Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফতওয়ার উদ্দেশ্য ও অপব্যবহার

প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সুমাইয়া হাবীবা

সম্প্রতি সাউদি আরবের জাতীয় ফতওয়া কমিটির সাথে সে দেশের কৃষি উন্নয়ন অধিদপ্তরের একটি গোলযোগ বেধেছে। গোলের বিষয় কৃষি অধিদপ্তর কৃষকদের যে ঋণ দিয়ে থাকে তার ওপর একটি ফি আরোপ করেছে। যারা ঋণ নিয়ে লাভবান হবেন শুধু তাদের জন্যই এই ফি নির্ধারিত হবে। উদ্দেশ্য হলো অধিদপ্তরের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে কোন অবস্থাতেই ফান্ডের অভাবে কাজ বন্ধ না থাকে। কিন্তু ফতওয়া কমিটি এর বিরোধিতা করেছে। তাদের যুক্তি হলো কৃষি ঋণে কোনরূপ ফি নির্ধারণ করা যাবে না। লাভের উপর ভিত্তি করে ফি নিলে, পরিমাণ যত সামান্যই হোক, যে পরিভাষাতেই হোক এটি সুদের মধ্যে শামিল হবে। ফতওয়া কমিটির এমন মতামত প্রদানের পর সে দেশের সরকারসহ বিশেষজ্ঞ আলেমরা বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করছেন। গবেষণা করছেন। ফকীহ এবং অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে বিচার বিশ্লেষণ চলছে।
বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কে যতগুলো বিভ্রান্তি এবং ভীতি রয়েছে ফতওয়া তার মধ্যে অন্যতম। ফতওয়া বিষয়ে আলেমগণেরও দ্বিধান্বিত মনোভাব দেখা যায়। আবার এই আমাদের দেশেই ফতওয়ার ব্যবহার যত্রতত্র দেখা যায় এবং যে কোন বিষয়েই ফতওয়া দেয়ার প্রবণতাও প্রচুর। অথচ না ফতওয়া যত্রতত্র ব্যবহার্য বিষয় না সকল বিষয়ে সকাল বিকাল ব্যবহার্য বিষয়। বিশেষ করে পাড়া-মহল্লায়, গ্রামগঞ্জে ফতওয়া শব্দটির অপব্যবহারের ফলেই মানুষের মনে ফতওয়া সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি। নারী ঘটিত বিষয়ে ফতওয়া দেয়া এক ধরনের রীতিতে পরিণত করা হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ের বিচার সালিশ যেমন তালাক, হিলা বিয়ে, দোররা ইত্যাদিকেই ফতওয়ার কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছে। আবার স্থান-কাল-পাত্রভেদে মনের মাধুরী মিশিয়ে শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। কিছু অসাধু ব্যক্তি এর সুযোগ পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করে থাকে।
অথচ ফতওয়া ব্যক্তি নয় সামগ্রিক পর্যায়ে নির্ধারণ হতে হবে এবং ব্যক্তিগত বিচার সালিশ ফতওয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। ফতওয়া একটি ব্যাপকতর ব্যাখ্যার বিষয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেই মূলত ফতওয়ার ভূমিকা বেশি। মুসলিম সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি সমৃদ্ধির জন্য ফতওয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সামাজিক কোন বিষয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে তার সমাধান বিশেষজ্ঞ আলেম সমন্বয়ে গঠিত ফতওয়া কমিটি বা বোর্ড প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। সে ক্ষেত্রে তারা বিষয় সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদেরও সাথে নিতে পারে। ফতওয়া নিজের দায়িত্বে নিয়ে নিলে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ হবার আশঙ্কাই বেশি এবং অপব্যবহার হতে থাকে যার ফলে সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্টের পাশাপাশি ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়।
জাতীয়ভাবে ফতওয়া বোর্ড থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। এতে করে মুসলিম সমাজে যে কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে, সিদ্ধান্তটি যেন কল্যাণকর হয় এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারে ফতওয়া কমিটি। ফতওয়া কমিটি হালাল-হারাম বিষয়ে মাসআলা দেবেন। বিএসটিআইতে পণ্যের গুণগতমান নিরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ আছেন। কিন্তু খাদ্যের উপাদানের মধ্যে হালাল-হারামের নির্ধারণ ও বিধানদান বিষয়ে কোন বিশেষজ্ঞ নেই। এখানেই ফতওয়া কমিটি বিএসটিআইর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। শুধু খাদ্যই নয় আমদানীকৃত প্রসাধনীসহ অন্যান্য সকল পণ্য ও কাঁচামালের ক্ষেত্রেও একইভাবে সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান হবে ফতওয়া কমিটি।
ফতওয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে বা জাতীয়ভাবে নির্ধারণ করার বিষয়। মুসলিম দেশ হিসেবে জাতীয়ভাবে ফতওয়া বোর্ড থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি আরেকটি খবর অনলাইন মিডিয়ায় খুবই ভাইরাল হয়েছে। তা হলো দেশের নামী একটি প্রতিষ্ঠানসহ আমদানীকৃত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য হারাম প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য যেমন পাউরুটি, জেলিসহ পাউডার ড্রিঙ্ক ইত্যাদি বহুসংখ্যক খাদ্যপণ্যেই শূকরজাত চর্বি (পিগফ্যাট) ব্যবহৃত হওয়া। নেদারল্যান্ডের ওয়াজেনিনেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ওয়েবসাইট ফুড-ইনফো ডট নেটের তথ্য অনুযায়ী ‘খাদ্যদ্রব্যে অ্যানিম্যাল ফ্যাট নামে যে কোডটি লেখা থাকে ইংরেজি ‘ই’ বর্ণ দিয়ে, সেগুলো প্রতিটিই প্রাণিজ চর্বি দিয়ে তৈরি। এই প্রাণিজ চর্বির মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় শূকরজাত চর্বি। খাদ্যদ্রব্যে কোন প্রাণিজ চর্বি ব্যবহৃত হয়েছে তা বলতে পারেন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। তাই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব দ্রব্যের গায়ে সেটি উল্লেখ করা।’
যে প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে আঙ্গুল উঠেছে সেগুলোর একটিতেও বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা নেই। এছাড়াও আরেকটি বিষয় ভাবার মত, কাঁচামাল বিষয়ে ইসলামে ফিকহের বিধানে অনেক জটিলতা রয়েছে। কিছু জিনিস প্রক্রিয়াজাত করার আগে ও প্রক্রিয়াজাত করার পরে দুই অবস্থায় বিধান আলাদা আলাদা হয়ে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে একই থাকে। এসব জটিল বিষয় সাধারণ মানুষের অনুধাবন সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ উলামায়ে কেরামের মতামত প্রয়োজনীয়।
সাধারণ মানুষ উপাদানের সরল নাম বুঝতে সক্ষম। কিন্তু কোড নয়। যারা কর্তাব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে এটি অনুমোদনের সময় হালাল-হারামের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। মুসলিমদের কাছে হালাল-হারাম বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কুরআনে অত্যন্ত কঠিন নির্দেশনা আছে। প্র্যাকটিসিং নন প্র্যাকটিসিং উভয়শ্রেণীই খাদ্যের হারাম নির্ধারণ ও বর্জনে সচেতন থাকেন। সুতরাং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে এ ধরনের অসতর্কতা মেনে নেয়া যায় না। দেখা যায় কোন একটি সমস্যা তৈরি হওয়ার পর সেটি নিয়ে অনেক হইচই হয়ে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে আর সে বিষয়ে কোন আপডেট থাকে না। অথচ এগুলো সর্বসময়ে আপডেট থাকার বিষয়। যা সাধারণ মানুষ কর্তৃক সম্ভব নয়। এটি হতে হবে নিয়ন্ত্রণকারী ও তদারককারী পর্যায় থেকে। দুখজনক হলো এইসব তদারককারীদের মধ্যে সঠিক ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞম-লীর অভাব। যা ফতওয়া কমিটির সহযোগিতার মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে।
২০০১ সালে ফতওয়ার অপব্যবহারকেন্দ্রিক সমস্যা তৈরি হওয়ার পর ফতওয়া বোর্ড নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সে সময় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতীব মুহতারাম মাওলানা উবায়দুল হক (রাহ:) বারবার জাতীয়ভাবে ফতওয়া বোর্ড গঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন। উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে ফতওয়া বোর্ড গঠনই সমাধান বলেছিলেন এবং বিভিন্ন ইসলামী দলসহ প্রায় সকল ইসলামী বিশেষজ্ঞ ও ব্যক্তিত্বই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে মাওলানা সাহেবের ইন্তেকালের পর এ উদ্যোগটি স্তিমিত হয়ে যায় এবং ফতওয়া সংক্রান্ত আর কোন সমস্যাও সেরকমভাবে আলোড়ন তৈরি না হওয়াতে এর জরুরতটিও নিভে যেতে থাকে। এ সুযোগে সমাজে ফতওয়াভীতি রয়েই যায় এবং ফতওয়ার অপব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করাও সম্ভব হয়নি। কালের পরিক্রমায় তা আজ ভয়ানক দুস্বপ্নের মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফতওয়া বোর্ড যতদিন গঠন না হবে ততদিন ফতওয়ার অপব্যবহার ও ফতওয়া সংক্রান্ত বিভ্রান্তি নিরসন হবে না বরং বেড়ে যাবে। বর্তমান সময়ে ইসলামী হালাল-হারাম বিষয়গুলো সুকৌশলে মিলেমিশে যাচ্ছে। কোন ধর্মের জন্যই এটি সুখবর নয়। প্রত্যেকটি ধর্ম তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পাশাপাশি সহাবস্থান করলেই সমাজে শান্তি সুনিশ্চিত করা যায়। হালাল হারামের মত মূলগত বিষয়ে উদাসীন থাকা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আলেম সমাজ ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব যারা একটি সুখী ও পরিচ্ছন্ন সমাজ দেখতে চান তাদের প্রত্যেকের এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা সময়ের দাবী।
লেখক: সমাজ ও মানব উন্নয়ন কর্মী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফতওয়ার উদ্দেশ্য ও অপব্যবহার
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ