চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে আবার ফিরে এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। নেয়ামতপূর্ণ এ মোবারক মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেন। নবি করিম (স) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের সামনে রমজান মাস সমুপস্থিত। এটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের রোজা আল্লাহপাক তোমাদের ওপর ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো করে দেয়া হয় বন্ধ। এ মাসে বড় বড় শয়তানগুলোকে আটক করে রাখা হয়।
রোজাকে আরবিতে ‘সাওম’ বলে। সাওম-এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে যাবতীয় পানাহার এবং কামাচার থেকে বিরত থাকার নাম সাওম। রোজা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। রমজান এমন একটি মাস, যার প্রথম দশক রহমতের দ্বারা পরিপূর্ণ, দ্বিতীয় দশক বরকতে ভরপুর এবং তৃতীয় দশক জাহান্নামের আজাব থেকে নাজাত ও মুক্তির জন্যে নির্ধারিত। সুতরাং যারা এমন একটি রহমত ও বরকতের মাস পেয়েও রোজা পালন করে সুফল লাভ করতে পারল না, তাদের জন্যে দুঃসংবাদ ছাড়া আর কিইবা থাকে? রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, ‘এ মাসে পরম করুণাময় মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি শুভ দৃষ্টি প্রদান করেন, তোমাদের সকল পাপরাশি ক্ষমা করে দেন এবং দোয়া কবুল করেন ও রহমত বর্ষণ করেন।’
কথা হলো, রমজানের প্রথম দশকে বান্দার প্রতি মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ হতে কী রহমত বর্ষিত হয়? এর জবাবে হাদিসশাস্ত্রের বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থে বর্ণিত বিষয়সমূহ হলো : ১. রোজাদার ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা রিজিকের সচ্ছলতা দান করেন, ২. ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে দেন, ৩. সাহরি ও ইফতার গ্রহণের প্রকৃত সাওয়াব দান করেন, ৪. নেক কাজের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে দেন, ৫. অগণিত ফেরেশতা রোজাদারের জন্যে মাগফিরাত কামনা করেন, ৬. শয়তানকে বন্দি রাখার কারণে রোজাদার ব্যক্তি কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকেন, ৭. জান্নাতের সকল দরজা উন্মুক্ত ও জাহান্নামের দ্বারসমূহ বন্ধ রাখা হয়, ৮. প্রতি রাতে অগণিত জাহান্নামিকে মুক্তি ও নিষ্কৃৃতি দেয়া হয়, ৯. রমজানের প্রত্যেক জুমার রাতে ওই পরিমাণ জাহান্নামিকে মুক্তি দেয়া হয়, যে পরিমাণ গোটা সপ্তাহে মুক্তিলাভ করেছে, ১০. রমজানের শেষ রজনীতে রোজাদারের গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়, ১১. রমজান উপলক্ষে প্রতিদিন বেহেশত সুসজ্জিত করা হয়, ১২. রোজাদারের যে কোনো দোয়া (ইফতারের সময়) কবুল করা হয়, ১৩. রোজাদারগণ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করেন, ১৪. রোজাদারের দেহকে সকল পাপ হতে মুক্ত ও পবিত্র করা হয়, ১৫. প্রতিটি নফল ইবাদতের বিনিময়ে রোজাবিহীন মাসের ফরজ সমতুল্য পুণ্যদান করা হয়।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা : ১৮৩)
এ আয়াতের দ্বারা যেমন রোজার বিশেষ গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে, তেমনি মুসলমানদেরকে এ মর্মে সান্ত¡না দেয়া হয়েছে যে, রোজা কষ্টকর ইবাদত বটে। তবে তা’ শুধু তোমাদের ওপরই ফরজ নয়, তোমাদের পূর্বের জাতিগুলোর ওপরও রোজা ফরজ ছিল। কারণ, কোনো ক্লেশকর কাজে অনেক লোক একসঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লে তা অনেকটা স্বাভাবিক এবং সাধারণ বলে মনে হয়।
তাফসিরে রুহুল মায়ানীতে বলা হয়েছে, ‘হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত কোনো উম্মত বা শরিয়তই যেমনি নামাজ থেকে বাদ ছিল না, তেমনি রোজাও সবার জন্যে ফরজ ছিল। তবে হ্যাঁ, আমাদের রোজার সমগ্র শর্ত ও প্রকৃতিসহ আগেরকার উম্মতদের রোজা ছিল না।
রোজার বিভিন্ন ফজিলত হাদিসের বিভিন্ন স্থানে বিধৃত রয়েছে। হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, রোজা আমার জন্যে আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। অন্য এক হাদিসে রয়েছে, রোজাদার ব্যক্তির ক্ষুধার্ত পেটের আতুড়ি নির্গত মুখনিসৃত দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশক জাতীয় সুগন্ধি হতেও উত্তম। আট বেহেশতের মধ্যে ‘রাইয়ান’ নামক একটি বিশেষ বেহেশত শুধু রোজাদারদের জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। এতে অন্য কারও প্রবেশাধিকার থাকবে না। এছাড়া রমজান মাসে প্রতিটি আমলের সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। প্রতিটি নফলকে একটি ফরজ ও প্রতিটি ফরজকে ৭০টি ফরজের সমতুল্য করে আমলকারীকে সাওয়াব প্রদান করা হয়। সারা বছর ধরে রমজান মাসের জন্যে বেহেশত সাজানো হয়।
কথা হলো রমজান মাসের এতো ফজিলত কেন? এর জবাব খোদ আল্লাহ তায়ালাই পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন। তাহলো, এ মাসেই পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এ মাসকে স্বীয় অহী ও আসমানি কিতাব নাজিল করার জন্যে নির্বাচিত করেছেন। অহি ও আসমানি কিতাব বললাম এ জন্যে যে, শুধু কুরআনই এ মাসে নাজিল হয়নি; বরং অন্যান্য আসমানি কিতাবও এ মাসেই নাজিল হয়েছে। মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে হযরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসূলে করিম (স) ইরশাদ করেছেন, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহিফা রমজান মাসের প্রথম তারিখে নাজিল হয়েছে। ৬ রমজান তাওরাত, ১২ রমজান জবুর, ১৩ রমজান ইনজিল নাজিল হয়েছে। আর পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে ২৭ রমজান কদরের রজনীতে।
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের জন্যেই রমজানের রোজা আদায় করা ফরজ। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ ইচ্ছে করল রোজা না রেখে ফিদইয়া দান করলে সে রোজার ফরজ পালন না করার অনুমতি পেত। কিন্তু পরবর্তীকালে আল্লাহর বাণী ‘তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি রমজান মাস পাবে, সে যেন রোজা রাখে’-এর দ্বারা ফিদইয়া প্রদানের সাধারণ নিয়ম রহিত হয়ে যায় এবং প্রত্যেক সুস্থ ব্যক্তির প্রতি রোজা রাখাকেই ফরজ বা অপরিহার্য কর্তব্য করে দেয়া হয়। তবে যেসব লোক অতিরিক্ত বার্ধক্যের কারণে রোজা রাখতে অপারগ কিংবা দীর্ঘকাল রোগ ভোগের দরুন দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছে, সেসব লোকের বেলায় ফিদইয়া প্রদানের অনুমতি এখনো বলবৎ আছে বলেই ফুকাহাদের মতৈক্য রয়েছে। এক রোজার ফিদইয়া অর্ধ-সা গম অথবা তৎমূল্য। আমাদের দেশে প্রচলিত আশি তোলার সের হিসেবে অর্থ সা’ হলো এক সের সাড়ে বারো ছটাক। এই পরিমাণ গম অথবা নিকটবর্তী প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী মূল্য মিসকিনকে দান করলেই একটি রোজার ফিদইয়া আদায় হয়ে যায়।
রোজা রাখতে অক্ষম ব্যক্তির জন্যে ফিদইয়াদানের বৈধতা বহাল রাখার কারণ হলো, কোনো ব্যক্তিই যাতে রমজানের ফজিলত থেকে বঞ্চিত না হয়। পবিত্র কুরআনে রোজা সম্পর্কে যতগুলো আয়াত বর্ণিত হয়েছে, বলতে গেলে তার প্রায় সবই সূরায়ে বাকারায় রয়েছে। এসব আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘এগুলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা। এর কাছে-ধারেও যেও না।’
এ আয়াতের দ্বারা রোজাদার ব্যক্তিকে পুনঃ পুনঃ স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, রোজার মধ্যে দিনের বেলায় পানাহার এবং কামাচারসম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞাগুলো কঠোরহস্তে পালন করা বাঞ্ছনীয়। কারণ, এগুলোর কাছে গেলেই রোজা ভাঙার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস সূত্রে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, ‘পবিত্র রমজান মাসে আমার উম্মতকে বিশেষ পাঁচটি সুবিধে প্রদান করা হয়ছে, যা’ পূর্ববর্তী কোনো নবিকেও দেয়া হয়নি।
প্রথমত. মাহে রমজানের প্রথম রাতে আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন। আর আল্লাহ যার দিকে দৃষ্টি দেন, তাকে কখনও শাস্তি প্রদান করেন না। দ্বিতীয়ত. সন্ধ্যাবেলা তাদের মুখ থেকে যে দুর্গন্ধ বের হয়, তা’ আল্লাহ তায়ালার কাছে মেশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। তৃতীয়ত. মাহে রমজানের প্রত্যেক দিনে ও রাতে ফেরেশতাগণ রোজাদারের জন্যে দোয়া করেন। চতুর্থত. আল্লাহ তায়ালা বেহেশতকে বলেন, তুমি আমার রোজাদার বান্দার জন্যে সুসজ্জিত ও প্রস্তুত হও। আমার বান্দারা শিগগিরই দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট থেকে অব্যাহতি পেয়ে আমার সম্মানজনক আশ্রয়ে এসে বিশ্রাম নেবে। পঞ্চমত. রমজানের শেষ রাতে আল্লাহ তায়ালা তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।
আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন
বিভাগীয় প্রধান (হাদীস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।