চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ আবদুচ ছমদ
॥ এক ॥
মাসআলা:- তারাবীহ নামাজের বিধান :
ইমাম আজম আবু হানীফা, শাফেয়ী ও আহমদ (রা.) বলেন, তারাবীহ এর নামাজ নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। তারাবীহ ছেড়ে দেয়া জায়েজ নেই। (দুররুল মোখতার ইত্যাদি) একদা ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ইমাম আবু হানীফা (রা.) কে মূল তারাবীহ নামাজ এবং হযরত ওমর (রা.) যে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) এর পেছনে সকলকে জামাত বন্দী একতেদা করার ব্যবস্থা করেছিলেন, এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে ইমাম আজম বললেন, তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। হযরত ওমর (রা.) যা করেছেন তা তাঁর মনগড়া নয় বা নিজে একাকী করেননি, বরং বহু সংখ্যক সাহাবীদেরকে নিয়ে তাদের উপস্থিতিতেই করেছিলেন, এ হিসেবে একে ইজমায়ে উম্মতও বলা যায়। এ ছাড়া হাদীসেও এসেছে যে নিশ্চয় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম) ইরশাদ করেন আল্লাহ তোমাদের উপর উহার (রমযানের) রোজা ফরজ করেছেন, এবং আমি কিয়াম তথা তারাবীহ সুন্নাত করেছি। (ফতহুল ক্বদীর)
মাসআলা - তারাবীহের নামাজ কয় রাকআত:
তারাবীহ এর নামাজ কয় রাকআত এ বিষয়ে ইমামদের মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়, যা নি¤œরূপ-ইমাম মালেক (রহ.)-এর মতে তারাবীহের নামাজ ৩৬ রাকআত, এর মধ্যে বিতির শামিল নয়। তিনি মদীনাবাসীদের আমল দ্বারা দলিল পেশ করেন। ইসহাক (রহ.)-এর মতে তারাবীহের নামাজ ৪১ রাকআত। ইমাম আবু হানিফা (রা.), ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এবং ইমাম আহমদ (রহ.) এর মতে তারাবীহের নামাজ বিশ রাকআত। কাজি আয়ায (রহ.) বলেন, বিশ রাকআত হওয়াই জমহুর ইমামদের অভিমত। তারা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন-(১) হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে বিতির ছাড়া বিশ রাকাত পড়তেন। বাগবী, ইবনে আবি শাইবা, তাবরানি ফিল কবিরে, বাইহাকী আবদু বিন হামিদ হতে বর্ণনা করেন। (২) হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতকালে লোকেরা রমজান মাসে তেইশ রাকাত ক্বিয়ামে লাইল করতেন। (৩) হযরত মালেক ইয়াজিদ বিন রুমান হতে, তিনি সায়েব বিন ইয়াজিদ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা হযরত ওমর (রা.)-এর সময় বিশ রাকাত ও বিতিরের সাথে ক্বিয়াম করতাম। (ইমাম বাইহাকী তা বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন) (৪) “মারেফাহ” নামক কিতাবে উবাই বিন কা’ব (রা.) হতে বর্ণিত। ওমর বিন খাত্তাব (রা.) তাঁকে রমজানের রাতে কিয়াম করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, অবশ্যই লোকজন দিনে রোজা রাখেন। তারা তেলাওয়াত করে সাওয়াব অর্জন করছেন। আপনি যদি রাত্রে তাদের তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করেন। তখন তিনি আরজ করেন, হে আমীরুল মুমেনীন, তা এমন বিষয় যা নবীর যুগে ছিল না। তিনি বলেন, আমি সে বিষয়ে অবগত আছি। কিন্তু তা উত্তম। অতঃপর তিনি তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত আদায় করেছেন।(ইবনে মানি রেওয়ায়েত করেন) (৫) হযরত আবদুর রহমান সালমি (রা.) হতে বর্ণিত। অবশ্যই হযরত আলী বিন আবু তালেব (রা.) রমজানে ক্বারীদের আহ্বান করলেন এবং লোকজনদের নিয়ে পাঁচ তারবীহায় বিশ রাকাত তারাবীহ নামাজ পড়ানোর জন্যে এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন এবং হযরত আলী (রা.) তাঁদেরকে নিয়ে বিতির নামাজ পড়তেন। (বায়হাকী সুনানে বর্ণনা করেছেন) আবুল হাসানা হতেও অনুরূপ বর্ণিত যে, তিনি বলেন, হযরত আলী বিন আবু তালেব (রা.) এক ব্যক্তিকে লোকজনদের নিয়ে পাঁচ তারবিহায় বিশ রাকাত পড়ার জন্য হুকুম দিয়েছেন। (বায়হাকী শরীফ) উপরন্তু বিশ রাকাত হওয়ার মধ্যে হিকমত হলো, ফরজ ও ওয়াজিব সমূহের দ্বারা পূর্ণতা পায়। প্রতিদিন ফরজ ও ওয়াজিব হলো বিশ রাকাত। সুতরাং এটাও বিশ রাকাত হওয়া সঙ্গত। যেন পূর্ণতার ক্ষেত্রে সমতা বিধান হয়। ইমাম মালেক (রহ.) যে দলিল পেশ করেন তার জবাবে বলা যায় যে, পরবর্তী হাদীসসমূহ দ্বারা তা রহিত হয়ে গেছে।
মাসআলা :- তারাবীহের নামাজ জামাতে পড়ার বিধান:
তারাবীহ নামাজ একাকী পড়াও জায়েজ আছে, তবে জামাতে পড়াই উত্তম। হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নামাজ পড়েন। তখন তাঁর পেছনে অনেক লোক নামাজ পড়েছেন। অতঃপর পরদিন অনুরূপ আরো বেশি লোকের জমায়েত হয়। অতঃপর তৃতীয় দিনেও লোক জমায়েত হয়। কিন্তু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তশরীফ নেননি। যখন সকাল হয় তিনি বলেন, অবশ্যই আমি তোমাদের অবস্থা দেখেছি। কিন্তু আমাকে তোমাদের দিকে যেতে বাঁধা দিয়েছে শুধু মাত্র তোমাদের উপর তা ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। তা ছিল রমজান মাস। (তিরমিজি ব্যতীত সিহাসিত্তার সকলেই বর্ণনা করেছেন )
মাসআলা :- তারাবীহ বাদ গেলে এর ক্বাজা নেই। একাকী ক্বাজা পড়ে নিলে তারাবীহ হবে না, বরং নফল, মস্তাহাব হবে। যেমন মাগরিব ও এশার সুন্নত সমূহ।(দুররুল মোখতার, রদ্দুল মোহতার)
মাসআলা :- তারাবীহর সময় এশার ফরজের পর থেকে ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত। বিতিরের পূর্বে ও হতে পারে এবং পরেও হতে পারে। যদি কয়েক রাকাত বাকি থাকে, ইমাম বিতিরের জন্য দাঁড়িয়ে যায় তখন ইমামের সাথে বিতির পড়ে নেবে। অতঃপর বাকি নামাজ আদায় করে নেবে যদি ফরজ জামাতের সাথে পড়ে থাকে। আর এটা হলো উত্তম। যদি তারাবীহ পূর্ণ করে বিতির একাকী পড়ে তখনও জায়েয। যদি পরে জানা যায় যে, এশার নামাজ অজু ব্যতীত পড়া হয়েছে এবং তারাবীহ ও বিতির অজু সহকারে পড়ে থাকলে এশা ও তারাবীহ পুনরায় পড়বে, তবে বিতির হয়ে যাবে। (দুরুল মোখতার, রদ্দল মোহতার)
মাসআলা :- তারাবীহ বিশ রাকাত দশ সালামে আদায় করবে, অর্থাৎ প্রত্যেক দু’রাকাত পর সালাম ফিরাবে, কেউ বিশ রাকাত পড়ে শেষে সালাম ফিরাল-যদি প্রত্যেক দু’রাকাতে বসে থাকেও হয়ে যাবে। কিন্তু মাকরূহ হবে আর যদি দু’ রাকাতের বৈঠক না করে থাকলে তখন দু’রাকাতের স্থলাভিষিক্ত হবে। (দুররুল মোখতার)
মাসআলা: তারাবীহ নামাযে খতমে কুরআনের বিধান:
১। তারাবীহের মধ্যে একবার কুরআন মাজীদ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ এবং মানুষের অলসতার কারণে খতম পরিত্যাগ করবে না। (দুররুল মোখতার ১ম খ-, ৯৮ পৃষ্ঠা)
২। তারাবীহের মধ্যে একবার কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। মানুষের অলসতার কারণে খতম পরিত্যাগ করবে না। )ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১ম খ- ১১৭ পৃষ্ঠা।
৩। বিশুদ্ধ অভিমত মোতাবেক রামযান মাসে তারাবীহর মধ্যে একবার পূর্ণ কোরআন শরীফ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। যদি জনগণ বিরক্তিবোধ করে, তাহলে পছন্দনীয় মাযহাব মোতাবেক এ পরিমাণ পড়তে থাকবে যা বিরক্তির কারণ না হয়। (নুরুল ইযাহ)
৪। তারাবীহর মধ্যে একবার কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। মানুষের অলসতার কারণে খতম পরিত্যাগ করবে না। (শরহে বেকায়াহ, পৃষ্ঠা-১৭৫)
তারাবীহর নামাযে এক খতম কোরআন পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ‘খানিয়া’ ও আন্যান্য কিতাবে এই মতকেই সহীহ্ বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘হেদায়া’ গ্রন্থে অধিকাংশ ওলামার বরাতে, ‘কাফি’ গ্রন্থে জমহুর আলেমের বরাতে এবং “বোরহান” গ্রন্থে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বরাত দিয়ে উক্ত মতকেই সহীহ্ বলা হয়েছে। (ফতোয়ায়ে রেজভীয়া, ৮ খ-, পৃষ্ঠা ৪৭৩)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।