পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
১৯৪৭ সালে ভারত কেন ভেঙে গেল, সেকথা আজ তুলে আর কি কোনো লাভ আছে? অনুরূপভাবে পাকিস্তান কেন ভেঙে গেল, সেসব প্রশ্ন তুলেও আর কোনো লাভ নাই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারপরেও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এসব প্রশ্ন তুলছেন। ভারতের সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন দল তাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করছেন। কিন্তু এই নির্বাচনী প্রচারণা এবং নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ করেছেন যে, কংগ্রেসের ভুলের কারণেই ভারত ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে ৭২ বছর আগে। তেমনি পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে ৪৮ বছর আগে। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্টের আগে ভারতীয় উপমহাদেশ একটি মাত্র দেশ ছিল। আজ সেই উপমহাদেশ ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে ৩টি দেশ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন, অথবা যার ভুলেই উপমহাদেশ ভেঙে খান খান হোক না কেন, এই ৩টি দেশ আজ এক জ¦লন্ত রিয়েলিটি। ভাঙা জিনিস তো আর জোড়া লাগে না। কাজেই উপমহাদেশ যখন ভেঙেছে তখন সেটিকে আর জোড়া লাগানো যাবে না। জোড়া লাগাতে হলে প্রথমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে জোড়া লাগিয়ে অবিভক্ত পাকিস্তানে ফেরত যেতে হবে। তারপর পাকিস্তানকে জোড়া লাগিয়ে অবিভক্ত ভারতে ফেরত যেতে হবে। এটা অবাস্তব এবং অসম্ভব। তবুও নরেন্দ্র মোদির মতো, অর্থাৎ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যখন এমন কথা বলেছেন, তখন সেই কথা নিয়ে একাডেমিক পর্যায়ে হলেও একটি আলোচনা হতেই পারে। তিনি বলেছেন যে, কংগ্রেসের ভুলের কারণেই ভারত ভেঙেছিল। কথাটা আংশিক সত্য, সর্বাংশে সত্য নয়। আসুন, তার উক্তি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
ভারত ভাগের অনেকগুলো কারণ আছে। সবগুলো কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে এই রকম একটি নয়, অনেকগুলো কলাম লেখার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে গত ২০১৭ সালের ৩০ অগাস্ট বিবিসি একটি আলোচনার অবতারণা করেছিল। বিবিসির মতে, প্রধানত সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং পন্ডিত জওহর লাল নেহরুর কারণেই ভারত বিভক্ত হয়েছিল। বিবিসির রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত আলোচনা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাদের ৩ জন পূর্ণ মন্ত্রীকে ভারতে পাঠায়। এই ৩ জন মন্ত্রী ইতিহাসে ক্যাবিনেট মিশন নামে পরিচিত হয়ে আছেন। একই বছরের অগাস্ট মাসে পন্ডিত নেহরুর নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হয়। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রথমে সেই সরকারে জয়েন করতে রাজি হয়নি। তবে বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগ সেই অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেয়।
ক্যাবিনেট মিশন একটি প্ল্যান নিয়ে ভারতে আসে। ঐ প্ল্যানে ভারতকে এ, বি ও সি নামে ৩টি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে ভাগ করা হয়। মুসলিম লীগের প্রধান নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করেন। কিন্তু কংগ্রেসের প্রধান নেতা পন্ডিত নেহরু এই প্ল্যান প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেস এই প্ল্যান প্রত্যাখ্যান করলে মুসলিম লীগও সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। অতপর মুসলিম লীগ সরাসরি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট মুসলিম লীগ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয়।
তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অবিভক্ত ভারতবর্ষের সমস্ত প্রাদেশিক সরকার প্রধানকে চিফ মিনিস্টার বা মুখ্যমন্ত্রী বলা হতো। শুধু মাত্র অবিভক্ত বাংলার সরকার প্রধানকে প্রাইম মিনিস্টার বা প্রধানমন্ত্রী বলা হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং সোহরাওয়ার্দী এই দিবসটি শান্তিপূর্ণ এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে পালনের আহবান জানান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্তে¡ও দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে প্রশাসনযন্ত্রকে মোটেই ব্যবহার করেননি। কিন্তু বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে মুসলমানদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। অনেক বাঙালি মুসলমান নিহত হন। একপর্যায়ে মুসলমানরাও আত্মরক্ষার তাগিদে ঘুরে দাঁড়ান এবং ফলে কিছু হিন্দুও নিহত হন। এর পর এই দাঙ্গা নোয়াখালীতেও ছড়িয়ে পড়ে। এই পটভূমিতে ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন নতুন ভাইসরয় হিসেবে ভারতে আসেন। তখন থেকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন মোড় নেয়।
দুই
১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ। তখনকার ঘটনাবলী নিয়ে তিনি ইংরেজিতে একটি বই লেখেন। বইটির নাম, ‘ওহফরধ রিহং ভৎববফড়স’, অর্থাৎ ‘ভারত স্বাধীন হলো’। বইটি তখন লিখলেও মওলানা আজাদ বলে যান যে, পরবর্তী ৩০ বছরে যেন বইটি প্রকাশ করা না হয়। ৩০ বছর পর বইটি প্রকাশিত হলে অনেক অজানা তথ্য উদঘাটিত হয়।
মওলানা আজাদ তার পুস্তকে বলেন, ক্যাবিনেট মিশন এ, বি, সি প্ল্যানের মাধ্যমে ভারতকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে এই স্বায়ত্তশাসনই স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হতো। কিন্তু মাউন্ট ব্যাটেন ভাইসরয় হয়ে আসার পর ব্রিটিশদের চিন্তা ধারা বদলাতে থাকে। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানে বাংলা এবং আসামকে একটি প্রশাসনিক ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। মওলানা আজাদ বলেন, মতদ্বৈধতা নিরসনের জন্য লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন মধ্যস্থতার জন্য উপযুক্ত বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু নেহরু এবং প্যাটেল এই মধ্যস্থতার প্রস্তাবে রাজি হননি।
অন্তর্বর্তী সরকারে সরদার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং লিয়াকত আলী খান অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিছুদিন পরই কংগ্রেস বলতে শুরু করে যে, লিয়াকত আলী খানের হাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া বিরাট ভুল হয়েছে। কারণ, তিনি কংগ্রেসের কার্যকলাপে সহযোগিতা করছেন না। এসব নিয়ে প্রশাসনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে মিস্টার প্যাটেল ধরেই নিয়েছিলেন যে, শুধু মন্ত্রিসভায় কেন, সারা ভারতবর্ষে হিন্দুরা মুসলমানদের সাথে এক সাথে কাজ করতে পারবে না। মওলানা আজাদের বয়ানে জানা যায় যে, সরদার প্যাটেল এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে বলে ফেলেন যে, মুসলমানদের সাথে এক সাথে কাজ করতে না পারলে ভারত বিভক্তি ছাড়া কোনো উপায় নাই। মওলানা আজাদের মতে, ভারত বিভাগের প্রধান স্থপতি ছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।
ঠিক এই স্থানে মওলানা আজাদ একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন, যেটি তার পুস্তিকা প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ জানতো না। তিনি বলেন যে, সরদার প্যাটেল ভারত ভাগ করায় রাজি হলেও পন্ডিত নেহরু ছিলেন ভারত বিভক্তির ঘোরতর বিরোধী। মাউন্ট ব্যাটেন এবং প্যাটেল তাকে বারবার বোঝালেও নেহরু ভারতের অখন্ডতার ব্যাপারে ছিলেন অনঢ়। এখানে মওলানা আজাদ প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহর লাল নেহরু শেষ পর্যন্ত কীভাবে রাজি হলেন? মওলানা আজাদ মনে করেন, এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত; জওহরলাল নেহরুকে রাজী করানোর বিষয়ে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের স্ত্রীর একটি বড় ভূমিকা ছিল। লেডি মাউন্ট ব্যাটেন ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। এছাড়া তিনি ছিলেন খুবই আকর্ষণীয়। তাঁর মধ্যে যে আকর্ষণী শক্তি ছিল সেই শক্তি দিয়ে তিনি অন্যদরেকে প্রভাবিত করতে পারতেন। নেহরুর সাথে লেডি মাউন্ট ব্যাটেনের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যখন মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে একমত পোষণ করতে না পারতেন তখন লেডি মাউন্ট ব্যাটেন তাদের সাথে কথা বলতেন এবং তার সম্মোহনী শক্তির বলে তাদের সম্মতি আদায় করতেন। নেহরুকে রাজি করানোর ব্যাপারে আর এক ব্যক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছিল। মওলানা আজাদের মতে তিনি হলেন, কৃষ্ণ মেনন। কৃষ্ণ মেনন পন্ডিত নেহরুকে কিছুটা নরম করর্তে সমর্থ হয়েছিলেন।
তিন
আমি প্রথমেই বলেছি যে, ভারত ভাগ করার পেছনে একাধিক কারণ ছিল। কিন্তু একটি মাত্র কলামে সেগুলি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই আজ আমি দুই একটি কারণ নিয়ে আলোচনা করছি।
সকলেই জানেন যে, ভারত বিভক্তি বলতে বুঝিয়েছে তৎকালীন অবিভক্ত পাঞ্জাব এবং বাংলার বিভক্তি। মুসলিম লীগের সব শ্রেণির নেতা বাংলার বিভক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। পক্ষান্তরে কংগ্রেসে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাই শরৎচন্দ্র বসু এবং কিরণশঙ্কর রায় বাংলাকে এক রাখার পক্ষে ছিলেন। মুসলিম লীগ বাংলাকে এক রাখার পক্ষে থাকলেও এব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগরে জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিম। আবুল হাশিম ছিলেন বাংলাদেশের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন ওমরের পিতা। যাই হোক, বাংলাকে এক রাখার ব্যাপারে সম্মতি আদায় করার জন্য সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম জিন্নাহ সাহেবের সাথে দেখা করেন। জিন্নাহ সাহেব বাংলাকে এক ও অবিভাজ্য রাখার পক্ষে মত দেন। তিনি এও বলেন যে, বাংলা যদি পাকিস্তানে জয়েন নাও করে এবং তারপরেও অবিভক্ত থাকে তাহলে তাতেও তার মত রয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাকে এক রাখার পক্ষে সম্মতি আদায়ের জন্য কিরণশঙ্কর রায় এবং শরৎ বসু দিল্লিতে যান এবং নেহরু ও প্যাটেলের সাথে দেখা করেন। নেহরু এবং প্যাটেল হিন্দু মুসলিম ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেন এবং স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার জন্য কিরণশঙ্কর ও শরৎ বসুকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করেন।
বাংলাকে ভাগ করার ব্যাপারে নেহরু এত অনড় ছিলেন কেন? কারণ, নেহরু ভেবেছিলেন যে, যদি বাংলা ভাগ হয় এবং বাংলার পূর্বাংশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলা যদি পাকিস্তানের ভাগে পড়ে তাহলে পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে ২৫ বছরও টিকতে পারবে না। ২৫ বছর পর তাকে ভারতে যোগ দিতে হবে।
অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলা ২৫ বছরই টিকে ছিল। ২৫ বছর পর সে বেরিয়ে গেছে সত্য, কিন্তু ভারতে যোগ দেয়নি। স্বাধীন দেশ হিসাবে ৪৮ বছর ধরে গৌরবের সাথে টিকে আছে সেদিনের পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে নেহরু বাংলাকে ভাগ করেছিলেন তার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।