পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নদীর দখল-দূষণ নতুন কিছু নয়। দেশের নদ-নদী বিলুপ্ত করে দেয়ার এ দুটি অপকর্ম যুগের পর যুগ ধরে চলছে। এ নিয়ে পরিবেশবিদরা যেমন অনেক প্রতিবাদ ও আন্দোলন করছেন, তেমনি পত্র-পত্রিকাগুলোও অনবরত নদীর দুঃখ কথা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং করছে। তাতে নদ-নদীর দখল ও দূষণের সঙ্গে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের কোনো ধরনের বিচলন হয়নি। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখল ও দূষণ বন্ধে উচ্চ আদালত বেশ কয়েকবারই নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে অনেকবার কথা বলেছেন। গত বৃহস্পতিবার নদী দূষণ বন্ধে সকলের প্রতি পুনরায় আহবান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব নদী দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই সকলকে বলব, নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি তিনি এ কথাও বলেছেন, ভবিষ্যতে আমরা পানি রফতানি করব। যেসব দেশে সুপেয় পানির অভাব রয়েছে সেসব দেশে বোতলজাত করে পানি রফতনির উদ্যোগ নেয়া হবে। নদী দূষণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য অত্যন্ত ইতিবাচক এবং আমরা স্বাগত জানাই। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এখন বিভিন্ন ধাপে রাজধানীর চারপাশের নদী অবৈধ দখলমুক্ত করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই চলছে। নদী দখলমুক্ত করার এ উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অব্যাহত রাখবে এটা আমাদের প্রত্যাশা।
এক সময় জালের মতো বিস্তৃত আমাদের নদীগুলোকে দেশের জন্য দুঃখ হিসেবে ধরা হতো। বন্যা ও ভাঙ্গণে জনপদ নিমজ্জিত ও বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণেই এমনটি বলা হতো। এখন এই নদীই দখলকারীদের অবৈধ দখল ও দূষণের কারণে শুকিয়ে মরে, দূষিত হয়ে দুঃখের কারণ হয়ে উঠেছে। একদিকে ভারতের বৈরি পানিনীতি, অন্যদিকে অবৈধ দখল ও দূষণ নদীর অস্তিত্ব বিলীন করে দিচ্ছে। অথচ সুপেয় ও মিষ্টি পানির প্রাচুর্য্যরে দিক থেকে আমাদের দেশের মতো বিশ্বে খুব কম দেশই রয়েছে। বিশ্বে দিন দিন সুপেয় পানির অভাব প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তবে তা হবে সুপেয় পানির ওপর দখলদারিত্ব নিয়ে। এজন্য সুপেয় পানিকে তারা ‘নেক্সট ওয়েল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ বিবেচনা করলে আমাদের দেশ এই নেক্সট ওয়েলের অফুরন্ত ভান্ডার। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বের অধিকাংশ সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে কেন্দ্র করে। মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শহর, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই নদীকেন্দ্রিক। অথচ আমাদেরই একটি শ্রেণী ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে প্রতিনিয়ত নদী দখল ও দূষণ করে চলেছে। বলা যায়, নদীকে হত্যা করে চলেছে। ধ্বংস করছে পরিবেশ-প্রতিবেশ, মানুষের জীবন-জীবিকা ও জীববৈচিত্র্য। এক রাজধানীতে প্রতিদিন যে হাজার হাজার টন ও লিটার গৃহস্থালী ও শিল্প কারখানার সলিড ও লিকুইড বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তার বেশিরভাগই ফেলা হচ্ছে আশপাশের নদীগুলোতে। বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে যদি তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে, এটি যেন আলকাতরার নদীতে পরিণত হয়েছে। মনে হবে, বর্জ্য নিষ্কাশনের কোনো বৃহৎ ড্রেন। হাজারীবাগ ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্যে নদীটি ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়ে। এ দূষণ থেকে নদীটিকে রক্ষার জন্য ট্যানারিশিল্প স্থানান্তর করে সাভারে নেয়া হয়। দেখা যাচ্ছে, সেখানেও যথাযথ বর্জ্য পরিশোধনাগার না করার কারণে আরেকটি নদী ধলেশ্বরী ও এর আশপাশের এলাকা দূষণ করে চলেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর স্বাভাবিক স্রোতপ্রবাহ ঠিক রাখার জন্য সারাবছরই ড্রেজিং করে চলেছে। এ ড্রেজিং নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। যথাযথভাবে ড্রেজিং না করা, ড্রেজিং করা নদীর মাটি যথাস্থানে না রেখে নিকটে রেখে দেয়াসহ নানা অনিয়ম পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে ড্রেজিং তো ঠিকমতো হচ্ছেই না, উল্টো রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। এর সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তারা ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করার জন্য রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করে দিচ্ছে। অন্যদিকে শিল্পকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল পরিশোধন করে নদীতে ফেলার কথা থাকলেও অনেক শিল্পকারখানা তা করছে না। এগুলোর অপরিশোধিত কেমিক্যাল সরাসরি নদ-নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কার্যকর করা হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে এবং তা বন্ধ না করা হয়, তবে দেশের বিদ্যমান অনেক নদীই বিষাক্ত নালায় পরিণত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। প্রকৃতির অপার দান নদ-নদী আমাদের জন্য কত বড় রহমত তা নদী-দখল ও দূষণকারীরা বুঝতে পারছে না। বিশ্বের এমন অনেক দেশ রয়েছে, যারা একটি নদীকে বাঁচাতে হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ মরুভূমিতে খাল কেটে সাগর থেকে পানি আনছে। ইউরোপ-আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় এক বোতল পানির দাম এক বোতল বিয়ারের দামের চেয়েও বেশি। এসব দেশের অনেককে দিনের পর দিন কেবল বিয়ার খেয়েই বেঁচে থাকতে হয়। অথচ আমাদের দেশে প্রকৃতি সুপেয় ও মিষ্টি পানির যে নদ-নদী দিয়েছে তা আমরা রক্ষা করতে পারছি না। যত ভাবে পারা যায়, দূষণ করে চলেছি। এই দূষণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আহবান জানিয়েছেন, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর করতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নদী হত্যা, নদীকেন্দ্রিক জনবসতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হত্যার শামিল। দখল-দূষণের মাধ্যমে নদী হত্যার যে ধারাবাহিকতা চলছে, তা বন্ধে অনতিবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করার যে আহবান জানিয়েছেন, এ আহবানকে জনমতে রূপ দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। একে স্লোগানে পরিণত করতে হবে। নদী দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে-এই বোধ নিয়ে নদী রক্ষায় সরকারের উদ্যেগের সঙ্গে দেশের মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে। নদী-সন্নিহিত এলাকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি, পৌরসভাসহ ইউনিয়ন পরিষদকে নদীর দূষণ রোধে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। দেশে বিদ্যমান যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে, এগুলোর বিষাক্ত বর্জ্য যথাযথভাবে পরিশোধন করা হচ্ছে কিনা তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে খতিয়ে দেখতে হবে। যারা সরাসরি নদীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা দিতে হবে। দেশে আরও যে একশটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার কাজ চলছে, এ শিল্পাঞ্চলগুলোর বর্জ্য যাতে যথাযথভাবে পরিশোধন করার ব্যবস্থা থাকে তা আগে থেকেই নিশ্চিত করতে হবে। দেশের শিল্পকারখানাসহ সব ধরনের উন্নয়ন কাজই হবে, তবে তা যাতে নদ-নদীর ক্ষতির কারণ হয়ে না হয়, এদিকে সকলকে নজর দিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।