ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
জ্ঞানার্জন ও কর্মসংস্থান
মুহাম্মদ আবদুল বাসেত : সদ্য একাডেমিক পড়া-লেখা সমাপ্তকারী বা দীর্ঘদিন যাবৎ চাকরিপ্রার্থী এমন অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর মিলনস্থল শাহবাগ গণগ্রন্থাগার। জ্ঞান সাধনার সুবাধে যতবারই সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়ছে; শুধুমাত্র বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছে। এমন অসংখ্য শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, যে কোন ভাবে একটি কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রী শেষ, বাপ-মা অনেক বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে; সন্তান কি করছে বা কি করবে? দুপুরের কেন্টিনে আলু-ভর্তা/ডাল দিয়ে মাথা নিচু করে খাবার গ্রহণের অসংখ্য নজীর ও বাস্তবতা দেখার সুযোগ হয়েছে। বড় বেশি আফসোস হতো ছাত্রী-বোনদের খাবারের কষ্ট দেখে, হয়তোবা মেস বা হোস্টেলের আগের রাতের খাবার বা সকালের নাস্তাকে দ্বিগুণ করে দুপুরের খাবারের টিফিনে করে কোনো উপায়ে ক্ষুধা নিবারণ করা।
সকাল আটটা থেকে রাত পোনে নয়টা পর্যন্ত লাইব্রেরির পড়ার টেবিলে পড়ে থাকতে দেখা গেছে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে। যে পড়া-লেখা আসলে কোনো জ্ঞান সাধনার ব্রত হয়ে নয়, বরং শুধুমাত্র ভালো একটি চাকরি পাওয়ার জন্য গলধকরণ। দুঃখের বিষয় কোনমতে একটি চাকরির ব্যবস্থা হলেই শিক্ষার্থীরা ভুলে যায় জ্ঞান সাধনা বা পড়া-লেখায় ব্যয় করে অতীত সময়ের পরিসংখ্যানটুকু। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র চাকরিতে সীমাবদ্ধ নয়, যে শিক্ষার আলোয় এ সমাজ আলোকিত হবে। পথহীন মানব পথের সন্ধান পাবে।
যে জ্ঞান প্রদীপে জ্ঞানী নিজেকে যেমনিভাবে পরিচালিত করবে, তেমনি সমাজের অবহেলিত-অত্যাচারিত মানবতাকেও পথের সন্ধান দিবে ও পরিচালিত করবে। জ্ঞান আত্মকেন্দ্রিক নয় এবং যার পরিধিও সংকীর্ণ নয়।
জ্ঞানের মর্ম উপলব্ধি না করে ও জ্ঞান সাধনায় না ঝুঁকে শিক্ষার্থীরা এমনকি অধিভাবকেরাও ঝুঁকে পড়েছে বিভিন্ন লোভনীয় চাকরি ও আকর্ষণীয় বেতনের দিকে। কোর্স ও পাঠ্যক্রম তৈরি হচ্ছে চাকরির উপর ভিত্তি করে। বাবা মা ও আত্মীয়-স্বজনেরা সন্তানাদির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে- তাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা অন্য কিছু বানাবে, যাতে অর্থ-সম্পদশালী হবে। সে জন্য সন্তানাদিও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উকিইলই হয়, কিন্তু দক্ষ মানব সম্পদ ও ভালো সন্তানে রূপান্তর হয় না।
জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল-বিদ্যালয় যেখান থেকে জ্ঞানী-গুণি বের হয়। সে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় অপেক্ষাকৃত কম জ্ঞানীরাই ঝুঁকছে। যাদিও বরাবর অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সম্মানজনক ও মহান পেশা হলেও শিক্ষকদের করা হচ্ছে না সঠিক কদর। খতিয়ে দেখার বা তার যথাবিহীত পদক্ষেপ গ্রহণেরও নেই যথাযথ কেউ।
অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের কর্মসংস্থানের প্রতি হতাশা; অনেকটা অর্থের লোভে বিদেশে পাড়ি দেয়ার মধ্য দিয়ে যেমনি দেশ হচ্ছে মেধাশূন্য, তেমনি অনেকেই সর্বস্বান্ত হারিয়ে ফিরছে দেশে। প্রবাসী অর্থ আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় সম্পদ, কিন্তু কেন? বিদেশিরা আমাদের সস্তা শ্রম পুঁজি করে তার থেকেও বেশি লাভবান হচ্ছে। অথবা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে পরনির্ভরতা কমিয়ে দেশকে আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব।
আমাদের শিক্ষার আরো বড় আপদ-একাডেমিক অর্জিত শিক্ষা সম্পর্কিত কর্মসংস্থানের অভাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এক বিভাগের পড়–য়া শিক্ষার্থী কাজ করছে অন্য বিভাগে। দীর্ঘ পনেরো-ষোল বছরের পড়ালেখা কি কাজে লাগলো। শিক্ষার্থীদের এমন ভাবনা জাগিয়ে দেয়া উচিত, পড়া লেখা শেষ করে চাকরি প্রার্থী না হয়ে স্বীয় শিক্ষা-সম্পর্কিত কর্মসংস্থানের তৈরি করবে। যা শুধু তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নয়, অন্য বেকারদেরও ঠাঁই হবে।
এমনও অনেক উচ্চতর ডিগ্রীধারী পাওয়া যায়- যিনি চাকরিপ্রার্থী হন তার থেকেও কম ডিগ্রীধারী মালিকের প্রতিষ্ঠানে। তবে হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা যেহেতু বড় একটি সম্পদ; এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হবে কর্মসংস্থানের আরো বড় ক্ষেত্র তৈরির প্রয়াস।
বর্তমানে আমাদের শিক্ষিত সমাজে সবচেয়ে অভাব-গবেষণাগার ও গবেষকের। গবেষণা ও জ্ঞানার্জনে অধিক সময় ব্যয় করা যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে মুষ্টিমেয় লোকের কাজ। এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা পেশার সাথে জড়িত মহামান্যদের মাঝেও এক্ষেত্রে উদাসীনতা ব্যাপকহারে লক্ষণীয়। অর্থ ও লোভ- লালসার প্রতি দৌড়ঝাঁপ এবং এটিই যেন জীবনের সব। জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণা ও গবেষণার বাস্তব নজীর দেখতে আমাদের পূর্ব পুরুষদের দিকে যদি একটু তাকিয়ে দেখি- তুর্কির অধ্যাপক ইসমাইল পাশা ‘ইবনোল হাইছামের’ লিখিত একশত সাতচল্লিশটি গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে পদার্থ-বিজ্ঞানেই এগারোটি। বিখ্যাত দার্শনিক ‘জাবির ইবনে হাইওয়ানে’র লিখিত ছোট-বড় দুইহাজারেরও বেশি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে দর্শনশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা ও ভাগ্যলিপি সম্বন্ধীয় শাস্ত্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। যদিও তাদের কিছু কিছু প্রবন্ধকে এক একটি গ্রন্থ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। দার্শনিক ‘আল-ফারাবী’ সত্তরটি ভাষা জানতেন। শতাধিক গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। ‘আল-কিন্দি’ বিভিন্ন বিষয়ের উপর দুইশত পঁয়ষট্টি খানা গ্রন্থ লিখেছেন।
‘আল বেরুনী’-গণিত, জ্যোতিষ, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, ভূগোল, রসায়ন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর একশত চুয়াল্লিশটি গ্রন্থ লিখেছেন। ‘ইবনে সিনা’-সাহিত্য, দর্শন, বীজগণিত, জ্যামিতি ও রসায়নে ছোট-বড় মিলে একশত পঁচিশটি গ্রন্থ নিখেছেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন হলে আজও স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে তাকে। আব্বাসীয় যুগে ‘ইবনে সিনা’র চিকিৎসাশাস্ত্র “কানুন ফিত তিব্ব” বিশ্ব জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে কিভাবে সম্ভব হলো তাদের পক্ষে অসম্ভব এসব কর্ম সম্পাদন করার। শুধুমাত্র কর্মসংস্থান বা জীবিকা উপার্জনের জন্য তারা কি কর্ম করেছিল? কতটুকু সময় তারা দিয়েছিলেন? যা তাদেরকে আজ জগৎবিখ্যাতদের আসনে সমাসীন করেছে। তাদের লিখিত গ্রন্থের উপর আজ পর্যন্ত অসংখ্য শিক্ষার্থী জ্ঞানান্বেষণ ও গবেষণা করছে। হয়ত তাদের সমসাময়িক আরো অনেক জ্ঞানী-প-িতও জীবিত ছিল- যা তাদেরকে এ আসনে সমাসীন করেনি।
যদি তাদের শ্রমের সমসাময়িক পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করি, হয়ত তারা পাননি বা সামান্যতম সৌজন্যবোধও না। কিন্তু তাদের পরিশ্রমের ফল বয়ে বেড়াচ্ছে যুগ থেকে যুগান্তর। ক্ষুদ্র ও স্বীয় স্বার্থ বিবেচনায় যারা সবসময় ঘুরপাক খাচ্ছে সাময়িক সুবিধাটুকু নিয়ে- মাছের মতো বর্শির খাবার গিলেই তৃপ্তির ঢেকুর গিলতে চায় তারা। তবে হ্যাঁ জ্ঞান পিপাসুদের বাস্তব নজির এমনও রয়েছে অর্ধাহারে-অনাহারে যাদের জীবনটুকু পর্যন্তও দিয়ে দিতে হয়েছে। সাময়িক লাভ, অনৈতিক ও অর্থ লোভ তাদেরকে একবিন্দু পর্যন্তও সাধনা থেকে নড়াতে পারেনি।
জ্ঞানার্জন শুধুমাত্র একাডেমিক বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ নয়। নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি লক্ষণীয়।
সমাজটা নারী জাতিকে এমনভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে বিয়ে মানেই অন্যের অধীনে চলে যাওয়া, স্বামীর ঘর-সংসারেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকা। সৃজনশীলতা ও নিজের মতো কোনো কর্মসৃষ্টির প্রয়াস ঘটানো বা গবেষণালব্ধ কর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করার ভাবনাটাও যেন বিপদ। যেখানে জনৈক দার্শনিকের উক্তি, “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব”। যে মায়ের জ্ঞানান্বেষনের শেষ হয়েছে জ্ঞানের মর্ম অনুধাবনের পূর্বেই, যে মা পরের সংসারের যাঁতাকালে অর্জিত জ্ঞানটুকুও হারিয়ে যাওয়ার পথে, সে মা কিভাবে তার সন্তানকে জ্ঞানের মর্ম উপলব্ধি করাবে। অনেক পরিবারেই দেখা যাচ্ছে বাবা মায়ের শিক্ষার বা জ্ঞানের মর্ম উপলব্ধিতার অভাবে ছেলে-সন্তানাদি একটু রড় হলেই পড়া-লেখা বন্ধ করে, বিভিন্ন কর্মে লাগিয়ে দেয়ার প্রবণতা। যা গ্রাম থেকে এখন শহরাঞ্চলেও লক্ষণীয়। ফলশ্রুতিতে শিশুশ্রমের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যাধিক হারে।
জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ভালো চাকরি ও কর্মসংস্থান নয়। অনুতাপের বিষয় ইদানীং আমাদের পাঠ্যসূচিও এমনভাবে তৈরি হচ্ছে ভালো চাকরি ও উচ্চতর বেতনের দিকে শিক্ষার্থীদেরকে আকর্ষণীয় করা হচ্ছে। কর্মজীবনে যে যেই কর্মেই থাকুক, প্রত্যেকের জন্য ছোট বড় একটি লাইব্রেরি থাকা প্রয়োজন। যেখান থেকে জ্ঞানের প্রকৃত স্বাধ আস্বাদন করবে। মানবতার কল্যাণে কাজ করার যেমনি অনুপ্রেরণা পাবে, তেমনি অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করার জন্য উৎসাহিত হবে। তাহলেই জ্ঞানার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্বার্থক হবে।
লেখক : গবেষক ও কলামিষ্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।