পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইসলামী আকিদায় বিশ্বাসী মুমিনদের জন্য শবে কদর একটি অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যময় রাত। এ রাতের ফজিলত প্রকাশ করতে গিয়ে আল্লাহপাক কোরআন মজিদে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাজিল করেছেন। অন্য কোনো রাত, দিন বা মাসের ফজিলত বর্ণনায় পূর্ণাঙ্গ কোন সূরা নাজিল হয়নি।
আল্লাহ পাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে আর মহিমান্বিত রাত সম্বন্ধে আপনি কি জানেন? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেস্তাগণ ও রূহ (জিবরাইল আ.) অবতীর্ণ হন, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সে রাত ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে’ (সূরা কদর)।
লাইলাতুল কদরের অর্থ: লাইলুন অর্থ শব অর্থাৎ রাত। শব একটি ফারসি শব্দ। কদর অর্থ সম্মান। এই রাতটি অত্যন্ত সম্মানিত এবং বৈশিষ্ট্যময় হওয়ায় একে শবে কদর বলা হয়। কদরের অন্য একটি অর্থ হল তকদীর।
শবে কদর কেন? এক দিন রাসূলে পাক (সা.) বনি ইসরাইলের চারজন নবীর কথা বললেন, যারা আশি বছর পর্যন্ত নিরলসভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদতে মশগুল ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ পাকের হুকুমের বরখেলাফ করেননি। এই চারজন নবী হলেন হযরত আইয়ুব (আ.), হযরত জাকারিয়া (আ.), হযরত হিজকিল (আ.) এবং হযরত ইউশাবিন নুন (আ.)। সাহাবায়ে কেরাম একথা শুনে খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন।
হযরত ইবনে জবীর (রা.) অপর একটি ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেন যে, বনি ইসরাইলের জনৈক আবেদ সমস্ত রাত ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং সকাল হলেই জেহাদের জন্য বেরিয়ে পড়তেন, তিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত এভাবে কাটিয়ে দেন। এসব কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন যে, তাদের পক্ষে এত ইবাদত করা সম্ভবই না। কারণ রাসূলেপাক (সা.) বলেছেন যে, আমার উম্মতের অধিকাংশই ৬০-৭০ বছরের মধ্যেই ইন্তেকাল করে যাবে। কাজেই তাদের সমান বয়স এই উম্মতের না থাকার কারণে এত ইবাদত করা সম্ভব নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহপাক সূরা কদর নাজিল করে সাহাবায়ে কেরামকে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছেন।
কদরের রাতে কী আছে? আল্লাহপাক বলেন, ‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ অর্থাৎ এক হাজার মাস আল্লাহ পাকের ইবাদত (নফল) করার চেয়ে এই একটি রাত ইবাদত করলে অনেক বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
এ রাতে হযরত জিবরাইল (আ.) অসংখ্য ফেরেস্তা নিয়ে এ ধরা পৃষ্ঠে অবতরণ করেন। তিনি যাদের দন্ডায়মান ও বসা অবস্থায় নামাজ ও আল্লাহপাকের জিকির, কোরআন তেলাওয়াতরত দেখতে পান, তাদের প্রতি ছালাত অর্থাৎ রহমতের জন্য দোয়া করেন।
শবে কদর কোন তারিখে? কোরআনপাকের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শবে কদর রমজান মাসে। তবে সঠিক তারিখ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ আছে। তাফসীরে মাজহারীর বর্ণনা মতে, শবে কদর রমজান মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যে আসে। সহীহ হাদীস দৃষ্টে এই দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অধিকাংশ ইমামগণ এ মতই পোষণ করেন। সহীহ বোখারীর রাওয়ায়েতে রাসূলেপাক (সা.) বলেন, রমজানের শেষ দশকে শবে কদর তালাশ কর। আর মুসলিম শরীফের রাওয়ায়েতে আছে, শেষ দশকে বেজোড় রাতগুলোতে তালাশ কর। ইমাম শাফেয়ী (রহ:) এর মতে রমজানের ২১তম রাত শবে কদর। কেউ ২৯তম রাতে শবে কদর বলেছেন। হযরত মা আয়েশা (রা.) এরও এই মত। এই তারিখ সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এবং হযরত আবি ইবনে কাব (রা.) বলেছেন যে, শবে কদর ২৭তম রাতে অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রমাণ দিতে গিয়ে তারা বলেছেন, হযরত ইমাম আহমদ এবনে হাম্বল (রহ.) তার মসনাদে হযরত ওমর (রা.) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, সাহাবাদের মধ্যে একটি প্রচলিত নিয়ম ছিল যে, রমজান মাসের শেষ ১০ রাতে তারা যে স্বপ্ন দেখতেন তা তারা রাসূলে পাক (সা.) এর খেদমতে পেশ করতেন। তারা যে স্বপ্ন দেখতেন সেগুলো রমজানের ২৭ তারিখের রাতই হয়ে থাকত। এতে বোঝা যায় যে, শবে কদর ২৭তম রাতেই হয়ে থাকে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর মতামত ও যুক্তি
হযতর ইবনে আব্বাস (রা.) যে যুক্তি দিয়েছেন সেটি হলো সংখ্যা অর্থাৎ যখন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে, শবে কদর শেষ দশ রাতে বেজোড় রাতে হবে আর সে সংখ্যাগুলো হল ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯তম রাত। অর্থাৎ- ১, ৩, ৫, ৭, ৯। এই পাঁচটি সংখ্যা সম্পর্কে যদি বিশেষভাবে গবেষণা করা হয় তাহলে ৭ সংখ্যাটিই বিশেষ মর্যাদা রাখে। কারণ, আল্লাহপাক ৭ সংখ্যাটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন- (১) আল্লাহপাক ৭টি আসমান সৃষ্টি করেছেন। (২) পৃথিবীর সংখ্যা ৭। (৩) রাতদিনের সংখ্যা ৭। (৪) সাফা মারওয়াতে ৭ বার সায়ী করতে হয়। (৫) কাবা শরীফও ৭ বার প্রদক্ষিণ করতে হয়। (৬) শয়তানকেও ৭ বার কংকর মারতে হয়। (৭) মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ৭ পর্যায়ে। যেমন: ক. মৃত্তিকার সারাংশ, খ. শুক্র, গ. জমাট রক্ত, ঘ. মাংস পিন্ড, ঙ. অস্থিপিঞ্জর, চ. অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃতকরণ, ছ. সৃষ্টির পূর্ণত্ব অর্থাৎ রূহের সংযুক্তকরণ। (৮) ৭ বস্তুকে মানুষের খাদ্য করেছেন। (৯) মানুষের মাথায়ও আল্লাহ পাক ৭টি ছিদ্র দিয়েছেন। যেমন- দুই কান, দুই চোখ, নাকের দুই ছিদ্র এবং মুখ। (১০) কোরআনের কেরাতও ৭ প্রকারের। (১১) আল্লাহপাকের দরবারে ৭টি অংশ দ্বারা সেজদা করা হয়। (১২) দোযখের সংখ্যা ৭। (১৩) দোযখের দ্বারও ৭। (১৪) দোযখের স্তরও ৭। (১৫) আসহাবে কাহাফের সংখ্যাও ছিল ৭। (১৬) আদ জাতি ধ্বংস হয়েছিল ৭ রাতে। (১৭) হযরত ইউসুফ (আ.) ৭ বছর জেলে কাটিয়েছিলেন। (১৮) সূরা ইউসূফে যে গাভীর কথা বলা হয়েছে, এদের সংখ্যাও ছিল ৭। (১৯) দুর্ভিক্ষও ৭ বছর স্থায়ী হয়েছিল। (২০) সাফল্যের বছরও ছিল ৭। (২১) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ১৭ রাকাতেও আছে ৭। (২২) আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হজ্জ্বের পর ৭টি রোজা রাখ।’ (২৩) ৭টি সম্পর্কের মহিলার সাথে বিবাহ হারাম। (২৪) রাসূলেপাক (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমাদের কোনো বরতনে কুকুর মুখ দেয় তাহলে একে ৭ বার পানি দ্বারা ধৌত কর।’ (২৫) হযরত আইয়ুব (আ.) ৭ বছর পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। (২৬) হযরত মা আয়েশার যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ৭। (২৭) রাসূলেপাক (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের শহীদ ৭ প্রকারের।’ যেমন- ক. যে ব্যক্তি জেহাদে শহীদ হয়, খ. প্লেগ রোগে মৃত্যুবরণ, গ. ক্ষয়রোগে মৃত্যুবরণ, ঘ. পানিতে ডুবে মৃত্যু হলে, ঙ. আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করলে, চ. কলেরা বা দাস্ত হওয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করলে, ছ. স্ত্রীলোক যদি নেফাসের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। (২৮) আল্লাহপাক কোরআন মজিদে যে কসম খেয়েছেন তার সংখ্যা ছিল ৭। যেমন- সূর্য, মধ্যাহ্ন, চাঁদ, দিন, রাত, আসমান, আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তার। (২৯) হযরত মূসা (আ.) এর লাঠিও ছিল ৭ গজ লম্বা। (৩০) পরিশেষে একটি দলিলই বোধহয় ২৭ তারিখ শবে কদর হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট, আর এটি হল কোরআন পাকের ৯৭ নং সূরা কদরে আল্লাহ পাক লাইলাতুল কদর শব্দটি ৩ বার উল্লেখ করেছেন। এই লাইলাতুল কদর লিখতে অক্ষর লাগে ৯টি। কাজেই ৩ বার ৯টি অক্ষর ব্যবহার করায় অক্ষরের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭টিতে। আর এটিই শবে কদর ২৭ তারিখে হওয়ার ইঙ্গিত করে। (৩১) সূরা কদরকে আল্লাহপাক কোরআনে ৯৭ নং স্থান দিয়েছেন। এখানে আছে ৭। (৩২) নামাজ পড়তে ৭টি ফরজের প্রতি গুরুত্ব না দিলে নামাজই হবে না। (৩৩) অজু নষ্ট হয়ে যাবার কারণ হল ৭টি।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটিই বোঝা গেল যে, আল্লাহপাক অধিকাংশ জিনিসকে ৭ এর হিসেবে তৈরি করেছেন। যদি শবে কদর রমজান মাসের শেষ ১০ রাতে হয় তবে উপরের বর্ণনা মতে ২৭ তরিখেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
শবে কদরের ইবাদত: রাসূলেপাক (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শবে কদরে জাগ্রত থেকে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করল এবং স্বীয় গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল, আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করে দেবেন। সে যেন আল্লাহপাকের রহমতের দরিয়ায় ডুব দিল, এরূপ ব্যক্তি হযরত জিবরাইল (আ.) এর ডানার স্পর্শ লাভ করবে। সে বেহেস্তে প্রবেশ করবে।’ এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে রাসূলেপাক (সা.) এর বহু হাদীস আছে।
এ রাতকে নির্দিষ্ট না করার কারণ হলো মানুষ যাতে বেশি বেশি রাতে ইবাদত করে।
ওলামায়ে কেরামের অভিমত হলো, রাসূলেপাক (সা.) এর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করার নির্দেশের কারণ হলো, যাতে করে শবে কদর নছিব হয়।
শবে কদরের দোয়া: রাসূলেপাক (সা.) বলেছেন, ‘শবে কদরে এই দোয়া কর, হে আল্লাহ! তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে তুমি ভালবাস, অতএব আমকে তুমি ক্ষমা করে দাও।’
আল্লাহপাক আমাদেরকে শবে কদরের রহমত, বরকত হাসিল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
(রচনাবলী থেকে সংকলিত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।