৌতুক, হাস্যরস ও সুন্দরী নারী ভোগসহ নানারকম অসামাজিক কার্যকলাপে ব্যস্ত থাকতো। বিশ্বনবী (সা.) এ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রবর্তন করলেন সামাজিক, মানবিক ও ভ্রাতৃত্বের উৎসব ‘ঈদ’। এ উৎসবে উম্মতে মুহাম্মাদী ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করে আনন্দের পাশাপাশি মহান আল্লাহ তা’লার সান্নিধ্য লাভ করে। আমাদের নবী (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন- তখন মাদিনাবাসীর মধ্যে বিশেষ দু’টি দিবস পালিত হতো। এতে তারা খেলাধুলা আনন্দ-ফূর্তি করতো। রাসূল (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- এ দু’টি দিনের তাৎপর্য কী? মাদিনাবাসী উত্তর দিল, আমরা জাহেলি যুগ থেকে এ দু’দিনে খেলাধুলা করে আসছি। তখন রাসূলে করীম (সা.) বললেন- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দু’দিনের পরিবর্তে এর চেয়েও উত্তম দু’টি দিন তোমাদেরকে দান করেছেন। আর সেই দু’টি দিন হলো- ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর। (আবূ দাউদ, নাসাঈ)
মুসলমানরা ঈদুল আযহায় প্রিয়বস্তু কোরবানী দিয়ে তাক্বওয়ার পরিচয় দেয়। আর ঈদুল ফিতরে রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পুরস্কার লাভ করে এবং আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। সদকাতুল ফিতির আদায় করে গরিবের মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ধনী-গরিব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে। সবাইকে মনে করিয়ে দেয়- সম্প্রীতি, সংহতি আর সাম্যের প্রতীক হলো ‘ঈদ’। ঈদের জামাত শেষে মুসলমানরা একে অপরের গায়ে বুক মিলিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘ঈদ মোবারক’।
এ উৎসবকে আনন্দময় করে তুলতে সবাই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। ছোট-বড় ধনী-দরিদ্র সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বিত্তবানরা ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই ঈদের শপিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। নিম্ন আয়ের মানুষরাও বাদ যায় না; সবাই নিজের মতো করে ঈদের কেনাকাটা করে। অতিগরিবরাও যাতে এই উৎসবকে আনন্দের সাথে উদযাপন করতে পারে সেজন্য ধনীদের উপর গরিবের হক সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করা হয়েছে। ধনীরা ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগেই তা পরিশোধ করে ধর্মীয় বিধান পালন করে।
আমাদের চারপাশে এমন কিছু মানুষ আছে- যাদের জন্য ঈদের দিনটিও আনন্দময় হয়ে ওঠে না। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জীবন যাদের জর্জরিত। নতুন পোশাক কেনা দূরে থাক, পুরানো কোনো ভালো পোশাকই যাদের নেই। প্রতিদিনের অন্নের প্রয়োজনীয় যোগানও যাদের নেই। এসব পরিবারের বড়রা চোখের পানি লুকিয়ে হাসতে পারলেও ছোট্ট ছেলে-মেয়েগুলির কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের পাশে দাঁড়ানো মানবতার দাবি এবং ধর্মীয় বিধান। এ বিধানের কথা বিবেচনা করে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ/ তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে-লিল্লাহ/ দে জাকাত মুর্দা মুসলিমে আজ ভাঙাইতে নিদ।’
ঠিকমত ফিতরা ও যাকাত আদায় করা হলে অসহায় দরিদ্ররাও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। সমাজে নেমে আসবে শান্তি-সুখের ফল্গুধারা। কবি গোলাম মোস্তফা ঈদকে মানবতার বিরাট উপলক্ষ হিসেবে চিন্তা করেছেন। তিনি তাঁর কবিতায় লিখেছেন- ‘কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম-বাণী, বক্ষে ভরা তার শান্তি/ চক্ষে করুণার স্নিগ্ধ জ্যোতি ভার, বিশ্ব-বিমোহন কান্তি/ প্রীতি ও মিলনের মধুর দৃশ্যে/ এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে/ দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার বিয়োগ-বেদনার শ্রান্তি।
হররোজ পত্রিকার পাতায় দেখা যাচ্ছে- ‘কৃষকের ঘরে নেই ঈদের আনন্দ’। এবারের ঈদ এসেছে এমন এক সময়- যখন বাংলার মাঠে মাঠে সোনালি ফসলের বাম্পার ফলন হওয়ার পরেও কৃষক পাড়ায় হাহাকার। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শতকষ্টে ফলানো ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না- তাদের ঘরে কি ঈদের আনন্দের ছোঁয়া লাগবে? জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসব হতদরিদ্র কৃষকের ঈদ সম্পর্কে কবিতায় লিখেছেন- ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
ঈদ সবার জন্য। সবার ঈদ যাতে আনন্দময় হয়ে ওঠে- তাই ধনীরা ঈদের আনন্দকে গরিব, এতিম, ছিন্নমূল, গৃহহীন পথশিশু ভাই-বোনদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। দানশীলতা একটি মহৎ গুণ- তাই ধনীরা ঈদের দিনে সমাজের গরিব, এতিম, অসহায়দেরকে মুক্ত হস্তে দান করে তাদের মুখে হাসি ফুটায়।
দরিদ্র অসহায়দের মুখে হাসি ফুটানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’লার পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার লাভের সুযোগ রয়েছে। ধনীরা যদি ঈদের কেনাকাটার সময় গরিব, এতিম,
ছিন্নমূল, অসহায়দের জন্য কিছু জামা-কাপড় ক্রয় করে, একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে তাহলে তাদের ঈদটাও আনন্দময় হয়ে উঠবে। তাদের মুখে ফুটে উঠবে আনন্দের হাসি। আর ধনীরা হাসবেন তৃপ্তির হাসি। এতে মহান আল্লাহ তা’লা খুশি হবেন। এর বিনিময়ে তিনি জান্নাতে বিশেষ নেয়ামত দান করবেন।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে, আল্লাহ তা’লা তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন। যে ব্যক্তি কোনো তৃষ্ণার্তকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তা’লা জান্নাতে তাকে শরবত পান করাবেন। যে ব্যক্তি কোনো দরিদ্রকে পোশাক দান করে, আল্লাহ তা’লা তাকে জান্নাতে উত্তম পোশাক দান করবেন।’ (তিরমিজি)
আমাদের আদর্শ রাসূলুল্লাহ (সা.) শিশুদেরকে খুবই ভালোবাসতেন। সর্বদা তাদের মুখে হাসি ফুটাতেন। রাসুল (সা.) শিশুদেরকে কী পরিমাণ ভালোবাসতেন তা নিম্নের হাদিস থেকে একটু অনুধাবন করা যায়। একবার তিনি ঈদেগাহে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, পথের ধারে একটি শিশু কাঁদছে। তিনি শিশুটিকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে শিশুটি বলল, ‘আমার বাবা-মা নেই, আমি এতিম; আজ এই ঈদের দিনে আমার নতুন জামাকাপড়ও নেই।’ রাসুল (সা.) শিশুটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। হজরত আয়েশা (রা.)-কে বললেন, ‘তোমার জন্য একটি ছেলে এনেছি। একে গোসল করিয়ে ভালো পোশাক পরাও।’ রাসূল (সা.) শিশুটিকে বললেন, ‘আজ থেকে আয়েশা তোমার মা, ফাতিমা তোমার বোন, আমি তোমার বাবা।’ রাসূল (সা.) এভাবেই শিশুটির মুখে হাসি ফুটালেন।
আমরাও চাইলে নিজেদের আশপাশের অসংখ্য অসহায় এতিম-দুঃস্থ-অসহায়দের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারি। ভালোবেসে বুকে টেনে নিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারি। যে ব্যক্তি ঈদের আনন্দকে সবার সাথে ভাগাভাগি করতে পারে সেই ধন্য। কবির ভাষায়- ‘ঈদের আনন্দ যে ভাগ করে নেয়, সেই জন আসলেই ধন্য।’ ঈদ এমন একটি উৎসব যা- ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং পর¯পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়।
সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসবে মহান আল্লাহ তা’লার দরবারে আমাদের প্রার্থনা হলো- জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। ঈদের শিক্ষায় পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানি রক্তপাত থেকে মুক্ত হোক। সবার হৃদয়ে জাগ্রত হোক মানবিকতা, দয়ামায়া ও সহনশীলতা। দূর হোক সন্ত্রাসের বিভীষিকা। ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। সবাই একসাথে গেয়ে উঠুক কোনো এক বিখ্যাত কবির ভাষায়- ‘আজ আনন্দ প্রতি প্রাণে প্রাণে/ দুলছে খুশির নদী প্লাবনে/ ঘরে ঘরে জনে জনে/ আজি মুখর হবো মোরা গানে গানে।’
ঈদ উৎসব হোক সবার জন্য। মহা উৎসবে আনন্দ ছড়িয়ে পড়–ক সবার মনে-প্রাণে। আসুন! কুলাকুলি করে সবাই সবার হয়ে যাই। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন। ‘ঈদ মোবারক।’
লেখক: শিক্ষক ও প্রবন্ধকার
Email:[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।