Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভবন ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

একের পর এক ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো শিক্ষা হচ্ছে না। আগুনে নিহতদের বুকফাটা কান্না সাধারণ মানুষের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি করলেও তাদের টনক নড়ছে না। হাজার হাজার ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। নির্ধারিত ফ্লোরের পরিবর্তে অতিরিক্ত ফ্লোর ভবন মালিকরা তুলছে। ভয়াবহ এ সব অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন অনিয়ম যখন রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে থাকে, তখন অগ্নিকান্ড বা ভবন ধসে পড়া রোধ করা কি কখনো সম্ভব? গত বৃহস্পতিবার বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর বের হয়ে আসে ভবনটির নানা অনিয়মের কথা। রাজউক কর্তৃক ভবনটির অনুমোদন ১৮ তালা পর্যন্ত থাকলেও ভবন কর্তৃপক্ষ আরও কয়েক তালা বাড়িয়ে তা ২২ তালা করে। ভবনের সিঁড়ি এতটাই সরু যে তা দিয়ে দুইজন মানুষের পাশাপাশি চলা কষ্টকর। মাত্র তিন ফুটের সিঁড়ি। আবার বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র বা অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক হলেও এর কোনোটিই ভবনটির ছিল না। অর্থাৎ অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। শুধু এফআর টাওয়ার নয়, রাজধানীতে এমন অন্তত আরও সাড়ে ১১ হাজার অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন রয়েছে বলে গতকাল একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত ফায়ার সার্ভিসের কোনো ছাড়পত্র বা অনুমোদন নেই। ভাবা যায়, এসব ভবনে যদি কোনো কারণে আগুন লাগে তখন কী পরিস্থিতি হবে। শুধু রাজধানীতেই নয়, বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের বেশিরভাগ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। বিভাগীয় শহরগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেক বিষয়ে আইন রয়েছে। তবে এসব আইনের অধিকাংশই প্রয়োগ হয় না। মানুষের বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যে ভবন নির্মাণ করতে হয়, তারও যথাযথ আইন রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এসব আইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। আইন প্রয়োগের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোতেই গলদ রয়েছে। অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি কমাতে ২০০৩ সালে অগ্নিপ্রতিরোধক ও নির্বাপণ নামে একটি আইন প্রণীত হয়েছিল। এই আইন অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান, গাড়ি ঢুকতে পারবে কিনা-তা পর্যবেক্ষণ করে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেয়ার পর রাজউক থেকে ভবনের নকশা অনুযায়ী অনুমোদন নিতে হয়। এসব নীতি মেনে ভবন নির্মিত হয়েছে কিনা তা জমা দেয়া নকশার সাথে মিলিয়ে দেখে রাজউক। বাস্তবে রাজউক এ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন করে না। ফলে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, ৫০০ জনের বেশি বসবাসরত ভবনে ফায়ার প্রটেক্টেড ডোর, কমপক্ষে দুটি সুপরিসর সিঁড়ি, ফায়ার অ্যান্ড স্মোক এক্সিট থাকা বাধ্যতামূলক। ঢাকার অধিকাংশ ভবনে এই কোড মানা হয় না। বিদ্যমান ভবনগুলোর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন তার চিত্র এক জরিপে উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, শুধু রাজধানীর ৯০ শতাংশের বেশি বহুতল ভবনে আগ্নিব্যবস্থাপনা ও জরুরি নির্গমনের কোনো প্রস্তুতি নেই। মাত্র ৫ শতাংশ বহুতল ভবন জরুরি নির্গমন গাইডলাইন অনুসরণ করে। ৩ শতাংশ ভবনে ফায়ার লিফট আছে। ৬৪ শতাংশ ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম নেই এবং ৩১ শতাংশ ভবনে পানির রির্জাভার আছে। ৮০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো ব্যবহার উপযোগী কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। অনেক ভবনে কেবল শো-পিস হিসেব বা নামকাওয়াস্তে এসব যন্ত্রপাতি রাখা হয়। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, রাজধানীর বহুতল ভবনগুলো কতটা অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। কত মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। তা নাহলে যে যেভাবে পারছে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কী করে ভবন নির্মাণ করতে পারে? এখন বেশ জোরেসোরে অভিযোগ উঠছে, রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তার অসাধুতার কারণে অনেক ভবন মালিক নিয়ম-নীতির ধার ধারছে না। সর্ষের মধ্যে যদি ভূত থাকে, তবে সে ভূত কোনোদিনই তাড়ানো যাবে না, সমস্যার সমাধান হবে না, অগ্নিকান্ডে মানুষের মৃত্যুর মিছিলও বন্ধ হবে না। একটি ভবনের নির্মান ও ব্যবহারিক পর্যায়ে যেতে রাজউক, সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগ, ওয়াসা, তিতাসসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা থাকে। দেখা যায়, বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানে কাজের সমন্বয় থাকে না। ফলে কোনো না কোনো গাফিলতি থেকে যায় এবং অগ্নিকান্ডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দুঃখের বিষয়, ভবন মালিকরাও অসচেতন হয়ে তাদের ভবন নির্মাণ করছে। তারা যে মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণ করছে এবং এতে যে তার নিজের ক্ষতিসহ অন্যদের ক্ষতি হচ্ছে, তা ভেবে দেখে না।
আধুনিক নগরীতে হাইরাইজ বিল্ডিং হবে, তা স্বাভাবিক। তবে এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যে নিয়ম-নীতি রয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে মেনে করা উচিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিয়ম না মেনে একটি ভবন নির্মিত হয়ে গেলে তা পুনরায় সংস্কার করা বা ভেঙ্গে ফেলা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি ব্যয় সাপেক্ষ। কাজেই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থে এবং ঝুঁকি এড়াতে মালিকদের সচেতন হওয়া দরকার। যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে এবং সব ধরনের ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে ভবন নির্মাণ করা উচিত। পরপর যেসব ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং মানুষের মৃত্যু হয়েছে-এ ঘটনাগুলো থেকে তাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। সবার আগে রাজউককে সচেতন হতে হবে। কিছু লোকের অসাধুতার কারণে নিয়ম বর্হিভূত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মিত হবে ও মানুষের প্রাণহানি ঘটবে, তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে যথাযথভাবে ভবন নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিত খতিয়ে দেখতে হবে। এক সময় গার্মেন্ট কারখানাগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ নিয়ে বিদেশি বিভিন্ন বায়ার প্রতিষ্ঠান জোরালো আপত্তি তোলে। গার্মেন্ট কারখানার সার্বিক পরিবেশ এবং ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য তারা তাকিদ দেয়। সরকারও তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়। অনেক গার্মেন্ট কারখানা এখন ঝুঁকিমুক্ত। নতুন হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য অনুরূপ পদক্ষেপ প্রয়োজন। দেখা যায়, বেশিরভাগ ভবনের অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়, বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং সঞ্চালনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। ভবন মালিকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। ভবন নির্মাণের সময় যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের সমন্বিত কার্যব্যবস্থার বিকল্প নেই। এই সঙ্গে নির্মিত ও নির্মাণাধীন ভবনগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন