পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বাস্তবতা শত বছর আগে পশ্চিমা উপনিবেশবাদিদের মধ্যকার সমঝোতা ও গোপণ চুক্তি ও নীল নকশার ফল। ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র আরেকবার বদলে ফেলার পশ্চিমা ষড়যন্ত্র নতুন মাত্রা লাভ করে। সেই ষড়যন্ত্রের প্রথম কথাই হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোনো রাষ্ট্রশক্তির অস্তিত্ব থাকবে না যে কিনা ভবিষ্যতে ইসরাইলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের এই নীল নকশার প্রথম শিকার হয় সাদ্দাম হোসেনের ইরাক। ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমানবিক প্রকল্পের রি-অ্যাক্টরে বিমান হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেয় ইসরাইল। এরপর আট বছরব্যাপী ইরাক-ইরান ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দুই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ওআইসি, আরবলীগ বা জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সহজেই যুদ্ধবিরতি, আলোচনা ও শান্তিচুক্তির সম্ভাবনাকে পশ্চিমারা বারবার নস্যাৎ করে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। সে যুদ্ধে ইসরাইলসহ পশ্চিমাশক্তি এবং তাদের আঞ্চলিক বশংবদ রাজশক্তিগুলো ইরাককে অস্ত্র ও অর্থের যোগান দিয়ে যুদ্ধকে প্রলম্বিত করেছে। ধার করা অস্ত্রে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে সাদ্দাম হোসেনের সরকার বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়লে তার মাথায় কুয়েত দখলের প্ররোচনা দিয়েছিল পশ্চিমারাই। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের আগে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ চলছিল সে সময় ২৫ জুলাই বাগদাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্লাসপি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করে কুয়েতের সাথে সীমান্ত বিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মতামত নেই বলে জানিয়ে দিয়ে পরোক্ষভাবে কুয়েত দখলের প্রক্রিয়াকেই সমর্থন জানান। তবে ২ আগস্ট কুয়েত দখলের পর মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইরাকে সামরিক হামলার ঘোষনা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক-ইরান যুদ্ধব্যয় বহন করতে গিয়ে বৈদেশিক ঋণভারে জর্জরিত ইরাককে কুয়েতের প্রধান তেলক্ষেত্রগুলো দখলের প্ররোচনা দিয়ে মূলত ইরাকে সামরিক হামলা চালিয়ে দেশটিকে দুর্বল ও ধ্বংস করে দেয়াই ছিল পশ্চিমাদের টার্গেট। ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইরান ও ইরাকের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যবোধ ও সম্প্রীতির বন্ধন থাকায় পশ্চিমারা প্রথমে ইরাককে দুর্বল ও দখল করে ইরানের উপর চুড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা করেছিল। তবে ইরানি জনগনের ঐক্য, আত্মনির্ভরতা অর্জনে অধ্যাবসায়ী ত্যাগী মনোভাব তাদেরকে অন্যতম আঞ্চলিক শক্তিতে পরিনত করেছে। দশকের পর দশক ধরে ইরানের উপর পশ্চিমা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার পরও নানা ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি পশ্চিমাদের বিষ্মিত ও বিচলিত করেছে। ফিলিস্তিন, আল-আকসা ও জেরুজালেমেরই উপর ইসরাইলী দখলদারিত্ব গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকলেও এই ইস্যুতে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করতে অবিরাম অনৈক্য ও সংঘাতের জুজু সৃষ্টি করছে পশ্চিমারাই। ইরান-ইরাক যুদ্ধ ছিল ইরানকে ধ্বংসের প্রথম টেস্ট কেস। ইতিপূর্বে ১৯৬৭ সালে ইয়াম কাপুরের যুদ্ধে ইসরাইল পবিত্র জেরুজালেম নগরী দখল করে নেয়। সেই সাথে গোলান মালভূমিসহ সিরিয়া, জর্দান ও মিশরের বিশাল ভূ-ভাগ দখল করে নেয়ার পর আরবদের পাল্টা আক্রমণে ইসরাইলের পরাজয়ের আশঙ্কা দেখা দিলে ইঙ্গ-মার্কিন হস্তক্ষেপে জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দিলেও ইসরাইলের দখলবাজির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ও ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে রাখাই এ যাবত কাল ধরে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শান্তি প্রচেষ্টা বা কথিত মধ্যস্থকারিদের মূল লক্ষ্য ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা কখনোই পশ্চিমাদের লক্ষ্য ছিল না। শত বছর আগের সাইক্স-পাইকট গোপণ সমঝোতা চুক্তির ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগাভাগি করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই তাদেরকে সচেষ্ট থাকতে দেখা গেছে। তবে স্নায়ুযুদ্ধের পর বদলে যাওয়া বিশ্বব্যবস্থায় যে নতুন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেখানে সামরিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে এক ধরনের ব্যালান্স সৃষ্টি হওয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার মত মধ্যপন্থি উদার গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন প্রেসিডেন্ট থাকায় ইরানের পরমানু প্রকল্পকে ঘিরে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে যে অব্যাহত যুুদ্ধের হুমকি ছিল তা শেষ পর্যন্ত ইরানসহ ৬ বিশ্বশক্তির মধ্যকার একটি আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তির বাস্তব রূপদান সম্ভব করে তোলে। ২০১৫ সালে সম্পাদিত এই চুক্তি ইরানের পরমানু প্রকল্পকে ঘিরে বড় ধরনের সংঘাতে জড়ানোর সম্ভাবনা অনেকটা দূরিভূত হয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ না থাকলে এসব দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের যে নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তাতে ইসরাইল ও আমেরিকা অনেক বড় ক্ষতির আশঙ্কা দেখছে। বিশেষত মার্কিন মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অস্ত্র ব্যবসা আল কায়েদা, আইএস এবং ইরানের পরমানু বোমার মত জুজুর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এসব জুুজু না থাকলে তাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেবে, অস্ত্র বাণিজ্যের মন্দা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অর্থনৈতিক মন্দা ও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বিগত দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্ব অর্থনীতিতেও বড় ধরণের প্রভাব সৃষ্টি করে। গতানুগতিক সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ বা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মার্কিনীরা সে মন্দা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে একটি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী করে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ব্যবসা করে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনীতিতে নামানো গেলেও মার্কিনীদের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। সউদি আরব ও আরব আমিরাতের মত দেশগুলোর কোনো আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী মনোভাব বা সামরিক উচ্চাভিলাষ আছে এমনটি কেউ মনে করে না। ইসরাইল ছাড়া অন্য প্রতিবেশীদের দ্বারা এসব দেশ আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা যায়নি। একদিকে আইএস জুজু অন্যদিকে ইরানের কল্পিত হুমকির কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে গত এক দশকে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই অস্ত্রের গরমে হুতি বিদ্রোহী দমনের নামে ইয়েমেনে ইতিহাসের বর্বরতম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাস এবং হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার লিলাভূমি ইয়েমেনের প্রাচীন জনপদগুলোর উপর হাজার শত শত টন বোমা ফেলে ধ্বংস করা হচ্ছে। ইসরাইল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন নয়, সউদি ও আরব আমিরাতের তেল বিক্রির ডলার দিয়ে কেনা অস্ত্রে নিরীহ নিরস্ত্র ইয়েমেনিরা হতাহত হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর, স্কুল-মাদরাসা, হাসপাতাল শস্যখামারগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। অবরোধের কারণে দুর্ভীক্ষপীড়িত হাজার হাজার ইয়েমেনি শিশু খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে প্রতিদিন। সম্প্রতি ইয়েমেনের জনস্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রী তাহা আল মোয়াক্কেলের বরাতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৫ সালে শুরু হওয়া মার্কিন সমর্থিত সউদি জোটের সামরিক আগ্রাসনে ইয়েমেনের ৪২৫টি মেডিকেল সেন্টার আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনের স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
গণতন্ত্র, উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মত রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল ইয়েমেনের আনসার আল্লাহ নামে পরিচিত রাজনৈতিক দলের। অল্প সময়ের মধ্যে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে অধিকাংশ ইয়েমেনির কাছে জনপ্রিয় এই গ্রুপটিই বর্তমানে হুথি বিদ্রোহী নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জইন উদ্দিন বেন আলীর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া গণআন্দোলন তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তন সুচিত করে। বেন আলী সউদি আরবে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিশেষত আরব যুব সমাজের এই আন্দোলন মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। আরব বষন্তের সেই হাওয়া ইয়েমেনে নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার জন্ম দেয়। বেন আলির পতনের পর তিউনিসিয়ায় যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল তা নিরসন করতে সেখানকার লেবার ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যবসায়ী সংগঠনসহ যে চারটি সংগঠন ন্যাশনাল ডায়ালগ আয়োজন করে সংকটের সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল তার কয়েক বছর আগে ইয়েমেনের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আনসার আল্লাহ বা হুথিরা সেখানে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করেছিল। তবে এই সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পর সউদি সমর্থিত প্রেসিডেন্ট হাদি রাজনৈতিক শক্তিকে সামরিক শিক্ত দিয়ে মোকাবেলা করার পন্থা বেছে নেয়ার পর হুথিরা জনগণের সমর্থনের পাশাপাশি সামরিক শক্তি সঞ্চয় ও সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বিজয় অর্জনের কৌশল গ্রহণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডের টাওসন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চার্লস স্মিজ্ব মনে করেন, ইতিবাচক পরিবতর্নের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থনের কারণেই হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত চার্লস স্মিজ্বের একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘দ্য রাইজ অব ইয়েমেনস হুথি রেবেলস’। একজন পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকের এই লেখা পড়লে সহজেই বোঝা যায়, ইয়েমেনের আনসার আল্লাহ বা হুথি রা কোনো বহি:শক্তির ক্রিড়নক নয়, তারা ইয়েমেনের অভ্যন্তরে হাজার বছরে গড়ে ওঠা জাইদি শিয়া ধর্মীয় মতবাদ এবং সাধারণ মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত শক্তি। হুথি বিদ্রোহীদের উত্থানে সউদি সমর্থিত আব্দুল্লাহ সালেহ পালিয়ে যাওয়ার পর সউদি আরবের নেতৃত্বে গড়ে উঠা মার্কিন সমর্থিত সামরিক জোট বোমা মেরে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে হুথি বিদ্রোহীদের ধ্বংস করার লক্ষ্য ঘোষণা করে সীমিত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে অভিযান শেষ করার কথা বলেছিল। গত চার বছরের সামরিক আগ্রাসনে হাজার হাজার বেসামরিক ইয়েমেনির মৃত্যু, লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত শত শত শহর ও জনপদ বোমা মেরে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার পরও হুথি বিদ্রোহীদের শক্তিহীন করা বা তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে প্রতিরোধ শক্তি খর্ব করার মত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে ওয়ার অন টেররিজম ও আইএস বিরোধী অভিযান পর্যন্ত গত ৫ দশকের মধ্যে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ও পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত কোনো সামরিক অভিযানই সফল হয়নি। এসব রক্তক্ষয়ী তৎপরতা পুরো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের ঘৃনা, প্রত্যাখ্যান ও আগ্রাসী শক্তির বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা উসমানীয় সাম্রাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যকার সব মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে একটি চনমৎকার সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল। সেই সমঝোতার আলোকে গত একশ বছর তারা মধ্যপ্রাচ্যের উপর একচ্ছত্র প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। একবিংশ শতকের শুরু থেকে অর্থনীতি ও তথ্য প্রযুক্তির গ্লোবাইলাইজেশন চলছে। সে পথ ধরেই সারা দুনিয়ার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জনগনের মধ্যেও এক ধরনের নব জাগরণ শুরু হয়েছে। আরব বষন্তের ধাক্কা সামলাতে পশ্চিমারা তাদের বশংবদ শাসকদের হাতে নয়া খসড়া নীল নকশা এবং হাজার হাজার কোটি ডলারের যুদ্ধ পরিকল্পনার ফর্দ ধরিয়ে দিলেও এটা একটা সাময়িক প্রয়াস মাত্র। আগের সাইক্স-পাইকট ও বালফোর ডিক্লারেশনের ধারাবাহিকতায় এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন শিখন্ডি হয়ে হাজির হয়েছে। গত চার দশক ধরে চলা আরব-ইসরাইল শান্তি-সমঝোতার প্রয়াসের রাস্তা থেকে বেরিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমে তার দেশের দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসের উপর ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারকেই অগ্রাহ্য করা হয়নি, এর মধ্য দিয়ে খোদ ইসরাইলের অস্তিত্বকেও বড় ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। গ্লোবাইলাইজেশন বিশ্বের চোখ এখন কোনো একচক্ষু ইউনিপোলার মোড়লের দিকে নিবদ্ধ নয়। জায়নবাদি গুরুদের প্রেসক্রিপশনে রচিত কথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ব্যর্থ হতে বাধ্য। মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের অনেকেই ইতিমধ্যে এই গোপণ চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্যালেস্টাইন ক্রনিকলের সম্পাদক, রামজি বারৌদ সম্প্রতি মিডলইস্ট মনিটর অনলাইনে প্রকাশিত নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘অ্যা চেঞ্জিং মিডলইস্ট: হোয়াই দি ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি উইল ফেইল’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী, ফিলিস্তিন বিষয়ক লেখক-গবেষক রামজি বারৌদের এই নিবন্ধে আরব-ইসরাইল কনফ্লিক্ট নিরসনে মার্কিনীদের ভণিনতার মুখোশ খুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি খোলাশা করেই বলেছেন, কথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মধ্যকার শান্তি ও সমঝোতার উদ্দেশ্যে নয়, বরং কথিত শান্তি প্রচেষ্টার পথ থেকে সরে গিয়ে এই প্রচেষ্টাকে অকার্যকর করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জায়নবাদি হেজিমনি অব্যাহত রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিপূর্বে যে সব নীল নকশা প্রস্তুত করেছিল এই ডিল তারই উপসংহার মাত্র। তবে অস্ত্রের জোরে, ভয় দেখিয়ে আল কুদস মুক্তির সংগ্রাম দাবিয়ে রাখা যে সম্ভব নয় এটা পশ্চিমারা ভালভাবেই জানে। গত সাত দশকে তা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামে হামাস ও হেজবুল্লাহর বিষ্ময়কর উত্থান এবং আল-আকসা ও পূর্ব জেরুজালেমের উপর ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘ ও ইউনেস্কোর স্বীকৃতি সে ক্ষেত্রে মাইল ফলক অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হতে পারে। গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমকে ঘিরে অব্যাহত আগ্রাসন ও এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরীর পরও ইসরাইলী বাহিনী ১৬ বছর ধরে বন্ধ করে রাখা আল-আকসা কমপ্লেক্সের একটি গেট খুলে দিয়েছে ফিলিস্তিনিরা। রমজানের প্রথম জুম্মায় আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে ১৮০,০০০ মুসল্লির সমাবেশ ঘটে। রমজান মাসের প্রতিটি জুম্মায় বিশাল জমায়েত থেকেই বোঝা যায়, ফিলিস্তিনীরা জায়নবাদি ইসরাইলের হামলার ভয়ে ভীত নয়। ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ষড়যন্ত্রের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর এবারের আল কুদস দিবসের সমাবেশও ভিন্ন মাত্রা লাভ করতে পারে। ফিলিস্তিন ও আল-আকসার বন্দি দশা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও সামরিক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও নিপীড়িত বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের পথে অন্যতম অন্তরায়। মুসলমানদের ঐক্য এবং মানবতার প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের কমিটমেন্ট সেই অন্তরায়ের অর্গল ভেঙ্গে দিতে পারে। এবারের আল-কুদস দিবসে এটাই হোক বিশ্বের শান্তিকামী সব মানুষের অঙ্গিকার।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।