Inqilab Logo

সোমবার ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আবর্জনা কুড়িয়ে বেঁচে থাকেন জাকারবার্গের পড়শী ওরতা

নিউ ইয়র্ক টাইমস | প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

সানফ্রান্সিসকোতে মার্ক জাকারবার্গের ১ কোটি ডলার মূল্যের আলিশান বাড়ির পাশেই আবর্জনাভরা একটি ছোট, এক জানালার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে বাস করেন জেক ওরতা। তার ঘরে আছে একটি শিশুর পিংক কালার বাইসাইকেল হেলমেট। জাকারবার্গের বাড়ির সামনের রাস্তায় আবর্জনা পাত্র থেকে তিনি তা কুড়িয়ে এনেছেন। আরো আছে একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, একটি হেয়ার ড্রায়ার, একটি কফি মেশিন-সবই ভালো এবং একগাদা কাপড় চোপড়। ঐ আবর্জনা পাত্র থেকে কুড়ানো একটি কাগজের ব্যাগে সেগুলো রাখা।
সাবেক সৈনিক ওরতার বাড়িঘর নেই। তিনি এখন থাকেন সরকারের ভর্তুকি দেয়া একটি আবাসে। তিনি সবসময় আবর্জনা কুড়ান। তিনি সানফ্রান্সিসকোর সেসব মানুষের একজন যারা শত কোটি ডলারের মালিকদের বাড়ির সামনের ফুটপাতে বিক্রি করা যায় এমন কিছু ফেলে দেয়া জিনিস খুঁজে বেড়ান। তাদের এ কাজ সানফ্রান্সিসকোর গোপন অর্থনীতির অংশ।
শহরগুলোর চেয়ে সিলিকন ভ্যালির দোরগোড়ার বস্তি এলাকাগুলোতে আবর্জনা কুড়ানো একটি পেশা। আবর্জনা সংগ্রহকারীদের বৈশি^ক জোট নামের একটি অলাভজনক ও পক্ষসমর্থনকারী সংগঠনের হিসেবে বিশ্ব জুড়ে ৪শ’রও বেশি আবর্জনা কুড়ানো সংগঠন রয়েছে। সেগুলোর প্রায় সবই ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরেই আবর্জনা সংগ্রহকারীরা রয়েছে। সানফ্রান্সিসকোর লাগামহীন গৃহহীনতার মত এটাও আমেরিকান পুঁজিবাদের এক চরম প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ২০১৯-এর একটি ছবি হচ্ছে বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ও একজন আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তি পরস্পরের কয়েক মিনিট দূরত্বে বাস করেন। ওরতা নিজেকে রত্ম সন্ধানীদের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন।
একদিন রাতে তিনি খুঁজে পান সামান্য ব্যবহৃত একজোড়া ডিজাইনার জিন্স, নতুন কালো কটন জ্যাকেট, ধূসর রঙের ্কজোড়া নাইক রানিং স্নিকার এবং একটি বাইসাইকেল পাম্প। তিনি বলেন, আপনি কখনোই বলতে পারবেন না যে কি খুঁজে পাবেন। তিনি বলেন, কুড়ানো জিনিস থেকে রোজ ৩০ থেকে ৪০ ডলার আয় করা তার লক্ষ্য। বেঁচে থাকার জন্য সপ্তাহে তার প্রায় ৩শ’ ডলার প্রয়োজন।
ক্যালিফোর্নিয়াতে আবর্জনা কুড়ানো বেআইনি। সানফ্রান্সিসকোর বর্জ্য সংগ্রহকারী কোম্পানি রিকোলজির মুখপাত্র রবার্ট রিডের মতে, ফুটপাতে যখন একটি আবর্জনা পাত্র রাখা হয়, তখন তাতে থাকা সব জিনিস বর্জ্য সংগ্রহকারী কোম্পানির বলে গণ্য করা হয়। তবে এ আইনের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।
ওরতার জন্ম টেক্সাসের স্যান অ্যান্টোনিওতে। তিনি বাবা-মার ১২ সন্তানের একজন। তিনি ১২ বছরেরও বেশি সময় বিমান বাহিনীতে ছিলেন। ১৯৯১ সালে উপসাগর যুদ্ধের সময় বিমান বোঝাই করেছেন, পরে জার্মানি, কোরিয়া ও সউদী আরবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পর তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে যান। তিনি মদে আসক্ত হন ও গৃহহীন হয়ে পড়েন। এরপর তিনি সানফ্রান্সিসকোতে চলে আসেন। গৃহহীন সাবেক সৈনিকদের এক সহায়তা কর্মসূচিতে উত্তীর্ণ হন।
সন্ধ্যা বেলায় তিনি ঘর থেকে বের হন। তার অ্যাপার্টমেন্টটা মিশন এলাকায় একটা জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ ও ক্যানাবিস দোকানের মাঝে অবস্থিত। গাঁজার গন্ধে জায়গাটা ভরপুর। পাশের এলাকা জিলোতে একটা বাড়ির দাম ৩০ লাখ ডলার। সেদিকে তাকান না ওরতা। তিনি রাস্তা ধরে হেঁটে যান, চোখ থাকে মাটির দিকে, আর পকেটে থাকে একটা ফ্ল্যাশলাইট। তার বন্ধুরা তাকে সন্ধানকারী বলে ডাকে।
ওরতা বিভিন্ন আবর্জনা রাখার স্থানগুলো ঘুরে দেখেন। তবে খোঁজাখুজি শেষ হয় চেনা রাস্তার আবর্জনা রাখার জায়গায় এসে। তিনি বলেন, ফেলে দেয়া জিনিস খোঁজার প্রথম নিয়ম হল সেখানে কোনো রেকুন বা ইঁদুর আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। মার্চে আবর্জনা পাত্রে তিনি রুপার পানপাত্র, গামলা ও থালা বোঝাই একটা বাক্স পান। মনে হয়, কোনো ইউরোপীয় শ্যাতো (বাংলো ধরনের বাড়ি) থেকে কেউ ঝগড়া করে এসব ফেলে গেছে। ওরতার আবর্জনা কুড়ানো এক সহকর্মী একদিন রাতে মন্তব্য করেন, একজনের ফেলে দেয়া আবর্জনা অন্যজনের কাছে মূল্যবান সম্পদ। একে কী বলবেন আপনি?
ওরতা সম্প্রতি যেসব জিনিস পেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোন, আইপ্যাড, ৩টি হাত ঘড়ি ও গাঁজার ব্যাগ। গত আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে যখন লোকজন নেভাদা মরুভূমির বার্ষিক ম্যান বার্নিং উৎসব ফিরে এল তখন মাঝেমধ্যে কয়েকটি মিহি বালি লাগা পরিত্যক্ত বাইস্ইাকেল পেয়েছিলেন।
তিনি শুধু সেসব জিনিসই নেন যেগুলো ফেলে দেয়া বলে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ১৪ বছর আগে তিনি তার বাইসাইকেলের জন্য একটি র‌্যাঞ্চ চুরি করতে স্যাক্রামেন্টোর এক ব্যক্তির গ্যারেজের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকেছিলেন। এ জন্য তাকে কয়েক মাস জেল খাটতে হয়। তিনি বলেন, মারাত্মক একটা ভুল ছিল সেটা।
কয়েক বছর ধরে সানফ্রান্সিসকো রিসাইক্লিংয়ের এক বৈশি^ক মনোযোগ স্থলে পরিণত হয়েছে। রিকোলজি দেখতে মন্ত্রী, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা সেখানে আসেন।
সানফ্রান্সিসকো শহরটিতে চাকরির সন্ধান প্রার্থীরা রয়েছে যাদের কাছে অতিরিক্ত এক জোড়া জিন্সের প্যান্ট বা পুরনো ইলেকট্রনিক্স জিনিস পাওয়ার জন্য আবর্জনাপাত্রগুলো লোভনীয় স্থান।
রিকোলজির মুখপাত্র রিড বলেন, আবর্জনার মধ্যে ভালো জিনিসও পাওয়া যায়। আপনি এখানে বেশি সংখ্যায় প্রযুক্তির লোক দেখবেন এবং শহরটি অতি দ্রুত বাড়ছে। তাদের মনোযোগ দেয়ার সময় কম। কোনো জিনিস অপ্রয়োজনীয় হলে পুরনো জিনিসপত্র বিক্রির দোকানে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে ফেলে দেয়াই তাদের জন্য সুবিধা।
আবর্জনা সংগ্রহকারীরদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। দশকের পর দশক ধরে বৃদ্ধা মহিলা ও বৃদ্ধ পুরুষরা কার্ডবোর্ড, কাগজ, ক্যান বা বোতল সংগ্রহ করেন ও বড় বড় ব্যাগে ভরে তা বিক্রির জন্য রিসাইক্লিং সেন্টারে নিয়ে যান।
সানফ্রান্সিসকোর নগর প্রশাসক কার্যালয়ের এক মুখপাত্র বিল বারনেস বলেন, মশার ঝাঁক নামে আখ্যায়িত লক্কড় ঝক্কড় পিকআপগুলোর ব্যাপারে নগরীতে উদ্বেগ রয়েছে। এগুলো সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বাণিজ্যিক লক্ষ্যে পুনঃব্যবহারযোগ্য বিনিস সংগ্রহ করে এবং রিকোলজি, কার্যত এ শহরকে আয় থেকে বঞ্চিত করে। সান ফ্রান্সিসকোর আবর্জনা সংগ্রহকারীদের উপর প্রতিবেদন তৈরিকারী মিশন গোল্ড নামের একটি সাময়িকীর প্রকাশক অস্ট্রেলীয় চিত্রগাহক নিক মারজানো বলেন, এ নগরে কয়েক শ’ বর্জ্য সংগ্রহকারী রয়েছেন। তিনি বলেন, আমার কাছে এটা জনসেবা মনে হয়েছে। এসব জিনিস আবর্জনার ভাগাড়ে না গিয়ে পুনরায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
তিনি বলেন, নগরীর রাস্তাগুলোতে আবর্জনা সংগ্রহকারী ও গৃহহীন লোকজনের উপদ্রব অনেক বছর ধরেই সানফ্রান্সিসকোর নাগরিকদের উদ্বেগের কারণ। মারজানো বলেন, তিনি আবর্জনা সংগ্রহকারী এবং মিশন ও টেন্ডারলয়েন এলাকায় ফুটপাতে গজিয়ে ওঠা দোকানগুলোকে এক ধরনের আর্থিক উদ্যোগ হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, যাদের আর কোনো আয় নেই সেসব মানুষের জন্য এগুলো প্রাথমিক আয়ের উৎস।
ওরতা যেসব জিনিস সংগ্রহ করেন তা মিশন স্ট্রিটের অস্থায় বাজার বা জুলিয়ান এভিনিউতে শনিবারের আনুষ্ঠানিক বাজারে বিক্রি করেন। শিশুদের খেলনা খুবই কম বিক্রি হয়। কারণ অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের হাতে আবর্জনা থেকে সংগৃহীত জিনিস দেখতে চান না। মেয়েদের কাপড় চোপড়ও কেউ কিনতে চায় না। তবে পুরুষরা তাদের পরনের কাপড় কোত্থেকে এল তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা এখান থেকে ৫ বা ১০ ডলারে এক জোড়া জিন্সের প্যান্ট পেতে পারে। ওরতা তার সংগৃহীত যে জিনিসটি বিক্রি করেননি তা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে বের হওয়া সংবাদপত্রের সংগ্রহ। তার কাছে আশ্চর্য লাগে কেউ এসব জিনিস ফেলে কিভাবে।
সম্প্রতি এক মঙ্গলবারে ওরতা জাকারবার্গের বাড়ির পাশের রাস্তায় আবর্জনা সন্ধান করতে যাওয়ার আগে ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতার বাড়ির নিজের দুটি আবর্জনা পাত্রে কিছু পাননি। সানফ্রান্সিসকো সাগর তীরবর্তী এলাকায় তার আরো একটি বাড়ি আছে যা তিনি ২০১২ সালের নভেম্বরে ৯৯ লাখ ডলারে কেনেন। দুটি আবর্জনাপাত্র খুঁজে কিছু না পেয়ে তার মন্তব্য ছিলঃ ওগুলো একেবারে ফাঁকা, কিছুই নেই।



 

Show all comments
  • হাবিব ৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৪৭ এএম says : 0
    পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ আছে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
    Total Reply(0) Reply
  • মিরাজ মেহেদি ৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৪৯ এএম says : 0
    আবর্জনা আমাদের কাছে নিছক ময়লাস্তূপ মনে হলেও যারা এ নিয়ে গবেষণা করেন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আবর্জনাতে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা সম্ভব।
    Total Reply(0) Reply
  • হাসিব বিল্লাহ ৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৫০ এএম says : 0
    জাকারবার্গ নিজের পড়শীর খবর রাখে না, অথচ সারাবিশ্বের মানুষের খবর রাখার প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Hobibar Rahman Sagor ৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৫১ এএম says : 0
    আবর্জনা কুড়ানোও একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা। এটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
    Total Reply(0) Reply
  • ,moinuddin ৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৫২ এএম says : 0
    এজন্য জাকারবার্গ কি করতে পারে?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আবর্জনা

২৪ জানুয়ারি, ২০২২
১ আগস্ট, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ