Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবক্ষয়-অনাচারের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু করতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

যে ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় একটি রাষ্ট্র ও সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধাবস্থা দেখা দিতে পারে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকি সে ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন? একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনের একটা গণপ্রত্যাশা ছিল। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বিহিন, ভোটার বিহীন একপাক্ষিক দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই দেশি-বিদেশি স্টেকহোল্ডারদের তরফ থেকে এ ধরণের সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার পক্ষে চাপ সৃষ্টি হলেও এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কখনো ইতিবাচক মনোভাব দেখা না যাওয়ার প্রেক্ষাপটে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছিল কোনো কোনো বিদেশী গণমাধ্যম আরেক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধাবস্থা তৈরীর কথাও লিখেছিল। গ্রহণযোগ্য, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের স্বার্থে বিরোধিদল, জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ন্যায্য কোনো দাবী না মানার পরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে দেশে-বিদেশে অনেকেই বিষ্ময় প্রকাশ করেছিল। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর শেষ মুহূর্তে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সংলাপে সবাই প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক আশ্বাসে বিশ্বাস করেই সবাই নির্বাচনে নেমে পড়েছিল। অত:পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতির সামনে, বিশ্বের সামনে কী রূপে আর্বিভ’ত হল তা নতুন করে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়ে না। গণতান্ত্রিক বিশ্বের নির্বাচনের ইতিহাসে বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচন এক অভ’তপূর্ব ও অনাকাংঙ্খিত রোল মডেল হয়ে থাকবে। পর পর দুটি জাতীয় নির্বাচন এবং বেশ কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেন নি। কোটি কোটি তরুণ ভোটার, নবীন নতুন ভোটারের মধ্যে পসন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারার যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে তাতে যদি আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থিতিশীল হয়ে উঠাও অস্বাভাবিক ছিল না। তা কিন্তু হয়নি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত আমাদের সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। পদ্মাসেতু সহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প ক্রমে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সেই সাথে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে আরো অনেক কিছুই। প্রায় তিন দশক পর দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী সংসদ(ডাকসু) নির্বাচনও অনেকটা নিরবেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো মার্চের ১১ তারিখে। ডাকসু নির্বাচনে যে ধরনের রাজনৈতিক আবহ, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে সরগরম প্রচারনা অতীতে দেখা যেত তার অনেকটাই ঘাটতি ছিল এই নির্বাচনে। ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সব ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের জোরালো দাবী তোলা হলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের যৌক্তিক দাবীকে অগ্রাহ্য করে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত হলগুলোতেই ভোটকেন্দ্র স্থাপন করে ডাকসুর হল সংসদ নির্বাচনের জাতীয় নির্বাচনের মত সিল মারার নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে ছাত্রলীগ। ডাকসু নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার হওয়ার প্রেক্ষাপট ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনড় অবস্থানের কারণে ডাকসু ভিপি পদে ছাত্রলীগ প্রার্থীকে হারিয়ে কোটা আন্দোলনের নেতা নূরুল হক নূরের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ঘটনার মোড় অনেকটাই ঘুরে যায়। নবনির্বাচিত ডাকসু নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রনে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাতে গিয়ে ডাকসু সরকারের একটি পরিকল্পিত রাজলনৈতিক মোড়ক লাভ করে। তবে ছাত্রলীগ কর্মীিে সেই মোড়কে কালিমালেপন করতেও দ্বিধা করেনি। পহেলা এপ্রিল এসএম হলের এক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধরের শিকার হয়ে আহত হলে ভিপি নূরের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিলসহ হলপ্রভোস্টের কাছে বিচার দাবী করতে গেলে নূরুল হক সহ বেশ কয়েকজনকে লাঞ্ছিত করে এবং গভীর রাত পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখে। কোনো ছাত্র সংগঠনের হল কমিটির হাতে ডাকসুর কোনো নির্বাচিত ভিপির লাঞ্ছিত ও কয়েক ঘন্টা ধরে অবরুদ্ধ থাকার ঘটনাও নজির বিহীন।
মাছের মাথা থেকেই নাকি তার পচন দেখা দেয়। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজদেহের যে বিনাশি পচন ও অবক্ষয় মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে তার সুত্রপাতও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলন থেকে উত্তাল হয়ে উঠা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শাসকের রক্তচক্ষু, পুলিশের ব্যারিকেড, লাঠি-গুলি উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গণতান্ত্রিক ঐক্যের সেই ভিত্তি ভ’মি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাকসুকেই রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর করে ফেলা হয়। প্রায় ৩ দশক পর ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের কলঙ্ক ঘুঁচিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিবাচক নবযাত্রা সুচিত হবে। এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব তৈরীর মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠবে বলে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল। ডাকসু নির্বাচনের মান, নির্বাচনের পর ঢাবি ক্যাম্পাসে ন্যক্কারজনক ঘটনাবলী সে প্রত্যশার জায়গায় নতুন হতাশার জন্ম দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু, স্থিতিশীল ও সহাবস্থানমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সরকারের ছত্রছায়ায় ক্যম্পাসে সরকারীদল সমর্থক শিক্ষক এবং ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা নির্দলীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেন দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক। বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নজির আছে কি না আমাদের তা জানা নেই। বছরের পর বছর ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সহাবস্থানের বদলে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ন্যুনতম সুযোগেই ডাকসু ভিপি পদসহ বিভিন্ন হল সংসদের নেতৃত্ব ছাত্রলীগের হাতছাড়া হয়ে গেছে। নির্বাচনের দাবী আছে দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই। সম্ভবত: এ কারণেই দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও আত্মকলহ, কোথাও কোটা আন্দোলন বা সাধারণ শিক্ষার্থী, কোথাও পুলিশের সাথে সংঘাতে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। সর্বত্রই সংঘাত-অস্থিরতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। জাতির ইতিহাসের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসা সবচেয়ে প্রাচীন ছাত্র সংগঠনটি এখন মানুষের কাছে একটি আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির মত ছাত্রদল -ছাত্র শিবির ক্যাম্পাসগুলোতে অনেকটা আত্মগোপণে থাকলেও অরাজনৈতিক ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবর্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠায় সম্ভবত এই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ছাত্রলীগ যেন তাদের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জই রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত নয়। হামলা ও বর্বরতার মাধ্যমে তারা গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের পরিবেশকে বাঁধাগ্রস্ত করতেই যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। গত রবিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সাথে ছাত্রলীগের সংর্ঘষে ৫ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। একই সময়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরের ডুয়েট ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের কোন্দল ও ছাত্র বিক্ষোভে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো চর্চা নেই, নির্বাচন ব্যবস্থার উপর জনগনের আস্থা শুণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে, বিনিয়োগ ও অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোতে মন্দা দেখা দিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নতুন করে সংঘাত-সংর্ঘষের রণক্ষেত্রে পরিনত হতে দেখা যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় ডিজিটাল, সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল, টেকসই উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন ও রূপকল্প বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ কোন পথে?
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে নোয়াখালীর সুবর্ণ চরে চার সন্তানের জননী এক নারীকে স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মীরা গণধর্ষণ করেছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে এই ঘটনা বিশেষ জাতীয় ইস্যুতে পরিনত হয়েছিল। কোটি কোটি মানুষের বিবেক ও হৃদয়কে নাড়া দেয়া সে ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে জনরোষ কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও প্রধান আসামীকে মামলার মূল এজাহার থেকে বাদ রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে চেষ্টা-তদ্বিরের অভিযোগও উঠেছিল। সেই সুবর্ণচরেই এবার উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থধাপে দুই স্বতন্ত্র ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের দ্বন্দের জেরে ৬ সন্তানের জননী মধ্য বয়েসী এক নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। কার্যত নিরুত্তাপ, প্রতিদাবন্দিতাহীন, ভোটারদের প্রত্যাশিত অংশগ্রহণ ছাড়াই এবার সারাদেশে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মধ্যে ন্যুনতম সহাবস্থান এবং ভোটারদের নির্ভয়ে নিজের ইচ্ছামত ভোট দেয়ার নজির দেখা যায়নি। এবারের উপজেলা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দিতা মূলত আওয়ামীলীগ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামীলীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্থানীয় নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যাচ্ছে। অতএব এসব নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের কোনো আগ্রহ না থাকায় ভোটকেন্দ্রগুলো দিনভর ফাঁকাই দেখা যাচ্ছে। তবে দিনশেষে বিষ্ময়করভাবে হাজার হাজার ভোটে পাস করার খবরগুলো রসালো কৌতুকের জন্ম দিচ্ছে। রাতে নাকি দিনে সিল মেরে, কর্মীবাহিনী দিয়ে জালভোট মেরে বাক্স ভরা হয়েছে, নির্বাচনের পর তা নিয়েই বাজারে চায়ের স্টলে জমজমাট গল্প জমে উঠতে দেখা যায়। এভাবে দেশের নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগনের কাছে একটি ব্যঙ্গাত্মক অভিধা লাভ করেছে। নির্বাচন ও রাজনীতির এই একতরফা অবক্ষয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সামাজিক-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর চরম আঘাত হয়ে দেখা দিচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় এর চরম বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রকাশ্য ক্যাম্পাসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ছাত্রীকে রক্তাক্ত জখম করার ঘটনা, মেয়েকে ধর্ষণ করার পর বিচার চাইতে গেলে মা ও মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করে শহর থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও ছাত্রলীগ-যুবলীগ ঘটিয়েছে। গণমাধ্যমের ভাইরাল ভিডিও এবং মানুষের ধিক্কারের চাপে বদরুল, তুফান সরকার বা রুহুল আমীনরা গ্রেফতার হলেও তাদের সহযোগী-সহযাত্রীরা দ্বিগুন উৎসাহে একই রকম ন্যক্কারজনক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গত রবিবার রাজধানীর হাজারি বাগ থেকে তিন ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করেছে পুলিশ। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বানিজ্য, মাদক ব্যবসা ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী এইসব সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগের মত একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনে আশ্রয় পেতে পারে না। সন্ত্রাসী, ধর্ষক ও চাঁদাবাজের কোনো দল নেই। এদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনগতভাবে প্রতিহত করে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে।
সমাজে, রাষ্ট্রে, রাজনীতিতে ও লোকাচারে অনৈতিকতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি একদিনেই তৈরী হয়না। এটি দীর্ঘদিনের সামাজিক-রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার ফসল। সর্বক্ষেত্রে একতরফা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার চুড়ান্ত রূপ হচ্ছে এই সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সর্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা। রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ীর চাকায় পিষ্ট হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যত্রতত্র আক্রান্ত, রক্তাক্ত ও প্রাণসংহারের শিকার হচ্ছে। এমনকি মাদরাসা ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যক্ষ, ভিসি পর্যন্ত নৈতিক স্খলন ও রোমহর্ষক ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগের পর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্বপদে বহাল থাকতে পারেন না। দেশের আলেম উলামাদের স্বপ্নের আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ভিসি নিয়োগ ও বহাল থাকার পেছনেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করা হচ্ছে। ফেনির সোনাগাজীতে আলিম পরীক্ষার্থী মাদরাসা ছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল বোরকাপড়া কয়েকজন। এরা সবাই নারী নাকি বোরকাপড়া হন্তারক তা এখনো নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এই ঘটনার সাথেও মাদরাসা অধ্যক্ষের যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার আগে ওরা মাদরাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা যৌন নিপীড়নের মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গ্যাজেটেড নীতিমালা ও আইন থাকলেও দেশের সর্বত্র রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া ছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ থেকে ত্যাগী, যোগ্যতর ব্যক্তিদের বাদ দেয়ার অজস্র উদাহরণ আছে। আবার গুরুতর নৈতিক স্খলন, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ও ব্যর্থতার অভিযোগ থাকার পরও শুধুমাত্র রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অনেক ভিসি, অধ্যক্ষ ও পরিচালনা পরিষদ বহাল তবিয়তে তাদের কুকর্ম চালিয়ে গেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দুর্নীতি, অনৈতিকতা ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির সংস্কৃতি দূর করা সম্ভব না হলে সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়। আর এটি শুরু করতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই ক্ষীণ দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে শিক্ষা, মেধা ও মননশীলতায় একজন আদর্শ বিবেকবান শিক্ষকের রোল মডেল হতে হবে। বর্তমান ভিসি আখতারুজ্জামানের নানা বক্তব্য ও ভ’মিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও মানের সাথে বেমানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, গবেষণা ও ছাত্র রাজনীতির হালচাল, প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে পাস কাটিয়ে তিনি ১০ টাকায় সিঙ্গারা, সমুচা, চপ ও চা খাওয়ার সুযোগ গিনেজ বুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠানোর মত বালখিল্য বক্তব্য দিয়ে তিনি সমাজে হাস্যস্পদ ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছেন। বিতর্কিত ডাকসু নির্বাচনের পর ভিসি আখতারুজ্জামানের সন্তোষ প্রকাশের প্রতিক্রিয়া দেখে শিক্ষার্থী ও দেশের মানুষ বিষ্মিত ও আমোদিত বোধ করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ভিসি পুরো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অসৎ, মেধাহীন ও দলবাজ ব্যক্তিদের অপসারণ করে সত্যিকারের শিক্ষিত, মেধাবী, আলোকিত মানুষদের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে দলীয় রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা বন্ধ না হলে সমাজ ও রাজনীতি সুষ্ঠু ধারায় বিকাশ লাভ করা সম্ভব নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন