Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধানের বাম্পার ফলন ধরে রাখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

আল্লাহর অশেষ রহমতে এবার দেশে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবার বোরো আবাদের জন্য জমির পরিমাণ ধরেছিল ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে বেশি জমিতে কৃষকরা ধান ফলিয়েছে। এবার তারা ধান ফলায় ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ১ কোটি ৯৬ লাখ ২৩ হাজার টন। ধানের যে বাম্পার ফলন হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেট আউটলুক: এপ্রিল ২০১৯’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, অনুকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ কম থাকায় চলতি অর্থবছরে চাল উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বাড়বে। সংস্থাটি আভাস দিয়েছে, চলতি বছর দেশে চালের উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। উৎপাদনের দিক থেকে এটি হবে সর্বোচ্চ। এতে গত বছরের চেয়ে চালের উৎপাদন বাড়বে ৭ শতাংশের বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের হাওর অঞ্চলে শতকরা ৭০ ভাগ বোরো ধান চাষ হয়েছে। অন্যদিকে শতকরা ১৫ ভাগ চাষ হয়েছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। বোরো ধানের এ রেকর্ড উৎপাদন থেকে বোঝা যায়, দেশ ধান উৎপাদনে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আর এর মূল কৃতিত্ব, যেসব কৃষক নানা প্রতিকূলতার মধ্যে অদম্য আগ্রহ ও ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে ঘাম ঝরিয়ে ধান ফলিয়েছে তাদের। বলা যায়, তারাই দেশের খাদ্য উৎপাদনের চালিকাশক্তি হয়ে রয়েছে। প্রকৃত অর্থে তারাই ‘জাতীয় বীর’।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কৃষক যদি আগ্রহ নিয়ে ফসল না ফলায় তবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। দেশকে খাদ্যে আমদানি নির্ভর হয়েই থাকতে হতো। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা থাকলেও তাতে যথেষ্ট গলদ থেকে যায়। কৃষি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা কেবল ফসলি জমির টার্গেট এবং উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করে ফলনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধান কেনার দাম নির্ধারণ করে দেয়। এই যে কৃষক বোরো ধান উৎপাদন করে রেকর্ড করেছে, এই রেকর্ডই এখন তাদের গলার কাঁটা বা দুঃখ হয়ে উঠতে পারে। ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে ইতোমধ্যেই তারা নিদারুণ দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে। বাম্পার ফলন ফলিয়েও তারা খুশি হতে পারছে না। মাঠে ৯০ শতাংশের বেশি ধান পেকে গেছে। আশা করা হচ্ছে, রোজার আগেই এসব ধান কাটা হয়ে যাবে। একদিকে সোনালী ধান দেখে কৃষকের যেমন আনন্দ হচ্ছে, অন্যদিকে ধান উঠিয়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রির বিষয়টি নিয়ে তাদের মন খারাপ হচ্ছে। ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার দাবীতে মৌলভীবাজারে হাওর বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও ও কৃষক বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ এক সমাবেশ করে দাবী জানিয়ে বলেছে, চলতি বোরো মৌসুমে সরকার ১৩ লাখ টন ধান/চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করবে মাত্র দেড় লাখ টন। বাকি ধান মিল মালিকের কাছ থেকে ক্রয় কর থেকে দেড় লাখ টন ধান কেনা খুবই সামান্য। মিল থেকে কেনার দাবী জানিয়েছে। বলা বাহুল্য, ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে কৃষকরা বহু বছর ধরে আন্দোলন করছে। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে রাস্তায় ধান ফেলে প্রতিবাদও করেছে। এবারও যদি ন্যায্যমূল্য না পায়, তবে এ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হওয়া অমূলক নয়। এবার তাদের ধান উৎপাদন করতে গিয়ে নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ধান চাষের সময় এবং কাটার সময় শ্রমিক সংকটে পড়তে হচ্ছে। যাদের পাওয়া যাচ্ছে, তাদের পারিশ্রমিকও অত্যন্ত বেশি। যেখানে সারাদেশে ৪০ কেজি বোরো ধানের মূল্য ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, সেখানে শ্রমিকদেরই মজুরি দিতে হচ্ছে ৬০০ টাকা। এর সাথে রয়েছে সার, পানি, বিদ্যুতের খরচসহ অন্যান্য খরচ। এসব খরচ মিলিয়ে ৪০ কেজি ধানের মূল্য অনেক বেশি পড়ে যায়। শ্রমিকদের অতি পারিশ্রমিক এবং সংকট দেখা দেয়ায় কৃষকরা লোকসানের মুখোমুখি হওয়ার আশংকা। ধানের মূল্যের সমান যদি শ্রমিকের পারিশ্রমিক হয়, তবে কৃষক কীভাবে বাঁচবে ? তাদের হতাশ হওয়া ছাড়া কি আর কোনো উপায় থাকে? যে কৃষক বাম্পার ফলন ফলায় তাকে বঞ্চিত করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া কি স্থায়ী করা যাবে?
আমাদের কথা হচ্ছে, ফসল ফলানোর জন্য যে অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশ থাকে, তা যে সবসময় থাকবে, এর নিশ্চয়তা নেই। বছর দুয়েক আগে সিলেটের হাওরে অকাল বন্যায় বাম্পার ফলন ভেসে যেতে আমরা দেখেছি। এর ফলে ভারত থেকে চাল আমদানি করতে হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত সামনে রেখে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থাকে সতর্ক থাকতে হবে। বাম্পার ফলন ধরে রাখতে হলে কৃষককে ভাল রাখতে হবে। ধানের ন্যায্যমূল্যসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে। এই যে বাম্পার ফলন হয়েছে তা ধরে রাখা শুধু মাত্র খাদ্য, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ অন্য সংস্থাগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। এতে সরকারকে পুরোপুরি এগিয়ে আসতে হবে। বাম্পার ফলনের বিষয়টি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা করে তা আরও বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ ফলনে যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়, এজন্য আমদানি বিশেষ করে ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে যাতে চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতীয় চাল প্রবেশ করতে না পারে, এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। ধানের চাষ এবং কাটার সময় শ্রমিকের পারিশ্রমিক নিয়ে যে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে তা নিরসনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে হবে। উন্নত দেশে ফসল চাষ এবং কাটার জন্য অত্যাধুনিক মেশিন রয়েছে। এক মেশিনের মাধ্যমেই জমিতে ফসল কাটা এবং বস্তাজাত করে বাজারজাত করা হচ্ছে। আমাদের দেশে এখন এ ধরনের মেশিনের ব্যবহার জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের মেশিন অনতিবিলম্বে আমদানি করে কৃষককে সহায়তা দিতে হবে। এতে কৃষকের শ্রম যেমন লাঘব হবে, তেমনি উৎপাদন খরচ কমে তারা লাভবান হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধান


আরও
আরও পড়ুন