Inqilab Logo

শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বেড়েই চলেছে ধর্ষণ

ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই শিশু ও কিশোরী, চলতি মাসে প্রায় একশ’, গত বছর এক হাজার, বিচারহীনতা ও নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

রাজধানীসহ সারাদেশে অস্বাভাবাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্ষণ। নারীর নিরাপত্তা যেন দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। শুধু বয়স্ক নারী নয়, ছোট্ট শিশু ও কিশোররাও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকদের ধারালো থাবা থেকে। আগে বখাটেরা ধর্ষণের সাথে জড়িত থাকলেও এখন শিক্ষক, চিকিৎসক এমনকি আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও নিরাপদ নয় নারী। চলতি বছর প্রথম চারমাসে দেড়শ’র বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও অনেকে লোক লজ্জা ও মান-সম্মানের ভয়ে এসব ঘটনা প্রকাশ করেন না।
ধর্ষণের ঘটনায় শাস্তির সংখ্যাও খুবই কম। যদিও চলতি বছর ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত কয়েকজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। গতকালও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় এক অভিযুক্ত কোচিং শিক্ষক র‌্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। আইন সংশ্লিষ্টদের মতে, অভিযুক্তদের যথাযথ শাস্তি না হওয়া, আইনের শিথিলতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারীর প্রতি পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক অবক্ষয়, পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীললতার ব্যপক প্রসার ও সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে ধর্ষণের মতো মহামারী বেড়েই চলেছে।
গত ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ মাদরাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করলে প্রিন্সিপালের পরিকল্পনায় ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যার চেষ্টার করে তার অনুসারীরা। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত। এ ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ইতোমধ্যে ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। এর আগে নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকায় ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে এক নারীকে গণধর্ষণ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিরোধী দলকে ভোট দেওয়ায় স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে ওই নারীকে ধর্ষণ করা হয়। চলতি বছরের শুরুতে একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত অপরাধের তথ্য রীতিমতো গাঁ শিউরে ওঠার মতো। তাদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত পাঁচ বছর সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিশুরাই বেশি ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে বলে ওই পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৫০ জন নারী ও শিশু। এক তথ্যে দেখা যায়, গত জানুয়ারির প্রথম ১৮ দিনে ২৩টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ১৫ জনই শিশু-কিশোরী। এর মধ্যে দুই বছর বয়েসী শিশুও আছে। চারজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আরেকজন ধর্ষণের পর অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যে দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। পুরো মাসে এ সংখ্যা শ’খানিকের মতো।
গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার উত্তর আমিরাবাদ এলাকায় স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযুক্ত এক কোচিং শিক্ষক র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। গত ১২ এপ্রিল সকালে ওই ছাত্রীর বাসায় গিয়ে তাকে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করে বলে তার মা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন। ধর্ষণের অভিযোগে ১৫ এপ্রিল লোহাগাড়া থানায় মামলাটি করা হয়।
বিয়ের আশ্বাস দিয়ে গত ১০ এপ্রিল সেতু মন্ডল (১৫) নামে এক স্কুলছাত্রীকে লঞ্চের কেবিনে নিয়ে কয়েক দফা ধর্ষণ করে প্রেমিক সজল। পরে বিয়ে না করায় অপমানে ১৭ এপ্রিল কেরানীগঞ্জ এলাকায় নিজের বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে এই ছাত্রী। এ ঘটনায় গত শনিবার হযরত আলী ওরফে সজলকে (২৭) গ্রেফতার করলে সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। নিজের পরিচয় গোপন করে ভিন্ন নামে ওই মেয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছিল সজল।
গত ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে এক পোশাক কারখানার শ্রমিককে ধর্ষণ করে উবার চালক বাদশা (২৪)। কারখানা ছুটির পর মেয়েটিকে তার প্রাইভেট কারে করে ঘুরতে নিয়ে যায়। পরে একটি নির্জন এলাকায় নিয়ে গাড়ির ভেতরে রেখেই একাধিকবার ধর্ষণ করে। এসময় মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এ ঘটনায় মেয়েটির পরিবার আত্মহত্যার প্ররোচনায় মামলা করলে গত শনিবার নগরীর পাঠানটুলি এলাকা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। বাদশা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
একইদিন ২৩ এপ্রিল রাতে রাজধানীর দক্ষিণখানে একটি ক্লিনিকে ১৩ বছর বয়েসী এক শিশুকে হাত-পা বেধে ধর্ষনের অভিযোগ ওঠে এক পল্লী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মেয়েটির পরিবার মামলা করলে পুলিশ গত শনিবার বিজয় কৃষ্ণ তালুকদার নামের ওই চিকিৎসককে গ্রেফতার করে। যদিও ওই চিকিৎসক ধর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
গত ২৪ এপ্রিল রাঙামাটিতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী ইউপি সদস্যকে ধর্ষণ করে তার চাচাতো ভাই। এ ঘটনায় অভিযুক্ত চাচাতো ভাই ঝন্টু চাকমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই নারীর অভিযোগ, তাকে মিথ্যা কথা বলে নগরীর একিট হোটেলে নিয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। চেতনা ফিরলে তিনি নিজেকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পান এবং তখন তার ভাই পাশেই শোয়া ছিল।
এদিকে, গত শনিবার ও গত রোববার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুই ছাত্রীকে নিপীড়ণ ও হয়রানির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় কলাভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের এক ছাত্রী তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেলেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হকের নেতৃত্বে সাতজনের একটি দল তাকে র‌্যাগ দিতে গিয়ে মারধর ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এছাড়া রোববার থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী তার সহপাঠীদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ করেন। দুটি ঘটনাতেই ভুক্তভোগী দুই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর অভিযোগ করেছেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, চলতি বছর শুধু জানুয়ারি মাসে দেশে ৫২টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২০১৮ সালে সারা দেশে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে তারা জানায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে প্রায় ১২৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৩৩ শিশু। এর মধ্যে মারা গেছে ২২ জন। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৫৩ জন শিশুর ওপর। আর ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, হত্যা ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ২৭১ জন শিশু। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৬ জন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলেছে, বিচারহীনতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে সারা দেশে ২৮ প্রতিবন্ধী শিশুসহ ৫৭১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৯৪ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৬ শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। একই বছরে ৮১২ শিশু বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
আইনজ্ঞদের মতে, ধর্ষণের মামলার সঠিক তদন্ত ও বিচারিক কাজ দ্রুত শেষ করা হলে এসব ঘটনা অনেক কমে আসতো।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, যৌন হয়রানির ঘটনা খুবই দুঃখজনক ও ভয়ংকর। এই ধরনের অপরাধ দমনে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম তথা এলাকার জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক বৈঠক করা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নেহাল করিম ইনকিলাবকে বলেন, সম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের ঘটনা বেশি সামনে আসার পেছনে মূলত দুটি কারণ। প্রথমত অন্যান্য সময়ের চাইতে বর্তমানে ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। দ্বিতীয়ত প্রিন্ট ও ইলেকক্ট্রনিক্স মিডিয়ার সংখ্যা বাড়ায় বিষয়গুলো খুব সহজেই আমাদের সামনে আসছে। তিনি বলেন, সাইকোলজিকালি সমাজের মানুষগুলো বেশি অসহিষ্ণু ও হিংস্র হয়ে ওঠায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। তিনি মাদরাসাসহ বিভিন্ন কারিকুলামে নারী সংক্রান্ত বিষয়গুলা অর্ন্তভূক্ত করার মত প্রকাশ করেন।



 

Show all comments
  • রহিম ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
    দেশে বিচার না থাকার কারনে ত্রমন হয়
    Total Reply(0) Reply
  • রহিম ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
    দেশে বিচার না থাকার কারনে ত্রমন হয়
    Total Reply(0) Reply
  • রহিম ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
    দেশে বিচার না থাকার কারনে ত্রমন হয়
    Total Reply(0) Reply
  • রহিম ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
    দেশে বিচার না থাকার কারনে ত্রমন হয়
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ শরীফুজ্জামান ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ২:১০ পিএম says : 0
    ধর্ষণের শান্তি মৃত্যুদন্ড হলেই এই অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্ষণ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ