Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপকূলীয় বাঁধ রক্ষায় আরও পদক্ষেপ নিতে হবে

এইচ এম আব্দুর রহিম | প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় বাঁধগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগামী বর্ষা মওসুমের আগে জরুরি ভিত্তিতে সংষ্কার করা না হলে কোটি কোটি টাকার সম্পদসহ বহু জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার অশংকা রয়েছে। ফণীর উৎপত্তিটা উত্তাল ভারত মহাসাগর থেকে সুমাত্রার পশ্চিম পাশ দিয়ে এবং এটা বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতের উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। আশ্চর্য়ের বিষয় হলো, এটা গত ৪০ বছরের মধ্যে সব চেয়ে বেশি শক্তি সঞ্চয় করে আঘাত হেনেছে। গত ৩ মে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে ২০০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে ফণী। সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আল্লাহর দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া, এটা স্থল পথে যখন সাতক্ষীরা জেলা হয়ে দেশে ঢুকেছে, তখন ঝড়ের গতিবেগ ছিল ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। ফলে জানমালের আশঙ্কিত ক্ষয়ক্ষতি না হলেও উপকূলীয় বাঁধগুলো লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উপকূলীয় ৫ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। বাধঁগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় এখন টিকে আছে কোনো রকমে। এসব বাঁধ সংস্কার করা না হলে আগামী বর্ষা মওসুমে বিস্তীর্ণ জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বাঁধ ভেঙ্গে বসত ভিটা ও ফসল ভেসে যাওয়ার পর সংস্কার ও নিমার্ণের কোনো প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও বাঁধের কাজে যৎসামান্য পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকা ভাগাভাগি হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয় তা সরকারের কেন্দ্র থেকে সরাসরি মনিটরিং করা উচিত। বাঁধ নিমার্ণ করা হবে অথচ ভেসে যাবে এমন বাঁধ নির্মাণ করার প্রয়োজন নেই। বিদ্যমান বাঁধগুলো মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে। বাঁধের দুর্বল পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে সংস্কার করতে হবে।
বিগত ৪৩ বছরের ইতিহাসে কোনো ঘূর্ণিঝড় এমন রূপ ধারণ করতে দেখা যায়নি। ঘূর্ণিঝড়টি যদি বাংলাদেশে আঘাত হানত তবে কী পরিস্থিতি দাঁড়াত তা কল্পনাও করা যায় না। ভারত ঘুরে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় ধারণার চেয়ে কম ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের এই দুর্বল আঘাতেই দেখা যাচ্ছে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চল নড়বড়ে হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভারতের উড়িষ্যার মতো আঘাত হানলে এসব বাঁধের অস্তিত্বও থাকত কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা যেতেই পারে। আমরা বহুবার বলেছি, উপকূলীয় বাঁধসহ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকার বাঁধগুলো দৃঢ়, মজবুত করে গড়ে তুলতে। যেসব বাঁধ নির্মিত হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত সংস্কার করতে হবে। দেখা যাচ্ছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে উদাসীন থেকে যাচ্ছে। প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধগুলোর উন্নয়ন করছে না। এসব বাঁধের সিংহভাগই যে কত নাজুক অবস্থায় রয়েছে তা ঝড়-বৃষ্টি বন্যা হলেই বোঝা যায়।
এ ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের ভূমিকা খুবই দায়সারা গোছের। পানি উন্নয়ন বোর্ড এমনভাবে বাঁধ নির্মাণ করেছে, যা বন্যায় ও জোয়ারের পানিতে সহজেই ভেসে যায়। ভেসে গেলে অসাধু কর্মকর্তাদের লাভ। তাদের মনে এই প্রবণতা বিরাজমান। বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে পুনরায় অর্থ বরাদ্দ হবে এবং তাদের পকেটভারি হবে। মানুষ, ঘরবাড়ি ফসলি জমি, গবাদি পশু ভেসে গেল কিনা, তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই। অর্থাৎ জনগণের অর্থে নির্মিত বাঁধ নিয়ে দুর্নীতি চক্র স্থায়ী ব্যবসা তৈরি করে নিয়েছে। বছরের পর বছর বাঁধ নিয়ে এসব খেলা চলছে। উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এটা লক্ষ করা যায়। ফণীর প্রভাবে ধান, আলু, পেঁয়াজ, আম, লিচু, তরমুজ, সূর্যমুখী ফুল ক্ষেত, বাদাম, ভুট্টা, কাঁচা মরিচ, পানের বরজ, কলাগাছ শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসল নষ্ট হয়েছে। বাতাসে মাটির সাথে লেপ্টে গেছে ধান। তলিয়ে গেছে আধা পাকা বোরো ফসল। বৃষ্টির পানিতে ফসল, ঘের ভেসে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের হিসেব মতে, ৩৬ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা কয়েক স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৫ কোটি মানুষ দেশের নদী বেষ্টিত উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত। বিশেষ করে টেকসই বাঁধ না থাকায় জান মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। প্রতি বছর উপকূলীয় বাঁধ ভেঙ্গে নদীর পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালি, কক্সবাজার, ভোলা অন্যতম। প্রায় ডজন খানেক জেলার ভৌগোলিক অবস্থান উপকূলীয় এলাকায়। এসব উপকূলীয় এলাকায় জেলে, কৃষক, বাওয়ালী, কামার, কুমারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক বসবাস করে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূলীয় অধিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষ করে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে মোট চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ পূরণ করে। সাগরসহ স্থানীয় নদ নদী থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। বিশেষ করে হিমায়িত চিংড়ী রপ্তানি করে বাংলাদেশ কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ পেশার সাথে উপকূলীয় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। মৎস্য উৎপাদনের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন প্রজাতির ফসল উৎপাদন হয়, যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিন্তু উপকূলীয় বাঁধগুলো এত জরাজীর্ণ যে এসব এলাকার কোটি কোটি মানুষ চরম আতংক উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। শুধু সাতক্ষীরা, খুলনা উপকূলীয় এলাকায় সাড়ে ৮শ কিলোমিটার ওয়াপদা বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
উপকূলীয় বাঁধগুলো যে কোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করতে পারে, যাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গোসাগরের তরঙ্গমালা হতে রক্ষা করার জন্য মূলতঃ এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এসব বাঁধের স্থায়িত্ব ধরা হয় বিশ বছর। কিন্তু ৪০ বছর উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও যথাযথভাবে এসব বাঁধ সংস্কার করা হয়নি। ফলে বিশাল বিস্তৃত এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেন্বর হারিকেন ঝড়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেন্বর সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় উপকূলীয় এলাকা লন্ড ভন্ড হয়ে যায়। প্রায় ৩ শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে, হাজার হাজার বসত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর পর থেকে উপকূলীয় বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এসব সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন