Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পঞ্চগড়ে নদীখনন; কোন অস্তিত্ব নেই এখন খনন প্রকল্পের

পঞ্চগড় জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৯, ১:৫৭ পিএম

পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বিলুপ্ত নাজিরগঞ্জ ও দই খাতা ছিটমহল এলাকায় করতোয়া নদীর ৫ কিলোমিটার নদী খনন কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তড়িঘড়ি করে কাজ করার ফলে এক বছর অতিবাহিত হতে না হতেই বর্তমানে প্রকল্পের কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্প এলাকায় ঘুরে খননকৃত নদীর কোন নাম নিশানা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড গত বছর করতোয়া নদীর ৫ কিলোমিটার খননের জন্য দরপত্র আহবান করে। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর নারায়ণগঞ্জ সোনাকান্দা বন্দরের ‘ডকইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজটি পার্থ সারথী সেন নামে রংপুরের এক ঠিকাদারের মাধ্যমে করে নেয়। ওই ঠিকাদার আরও পাঁচজনকে শেয়ারে নিয়ে কাজটি তিন মাসের মধ্যেই শেষ করে ফেলেন। ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি খনন কাজ শুরু করে ঠিকাদার। দরপত্র অনুযায়ী চলতি ২০১৯ সালের ৩১ মে (শুরুর এক বছরের মাথায়) প্রকল্পটি শেষ করার কথা। কিন্তু তড়িঘড়ি করে তিন মাসের মাথায় (২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল) খনন কাজ শেষ করে। এরই মধ্যে ৮ কোটি ৮৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও পকেট ভর্তি হয়েছে পানি উন্নয়ন বোডের পঞ্চগড়স্থ নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ বিভাগীয় প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাই নদীর খননকৃত স্থানে স্থানীয়রা এখন বোরো ধানের চাষাবাদ করছেন। নকশা ও যথাযথ নিয়মে কাজ না হওয়ায় বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি অর্থ পানিতেই চলে গেছে।স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের প্রাক্কলন অনুযায়ী ওই এলাকার বারুণী মন্দির এলাকা থেকে কালিয়াগঞ্জ বাজার এলাকা পর্যন্ত করতোয়া নদীর ৫ কিলোমিটার এলাকায় তিন মিটার গভীর ও ৬০ মিটার প্রশস্ত খনন কাজ করার কথা থাকলেও এক মিটারের বেশি খনন করা হয়নি। এমনকি খননের বালি দুইশ মিটার দূরে ফেলার কথা থাকলেও পাশেই ফেলা হয়েছে। ঠিকমতো কাজ না করে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। ফলে খননের এক বছর না গড়াতেই বালিতে নদী ভরে গেছে। নদীতে চর জেগে উঠেছে। আগের চেয়ে নদীর গভীরতা কমেছে। পানি নেই, মাছও নেই।

এদিকে, নদীর চর দখল শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নদীর ৯ একর জায়গা জুড়ে অবৈধভাবে দখল করে বাগান গড়ে তুলেছেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী। এলাকাবাসীদের অভিযোগ, কাজ শুরুর সময় নদী খনন নীতিমালা এবং প্রকল্পের বিধিমালার প্রতি তোয়াক্কা না করে কাজ করা এবং নদী খননে যথাযথ ড্রেজার ব্যবহার না করে ছোট আকারের ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালি ও পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। আর দলাল চক্রের একাধিক সদস্য এই বালি ও পাথর বিক্রি করেও হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা। এতে নদী খনন করে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকার প্রকল্পটি কাগজে কলমে বাস্তবায়িত দেখানো হলেও (পাউবো) প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে।

কাজলদিঘি কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আলাল অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রাক্কলন অনুযায়ী নদী খনন করা হয়নি। খননে অনিয়ম ও ঠিক মতো কাজ না করে টাকা ভাগাভাগি করায় সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে। সরকারে ৯ কোটি টাকা জলেই গেল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।’বিলুপ্ত দইখাতা নাজিরগঞ্জ ছিটমহলের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল খালেক জানান, ‘কাজটা যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদার যোগসাজশ করে বরাদ্দের সিংহভাগ টাকাই লুটপাট করেছেন। যে কাজ হয়েছে তাতে ৩/৪ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়নি। করতোয়া নদী খননের বিষয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। খননকৃত এলাকা তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে পাউবো ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি। খননের পর নদী বালু দিয়ে ভরে যাওয়ায় তীর্থযাত্রী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের স্নানের অবস্থা নেই বলেও তিনি জানিয়েছেন।

বোদা উপজেলার নাজিরগঞ্জ এলাকার আরফান আলী (৭০) বলেন, আগে নদীতে বোরো ধান, পেঁয়াজ ও গম আবাদ করতাম। এখন কোনটাই করতে পারছি না। নদী খনন করে আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। নদী বালু দিয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদী খনন করে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি।

অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, পুরো নদী খনন না করায় ওই ৫ কিলোমিটার খননে কোন লাভ হয়নি এটা ঠিক। তবে নদী খননের ফলে পানির প্রবাহ বেড়েছে। কাজ শেষে বোর্ডের বিশেষ টাক্সফোর্স কর্তৃক পরিমাপ অনুযায়ী বিল প্রদান করা হয়েছে।’ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দার ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রশীদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রকৌশলী এসএম রাশেদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

রাশেদুল হাসান মুঠোফোনে বলেন, ড্রেজিংয়ের এক মাসের মধ্যে ভরাট হয়ে যেতে পারে। তবে কোন অনিয়ম হয়নি।
উল্লেখ্য, নদীটি যে অবস্থায় ছিলো এখন দেখে মনে তেমনি আছে। শুধু বালি ব্যবাসয়ীরা বালি ব্যবসা করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পঞ্চগড়

২৪ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ