মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
কালো ও সাদা গোলমরিচ, জায়ফল, লবঙ্গ ও ভ্যানিলার ব্যবসা করে ধনকুবের হয়েছিলেন তিনি। একটি সুন্দর সাদা ভিলায় তার পরিবার বাস করত। চলাফেরা করত সোফার চালিত বিএমডব্লিউতে। দেশসেবায় অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সম্মানিত হয়েছিলেন।
তবে গত বুধবার শ্রীলঙ্কার অন্যতম ধনী মসলা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউসুফ ইব্রাহিমের জীবনের সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, গত ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডেতে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলায় শত শত মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তাকে আটক করা হয়েছে।
একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, ধনকুবের ইব্রাহিমের ছেলেদের মধ্যে দুইজন হোটেল ও গির্জাগুলোতে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ৮ জনের মধ্যে ছিলেন। ইসলামিক স্টেট এ বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছে। তদন্তকারীরা জানান, ইব্রাহিমকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সিরিজ বোমা হামলার দিনই কলম্বোর কাছে তার পারিবারিক ভিলায় পুলিশি হানার সময় এক মহিলা নিজের দুই সন্তানের সামনে বোমা বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দেন। এতে এ সময় কাছাকাছি পৌঁছনো কয়েকজন পুলিশ অফিসারসহ তার দুই সন্তানও নিহত হয় বলে তদন্তকারীরা জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, সন্তানসহ নিজেকে উড়িয়ে দেয়া মহিলা খুব সম্ভবত ইব্রাহিমের কোনো এক ছেলের স্ত্রী।
শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তারা আত্মঘাতী হামলাকারীদের পরিচয় জানাতে অনীহা প্রকাশ করে বলেছেন, তাতে তাদের তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু গত বুধবারে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুয়ান বিজেবর্দেনে বলেন, বোমা হামলাকারীদের অধিকাংশই সুশিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত বা উঁচু শ্রেণির পরিবার থেকে এসেছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ও তাদের পরিবারও আর্থিকভাবে স্থিতিশীল। তারা ডিগ্রিধারী, তাদের মধ্যে এলএলএমও আছে। তারা সবাই সুশিক্ষিত।
শ্রীলঙ্কার তদন্তকারীদের সাহায্য করছে এফবিআই’র একটি দল। তাদের জরুরিভাবে কলম্বোতে উড়িয়ে আনা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত আলাইনা টেপলিজ বলেন, সন্ত্রাসীদের হামলার ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। বিজেবর্দনে বলেন, কিছু লোক এখনো বাইরে থেকে থাকতে পারে। তিনি শ্রীলঙ্কাবাসীদের আরো সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানান।
কর্মকর্তারা বলেন, বোমা হামলাকারীদের সাথে ইসলামিক স্টেটের কী সম্পর্ক ছিল তা তারা নির্ণয় করার চেষ্টা করছেন। আইএস, যা আইএসআইএস নামেও পরিচিত তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায় যে বোমা হামলাকারীদের একজন মোহাম্মদ জাহারান মুখোশধারী ও কালো পোশাক পরা অনুসারীদের সংগঠনে প্রতি আনুগত্য ঘোষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এ হামলা চালানোর আগে মোহাম্মদ জাহারান তেমন সফল কোনো ইসলামী ধর্ম প্রচারক ছিলেন না। পূর্ব শ্রীলঙ্কায় তার গ্রামে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী কথাবার্তার জন্য তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। ভারতীয় তদন্তকারীদের মতে, তিনি ইউটিউবে জঙ্গিবাদ প্রচার করেন। অন্ততপক্ষে একজন ভারতীয়কে ইসলামিক স্টেটের কাছে আসতে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হন।
শ্রীলঙ্কার কিছু মুসলিম নেতা তার প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখছিলেন। তারা বলেন, তিনি ক্ষুদ্র কিন্তু অনুগত কিছু অনুসারী তৈরি করেন। গত বুধবার পর্যন্ত ইসলামিক স্টেট হামলা চালানোর দায় স্বীকার করলেও আর কোনো প্রমাণ প্রদর্শন করেনি। সে সময় শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তারা ২৫০ থেকে ২৬০ জন নিহত হওয়ার কথা বলেছিলেন। গত বৃহস্পতিবার নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৯ হয়।
বিজেবর্দেনে বলেন, তদন্তকারীরা জানতে চাইছেন যে ইসলামিক স্টেট হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ বা অর্থ দিয়েছিল কিনা। তবে ইসলামিক স্টেটের পক্ষে যুদ্ধ করতে হামলাকারীদের মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার কোনো প্রমাণ তারা পাননি। একজন পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, সৈনিক পদসহ ইসলামিক স্টেটের বিভিন্নপদে কাজ করা কয়েক ডজন শ্রীলঙ্কান সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন।
গত ২১ এপ্রিল ৩টি গির্জা ও ৩টি হোটেলে যুগপৎ বোমা হামলা চালানো হয়। একটি এত শক্তিশালী ছিল যে তা গির্জার ছাদ উড়িয়ে দেয়। ফলে ভারি টাইলসগুলো ভেঙ্গে মানুষজনের মাথায় পড়ে। একটি স্বল্প পরিচিত স্থানীয় গ্রুপ কীভাবে এ রকম ভয়াবহ হামলা চালাল সে রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।
মাত্র এক দশক আগে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে আসা শ্রীলঙ্কা অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছে। বোমা হামলার স্থানগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত স্কুলগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। ডাক বিভাগ বলেছে, ডাকযোগে কোনো জিনিস পাঠাতে হলে তা ডাকঘর কর্মীদের সামনে মোড়কবদ্ধ করতে হবে।
শ্রীলঙ্কায় নিহতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলছে। বহু শোকপালনকারী সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রোধ প্রকাশ করেছে। কয়েকটি স্থানে খ্রিস্টানরা মুসলমানদের উপর হামলা শুরু করেছে। তার ফলে বহু মুসলমান নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। গণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় নিহতদের প্রতি শোক জানাতে হামলার শিকার সেন্ট সেবাস্টিয়ান গির্জায় সারা সকাল লোকজনের ভিড় দেখা যায়।
এক শোকাকুল নারী তার কান্না রোধ করতে পারছিলেন না। তিনি পুলিশদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করছিলেন। হামলার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি পেয়েও কাজ না করার জন্য তিনি তাদের দায়ী করেন। এই হামলার আশঙ্কা সম্পর্কে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। ভারতীয় গোয়েন্দারা গত বছর এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল যে ইসলামিক স্টেটের সাথে সম্পর্কিত ছিল। সে বলেছিল যে সামাজিক মাধ্যমে জাহারানের ভিডিও দেখে সে উৎসাহিত হয়েছিল। সে তথ্যের প্রেক্ষিতে জাহারানের ব্যাপারে তদন্ত করা হয়। তারই ভিত্তিতে ভারতীয়রা গির্জায় হামলার ব্যাপারে শ্রীলঙ্কাকে হুঁশিয়ার করে দেয়।
এ হুঁশিয়ারির বিষয়টি গির্জা কর্মকর্তাদের জানানো হয়নি বা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদেরও ব্যাপকভাবে অবহিত করা হয়নি। দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ বিষয়ে জানতে পারেননি। ভারতীয়রা নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বরসহ সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়ার পরও শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জাহারানের গ্রুপটির ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলেই মনে হয়। তারা গির্জাগুলোতে নিরাপত্তাও জোরদার করেনি। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, হামলার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই ভারতীয়রা আবারো হামলার হুমকির কথা জানায়।
গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য তিনি কমপক্ষে আংশিক দায়ী বলে সমালোচনা খন্ডন করেন। তিনি স্বীকার করেন যে এ হামলার ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। কিন্তু অধীনস্থরা এ বিষয়ে তাকে অবহিত করেননি।
প্রেসিডেন্টের অফিসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, গত বুধবার প্রেসিডেন্ট প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেমাসিরি ফার্নান্দো ও পুলিশের আইজি পুজিথ জয়াসুন্দরাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। বিজেদাসা রাজাপাকসে নামের এক আইন প্রণেতা দুইজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানান।
অনেক আইন প্রণেতা হামলার হুমকির মেমো সম্পর্কে না জানার প্রেসিডেন্টের দাবি বাতিল করে দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা ঘাটতির দায় সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বর্তায়। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায়ে সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন শরত ফনসেকা। এখন তিনি পার্লামেন্ট সদস্য। তিনি গত বুধবার পার্লামেন্টে বলেন, গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে প্রেসিডেন্ট হুমকি মেমো সম্পর্কে জানতেন। তিনি বলেন, অবশ্যই সে চিঠি প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিরিসেনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ইবরাহিম ও তার পরিবার সম্পর্কে তদন্ত বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সামান্যই জানাচ্ছেন। তিনি কলম্বোর ব্যবসায়ী মহলের একজন বিশিষ্টজন ও তার রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে।
শ্রীলঙ্কার একটি রাজনৈতিক দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা পার্লামেন্টের একটি আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার জন্য তাকে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিল। তবে উপযুক্ত আসনে তাকে মনোনীত করার জন্য যথেষ্ট ভোট পাওয়া যায়নি। দলের এক নেতা ভিজিথা হেরাথ বলেন, তিনি এ হামলায় ইবরাহিমের বা তার ছেলেদের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে জানেন না। ইবরাহিম একজন ধনকুবের ও স্বীকৃত ব্যবসায়ী। তার ছেলেরা কি করেছে তা তিনি জানতেন না। ছেলেরা অনেক কাজ করে যা বাবার জানার কথা নয়।
অন্যরা ইবরাহিমের সাথে আগে সম্পর্ক থাকলেও এখন দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আগ্রহী বলে মনে হয়। ২০১৬ সালে ইবরাহিমকে প্রেসিডেন্টের রফতানি পুরস্কার দেয়া হয়। প্রতিমন্ত্রী সুজিওয়া সেনাসিংহের সাথে সে সময় তার ছবি তোলা হয়। টেলিফোনে তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ক্ষেপে গিয়ে তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। আমরা বহুজনকে বহু পুরস্কার দেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।