পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিথ্যা ও সত্যের মধ্যে দূরত্ব বা তারতম্যের পরিমাণ একচুল মাত্র। ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ এক এক রকম ব্যাখ্যা দিলেও আসলে ‘গদিচ্যুৎ’ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের উৎপত্তি। তবে আভিধানিক অর্থ বা আইনের ভাষা ও ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন ‘জাতীয়তাবাদের’ পরিপন্থী চিন্তা চেতনাই মূলত রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ইতিহাসবিদদের কলমের জোরে অথবা পক্ষপাতিত্বের কারণে অথবা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তথ্য বিভ্রাটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে খল নায়ক নায়কে এবং নায়ক খলনায়কে ইতিহাসের পাতায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সে কারণেই কোনো বিষয়ে একজন লেখকের রচিত ইতিহাস পাঠ করে সত্যের সঠিক সন্ধান পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, যদি না বহুমাত্রিক লেখকের লেখা ইতিহাস পাঠ না করা যায়। তবে ইতিহাস বিকৃতি বা বানোয়াট কথা লিখানোর জন্য আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব হয় না।
জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় দার্শনিক Hans Kohn--এর মতে, Nationalite are products of living forces of history, Nationality is an historical and political conecpt and the word “National” and “Nationality” have undergone many changes in Meaning..
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা, পাহাড়ী-সমতল, আদিবাসী-পরবাসী হিসাবে নির্দিষ্ট ভূখন্ডে থেকেও একটি জাতি দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে। কিন্তু জাতিসত্ত্বার প্রশ্নে বিভক্তি থাকতে পারে না, যদি কোনো কারণে বিভক্তি আসে তবে সে জাতিস্বত্ত্বা মজবুত হতে পারে না, বরং এক পক্ষ অপর পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠে পড়ে লাগে এবং এ জন্য বৈষম্যমূলক আইন পাশ করাসহ গণহত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৯০-৯২% জনসংখ্যা একই ধর্মের হওয়া সত্তে¡ও জাতিস্বত্ত্বা সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করেছিল। বর্তমানে মিয়ানমারে যা ঘটছে, সেটাও ঘটছে জাতিস্বত্ত্বা সৃষ্টি হতে না পারার কারণেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী একত্রে বসবাস করেও সেখানে জাতিসত্ত্বার সৃষ্টি হয় নাই। ১৮৮৭ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্য মজুরীর দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং ১ মে সেখানে গুলি বর্ষণে শ্রমিক হত্যা দিবসটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও শ্রমিকের কাক্সিক্ষত দাবি আদায় হয় নাই। শ্রমকে পুঁজির সাথে মূল্যায়ন করতে হবে, এটাই ছিল শ্রমিকদের মূল দাবি। পক্ষান্তরে শ্রমিক নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে দালালীর কারণেই শ্রমিক আন্দোলন বার বার মার খাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন বুঝে না এমন লোকও বর্তমানে ডাক সাইটের শ্রমিক নেতা। ট্রেড ইউনিয়ন কী ও কেন? এ মর্মে রাজনৈতিক দলগুলিতে প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নাই। যেমন-পরিবহন মালিকরা যখন সংকটে পড়ে তখন মালিকদের রক্ষা করার জন্য গঠিত হয় পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। মালিক ও শ্রমিকের স্বার্থ যখন কখনো এক নয়, তখন ঐক্য হয় শুধু মালিকদের সংকট মোকাবেলার জন্যই। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি শ্রমিক অঙ্গ সংগঠন থাকলেও ট্রেড ইউনিয়ন বলতে যা বুঝায় সে পদ্ধতিতে শ্রমিক অঙ্গ সংগঠন গড়ে উঠে নাই।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ একটি ভাটি এলাকা। হিমালয় পর্বত থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলির অধিকাংশই বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গপোসাগরে মিলিত হয়েছে। ফলে নদীবাহিত পলি মাটির কারণে বাংলাদেশের মাটি অনেক ঊর্বর। তাই এলাকাটি একটি কৃষিনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলমান পীর ফকিরদের এ দেশে আগমনের পূর্বে জনসংখ্যার প্রশ্নে দেশটি ছিল হিন্দু প্রধান এলাকা। ভারতের বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা সাধারণ কৃষিজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষদের নিম্ন বর্ণের মনে করতো। ফলে ভ্রাহ্মণ, ব্যানার্জী, চ্যাটার্জী প্রভৃতি বনাম দাস, সাহা প্রভৃতি গোষ্ঠির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থনীতিবিদরাও বর্তমানে রুজী/আয় ভিত্তিক জনগোষ্ঠির শ্রেণিভিত্তিক উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নামে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। আধুনিক অর্থনীতিবিদদেরা ‘নিম্নবিত্তের’ শব্দটি পরিবর্তন করে তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে শ্রমজীবী হিসেবে চিহ্নিত করছেন। জাতিস্বত্ত্বার অভাবে শ্রমজীবীরা দিনে দিনে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। কোটিপতি সৃষ্টি হচ্ছে জ্যামিতিক হারে, যার পিছনে রয়েছে অযাচিত ব্যাংক ঋণ সুবিধা নানাভাবে অপব্যবহারের মাধ্যমে ঋণের টাকা আত্মসাতের মনোবৃত্তি। মোটা অংকের ব্যাংক ঋণের টাকা আত্মসাৎ করা অনেক সোজা। কারণ মাত্র ১% ডাউন্ট পেমেন্ট দিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকা ডিফলটার ঋণ নবায়ন করার সুযোগ সরকার দিয়েছে, যার সুবিধা সরকারঘরনার লোকেরাই পাচ্ছে, যাদের অধিকাংশই আবার ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদেও রয়েছেন। এখানেই রয়েছে জাতি স্বত্ত্বার প্রচুর ঘাটতি। তবে মুখে মুখে সবাই দেশপ্রেমিক, যাদের মধ্যে সুশীল-বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে কোটিপতির সংখ্যা ৭৫ হাজার ৫৬৩ জন। ফলে সরকারের বক্তব্য মোতাবেক, দেশের গোটা জনগণের উপার্জন বৃদ্ধি পেয়েছে কথাটি সত্যের অপালাপ মাত্র। গোটা জনগোষ্ঠির ভাগ্যের পরিবর্তন সার্বিকভাবে হয় নাই। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ এখনো রয়ে গেছে। জাতিস্বত্ত্বা মজবুত হয় নাই বলেই শ্রেণি বৈষম্য এতো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমজীবী দিন দিন নিঃস্ব হয়ে শ্রমজীবীই রয়ে গেলো। মুচির সন্তান মুচিই হচ্ছে, রিক্সা চালকের সন্তান রিক্সা চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে।
জাতীয় পত্রিকান্তরে প্রকাশ ‘যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক উচ্চশিক্ষা নিয়ে গবেষণা করে এমন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা এশিয়াতে উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। টাইমস হাইয়ার এডুকেশন নামে লন্ডনভিত্তিক এই প্রকাশনাটি ২০১৯ সালের যে তালিকা দিয়েছে সেখানে এশিয়ার ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৫০টি। বাংলাদেশের অনুমোদিত ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিও স্থান পায়নি এই তালিকায়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা পদ্ধতিসহ নানা বিষয় নিয়েই বিভিন্ন সময় সমালোচনা হয়। কিন্তু কেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় স্থান পেল না? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা এ সম্পর্কে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি এখনো সনাতন পদ্ধতির মধ্যেই রয়েছে, সঙ্গে রয়েছে নানা অরাজকতা। আমাদের একটা বড় ঘাটতির জায়গা হলো যে টিচিং এন্ড লার্নিং। এই দুটি পদ্ধতি খুব পুরনো আমলের রয়ে গেছে। লার্নিং কত ধরনের আছে সেটা নিয়ে গবেষণার অভাব আছে, বোঝাবুঝির অভাব আছে। এখানে তো অনেক দিন ধরে অনেক অরাজকতা চলছে সেসব মিটিগেট করার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেটাই বড় সমস্যা। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দিকা বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরেও গুটি কয়েক বিভাগে গবেষণা হয়। বিশ্ব র্যাংকিং এর ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা বড় ভ‚মিকা পালন করে। যেটা এখানে হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে ছাত্রদের পাস করিয়ে দেবে এক উদ্দেশ্য যত না তার চেয়ে বেশি থাকবে গবেষণার কাজ। বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কিছু গবেষণার কাজ হচ্ছে। কিন্তু এর বাইরে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। গবেষণার জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পেছানো। এদিকে একসময়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বারবার এসেছে দেশের নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। কিন্তু এসব যে উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম লেখানোর জন্য কোনো কাজ করে না সেটাই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা।’
জাতিস্বত্ত্বার তাগিদেই শেরে বাংলা এ. কে. এম. ফজলুল হকের রাজনৈতিক প্রভাব, নবাব সলিমউল্ল্যাহর দান করা জমি এবং জমিদার আমীর আলীর আর্থিক সাহায্যে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও চরম প্রতিরোধের মুখে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চরম বিরোধিতা করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে লর্ড কার্জনের নিকট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করে স্মারকলিপিতে কবি গুরুও একজন স্বাক্ষরদাতা। অথচ প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র কীর্তন (জন্ম, মৃত্যু বার্ষিকীসহ) চলে নিয়মিত। কিন্তু যাদের প্রচেষ্টা, জমি ও অর্থের বিনিময়ে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যোর অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত তাদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠানের কথা জাতি জানে না, এতে কি জাতিস্বত্ত্বা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।