পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। কিছু ঘটনা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, দেশের চলমান শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসন্ন। কারণ প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনগণ তাদের অংশীদারিত্বের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনাগ্রহের মধ্য দিয়ে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনে কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি কেমন ছিল সেটা আমরা জানি। তারপর শুরু হয় উপজেলা নির্বাচন। সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঁচ ধাপের এই নির্বাচনে ইতোমধ্যে চারটি ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবখানেই ভোটারদের জন্য হাহাকার লক্ষ করা গেছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে এমনো দেখা গেছে, যেখানে ভোটগ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তাকর্মচারীর সংখ্যার চেয়েও কম সংখ্যক ভোট পড়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন ছিল একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত প্রায় সকল দলই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ফলে শুরুতে জনগণের মধ্যে একটি সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের পরিবেশ নিয়ে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে টিকতে পারেনি বিরোধী মতের প্রার্থীরা। এখানেই শেষ নয়, নির্বাচনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের প্রতীকে সিল মেরে ভোটের বাক্স ভরাট করার ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ছাপা হয়েছে। ভোটের দিন নানা কৌশলে বিরোধী দলের এজেন্টমুক্ত রাখা হয় নির্বাচনী কেন্দ্রগুলো। তারপরও বিরোধী মতের ভোটাররা যেন তাদের প্রার্থীদের ভোট দিতে না পারে তার জন্য যা যা কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন তার সব কিছুই করা হয়েছে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাইকৃত ৫০টি সংসদীয় আসনের নির্বাচনী কার্যক্রম পর্যালোচনা করে ৪৭টিতেই ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে বলে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে টিআইবি। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী মতের প্রার্থীদের অভিযোগগুলো যে অমূলক ছিল না, তা স্বীকার করেছে ক্ষমতাসীন দলের শরীকরাও। শুধু তাই নয়, খোদ নির্বাচন কমিশনও এটা যে ভালো করেই জানে সেটা বোঝা গেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এক বক্তব্যের মাধ্যমে। যেখানে তিনি বলেছেন, ইভিএম-এ ভোট হলে আগের রাতের ভোটের অভিযোগ উঠত না।
সে যাই হোক, দশম সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। কারণ সে নির্বাচনে বিরোধী জোট অংশ না নেয়ায় বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি ১৪৭ আসনে নির্বাচন হলেও সেখানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিপক্ষে শক্ত কোনো প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকায় জনগণ খুব একটা আগ্রহী ছিল না ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে। বিষয়টি এতটাই দৃষ্টিকটু ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও তাতে বিব্রত হয়ে বলেছিলেন এমন নির্বাচন তিনি আর দেখতে চান না। সেকারণেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ দেখে আশার সঞ্চার হয়েছিল সবার মাঝে। ভোটাররাও রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের নিজেদের অংশীদারিত্বের জায়গাটি সম্পর্কে নতুনভাবে অনুধাবন করতে শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সে আগ্রহ-উদ্দীপনা ধুলিস্যাৎ হতে দেখে হতাশায় নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তাদের সেই হতাশায় ডুবে থাকার প্রমাণ বহন করছে সিটি করপোরেশন, উপজেলা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর ভোটারশূন্য কেন্দ্রগুলো। মাঝখানে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠান। আর নির্বাচনটি সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই পরিচালনা করছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের দ্বারা নিশ্চয় এমন কিছু হবে না, যা দেখে মানুষ ছিঃ ছিঃ করবে। কিন্তু সেখানেও যখন রাতের আঁধারে ভোট, বিরোধী মতের ভোটারদের নানা কৌশলে ভোটদানে অনুৎসাহী করার ঘটনা প্রকাশ্যে চলে আসে তখন আশার শেষ প্রদীপটিও নিবু নিবু। সে আঁধারই এখন চলমান স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রগুলোতে বিরাজ করছে। প্রার্থীরা হাতে-পায়ে ধরেও কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারছে না ন্যূনতম সংখ্যক ভোটারকে। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে শুধু যে বিরোধী মতের ভোটারদের মধ্যে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তা কিন্তু নয়। অনেক কেন্দ্রেই দেখা যাচ্ছে, সে কেন্দ্রের আওতাধীন সরকার দলীয় সমর্থকদের সংখ্যার চেয়ে কাস্ট হওয়া ভোটের সংখ্যা অনেক কম। ফলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কখনো কখনো ঘোষণা দিয়ে বলতে হচ্ছে, কেন্দ্রগুলো ভোটারশূন্য থাকার দায় কমিশনের না। এ দায় প্রার্থীদের। কেন্দ্রগুলোতে ভোটারশূন্যতাসহ নির্বাচন নিয়ে ওঠা নানা অভিযোগ যে প্রধানমন্ত্রীকেও ভাবাচ্ছে তা আঁচ করা যায় তার সাম্প্রতিক এক মন্তব্যে। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা (বাকশাল) কার্যকর থাকলে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকত না, প্রশ্ন উঠত না।’
দেশের সরকার ব্যবস্থায় বিরোধীদল বা বিরোধী জোট বা বিরোধী মত শক্তির দিক থেকে কোনোভাবেই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার পর্যায়ে নেই, যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয়। কিন্তু ক্ষমতার এই ভারসাম্যহীনতা একদিনে তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরেই এটা তৈরি হয়েছে। কোথা থেকে এবং কীভাবে এর শুরু সেটা হয়তো সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এমনকি এককভাবে এর জন্য কাউকে দায়ী করা যায় কিনা সেটাও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপার। তবে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার এবং তাদের কর্মকান্ড যে, এর ভিত গড়ে দিয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনীতিবিদ না হয়েও তারা রাজনীতিবিদদের পেছনে লাগতে গিয়ে যে ভুলগুলো করে গেছে, তার ধারাবাহিকতা আর কতদিন চলতে থাকবে সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। আর শুধু তাদের ওপর দায় চাপিয়েই বিষয়টির ইতি টানাও সম্ভব না। কারণ, বিরোধী দল এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার সহিষ্ণুতার অভাব ও মতোবিরোধও এটাকে আজকের এ অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে, যা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির পথে অন্তরায় হয়ে আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একাদশ সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির পদ্ধতি এবং রূপরেখা কেমন হতে পারে তা-ও তারা জানিয়েছেন। তাতেও যে দেশের মানুষের মনোভাবে তেমন কোনো পরিবর্তন এসেছে, সেটা বলা যায় না। এটা ক্ষমতাসীনদের জন্যও একঘেয়েমিপূর্ণ এক অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তাই ধারণা করছি, চলমান শাসন ব্যবস্থা বদলানোর একটা আওয়াজ উঠতে পারে। বাংলাদেশের সে বদলে যাওয়া শাসন ব্যবস্থা বা শাসন কাঠামো কেমন হবে, সেটা এখনি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। তবে যে আলামত বা ইঙ্গিতগুলো দৃশ্যমান, সেগুলোই আমরা তুলে ধরতে পারি। প্রথম ইঙ্গিতটি আমরা নিতে পারি প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য থেকে। সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ মেয়াদ। তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হবেন না। নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান।’ বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছে ডয়চে ভেলে। সাক্ষাৎকারে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা আমার তৃতীয় মেয়াদ। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী হয়েছি (১৯৯৬-২০০১)। সব মিলিয়ে চতুর্থবার। আমি আর চাই না। একটা সময়ে এসে সবারই বিরতি নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যেন তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেওয়া যেতে পারে।’
চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে বিরতি নেয়ার কথা বলে তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে, এক. তিনি কি রাজনীতি থেকেই বিরতি নেবেন? দুই. প্রধানমন্ত্রী কি চলমান মেয়াদ শেষে ভারতীয় কংগ্রেস দলের সোনিয়া গান্ধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? তিন. নাকি তিনি পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ দলের অন্যকারো হাতে ছেড়ে দিতে চান? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি ছেড়ে দেবেন, এমন কোনো আলামত দৃশ্যমান নেই। তবে ভারতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকার পরও সোনিয়া গান্ধী যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দলের নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দিতে পারেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীও। যেমনটা করেছেন তিনি একাদশ সংসদের মন্ত্রিসভা গঠনের সময়। পুরাতন অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সাবেক মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা সাজিয়েছেন অপেক্ষাকৃত তরুণদের সমন্বয়ে। এখানে একটি বিষয় অবশ্য আছে, আর সেটি হলো ভারতের প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এক নয়। সেক্ষেত্রে তৃতীয় অপশনটির সম্ভাবনাই উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের মেয়াদ ২০২৩ সালের শুরুর দিকে শেষ হওয়ার কথা। বতর্মান প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষে আজকের প্রধানমন্ত্রী যদি সে পদ অলঙ্ককৃত করেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু দেখি না। যদিও এটা কেবল একটি ধারণা, তারপরও সেটা যদি ঘটেই তাহলে প্রশ্ন আসবে, আজকের শাসন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের যে গুরুত্ব এবং দায়দায়িত্ব সেদিনও কি এটা তেমনই থাকবে? যদি তাই থাকে, তাহলে কিছু বলার নেই। আর যদি সেটি না থাকে তাহলে আমরা ধরে নিতেই পারি যে এটা শুধু পদ পরিবর্তন হবে না, হবে তার চেয়েও বেশি কিছু। সেই বেশি কিছুর মধ্যেই লুকায়িত থাকতে পারে আমাদের আগামী দিনের বদলে যাওয়া শাসন ব্যবস্থা বা শাসন কাঠামো।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।