পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুর্বল ও বিশৃঙ্খল সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির উপর অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল শক্তির আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই সভ্যতার ইতিহাস। ইউরোপের বিবর্তনের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, গ্রীক সভ্যতা যখন স্থবির ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল তখনি অপেক্ষাকৃত ঐক্যবদ্ধ ও প্রগতিশীল রোমানরা তাদের উপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। এই রোমানরা পুরনো টেস্টামেন্টের বিকৃত অনুসারিদের হটিয়ে নতুন ধারার ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপের বহুধাবিভক্ত রাজ শক্তিগুলো নরমান-ভাইকিংদের আক্রমণে সহজেই পর্যুদস্ত হয়ে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই নরমান-ভাইকিংরা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল সারাসেনদের হাতে পরাজিত হওয়ার কারণেই স্পেন, স্ক্যান্ডেনেভিয়ায় মুসলমানদের বিজয় নিশান ইউরোপে বৃহত্তর ও একীভূত রাজশক্তি গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ধর্মীয়-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিযোগিতায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ এবং নৈতিক-অনৈতিক কলাকৌশল দেখা যায়। খলিফা বা মূল ধারার মুসলমানদের রাজ্য বিস্তারে কখনও অনৈতিক বলপ্রয়োগ বা সীমালঙ্ঘনের ইতিহাস নেই। পক্ষান্তরে স্পেনে মুসলিম বিদ্বেষী খৃষ্টীয় শক্তির পুনরুত্থান ও রাজ্য পুন:প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে প্রতারণা ও নৃশংসতার ইতিহাস। পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে স্পেনে শেষ স্বাধীন মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ দ্বাদশ মোহাম্মদের সাথে রানী ইসাবেলা ও রাজা ফার্দিনান্দের আত্মসমর্পণের চুক্তিভঙ্গের প্রতারণার ইতিহাস নিয়ে নানা ধরনের মিথ ও অতিরঞ্জন থাকলেও প্রতারণা ও মুসলিম নিধনের ইতিহাস মিথ্যা নয়। বিশেষত: এপ্রিল ফুল কেন্দ্রিক বিশ্বাস সম্পর্কে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর কিছু ব্যত্যয় থাকলেও গ্রানাডা-কর্ডোভার জনপদ ধ্বংস, মসজিদে ম্যাসাকারের ঘটনাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে জেরুজালেম বিজয়ের সময় সুলতান সালাহউদ্দিনের উদারতা এবং খৃষ্টানদের সাথে তার এবং মুসলিম বাহিনীর সদাশয় আচরণ খৃষ্টান ও লিবারেল ঐতিহাসিকরাই বর্ণনা করে গেছেন। মুসলমানদের বিজয় ঠেকাতে পোপের একাধিপত্যের বদলে সেক্যুলার ঐক্য গড়ে তোলার যে নতুন নীতি কৌশল গৃহীত হয়েছিল তাই পরবর্তীতে ইউরোপীয় রেনেসাঁস এবং ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিল। অতএব পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের শুরুতেই ইসলাম বিদ্বেষ, প্রতারণা এবং মসজিদে হত্যাকান্ডের রক্তাক্ত ইতিহাস রয়েছে। লোককথা অনুসারে, ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিলে মসজিদ পুড়িয়ে ৭ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে ইসাবেলার খৃষ্টান বাহিনীর গ্রানাডা দখলের কথা বলা হলেও নিরপেক্ষ ইতিহাসে সুনির্দিষ্টভাবে এই ১ এপ্রিল কেন্দ্রীক নৃশংসতার কোনো বয়ান নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি। হেনরি ক্যামেনের লেখা -স্পেন ১৪৬৯-১৭১৪ গ্রন্থের উদ্ধৃতি অনুসারে, বুআব্দিল বা দ্বাদশ মোহাম্মদের পতন এবং রানী ইসাবেলার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ ছিল ২ জানুয়ারি ১৪৯২ খৃষ্টাব্দ। হেনরি ক্যামেন এই ক্ষমতা হস্তান্তরের মুহূর্তটিকে শান্তিপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। এর মানে এই নয় যে, প্রায় ৬শ বছর ধরে চলা মুসলমানদের শাসনকাল হঠাৎ করেই কোনো অপ্রস্তুত মুর্হূতের যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে; এর পেছনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র, নৃশংসতার কোনো কাহিনী নেই। বিশেষত: ইউরোপে মুসলমানদের রাজ্য বিজয় এবং শত শত বছরের শাসন ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ঘটনা হঠাৎ বা আকম্মিক সামরিক অভিযানের উপর নির্ভর করে ঘটেনি। ইউরোপের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে সেখানে ইসলামের বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদী ভোগবাদী সংস্কৃতির চরম পরিণতি, অর্থনীতির অপরিণীমদর্শি লুণ্ঠন থেকে যুদ্ধবাদী অর্থনীতিতে রূপান্তর ইত্যাকার বাস্তবতায় ইউরোপ-আমেরিকায় আবারো ইসলামই প্রাধান্য বিস্তারকারী বিকল্প ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আদর্শ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে চলেছে। এহেন বাস্তবতায় উপায়ন্তরহীন, দুর্বল বর্ণবাদী গোষ্ঠির মিথ্যা অহমিকা শুধু প্রতিহিংসার যুদ্ধ এবং নির্মম নৃসংশতার পথ বেছে নিয়েছে।
১৫ পনের মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দু’টি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় অংশগ্রহণকারী প্রধান ব্যক্তি ব্রেন্ট ট্যারান্ট বন্দুক নিয়ে মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মাত্র পনের মিনিট আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ৭৬ পৃষ্ঠার একটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। অভিবাসন এবং মুসলিম বিদ্বেষী টুইট বার্তায় বর্ণবাদী হন্তারক ট্যারান্ট মুসলমানদের ‘ইনভেডার’ বা দখলদার বলে উল্লেখ করেছে। ইউরোপে ক্রমবর্ধমান মুসলমান জনসংখ্যা বর্ণবাদীদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ইউরোপে ইসলামের পতাকা উড়বে, এমন মন্তব্য করে জার্মান ও ইউরোপীয় জনগণকে সে ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। গত কয়েক বছরে ইউরোপে অভিবাসন সংকট থেকে শুরু করে অনেকগুলো সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী ঘটনা ঘটে গেছে, যেখানে বাছ-বিচারহীনভাবে মুসলমানদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। এতকিছুর পরও গত বছরের শেষদিকে জার্মানিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব সম্পর্কে এঙ্গেলা মার্কেলের মন্তব্য ছিল, মুসলমানরা জার্মানির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষত জার্মান সরকারের একজন মন্ত্রী মুসলমানদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার প্রতিক্রিয়ায় মার্কেল এই মন্তব্য করেছিলেন। ডেনিশ কার্টুনিস্টের ইসলাম অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশের পর পুরো ইউরোপ জুড়ে মুসলমানদের মধ্যে যে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, এরপর আর কোনো পত্রিকা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে এ ধরনের কার্টুন প্রকাশের মত কাজ থেকে বিরত থাকাই সঙ্গত ছিল। কিন্তু ফরাসি পত্রিকা শার্লি হেবদো ইসলাম বিদ্বেষী ঘৃনা ছড়ানো কার্টুন ও রম্য রচনা প্রকাশ করার পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্যারিসে শার্লি হেবদোর কার্যালয়ে ঢুকে গুলি চালিয়ে বেশ কিছু মানুষকে হতাহত করার ঘটনা ঘটে। দশজনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার সেই ঘটনায় সারাবিশ্ব থেকে প্রতিবাদ ওঠে। বন্দুক হামলাকারীরা আল কায়েদা নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত বলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলা থেকে শুরু করে গত দেড়যুগে আল কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম থেকে শুরু করে কথিত মুসলিম জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্ক সংশ্লিস্ট সন্ত্রাসী হামলাগুলো সম্পর্কে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা এবং রাজনৈতিকভাবে যে সব অভিযোগ বা দাবি করা হয়েছিল তার কোনোটিই অকাট্যভাবে প্রমানীত হয়নি। নাইন-ইলেভেন ফ্যাক্টস নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে যা, হামলার সাথে মার্কিন নিওকন ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের যোগসুত্র অগ্রাহ্য করা যায় না। তাৎক্ষণিকভাবে আল কায়েদা বা অন্য কোনো মুসলিম জঙ্গিগ্রুপের উপর দায় চাপানোর পর পুরো বিশ্বমুসলিমের উপর ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো মুসলমান অভিবাসন বিরোধী আইন করেছে। বেশ কেয়েকটি মুসলমান প্রধান দেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মুসলিম বিদ্বেষী নানা রকম নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ নিয়ে এক ধরনের ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে মার্কিন প্রশাসন। নাইন ইলেভেন বিমান হামলার ঘটনায় মার্কিন ইহুদিদের ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে ভ‚আসলেও সে সব তথ্যের সত্য মিথ্যা সম্পর্কে তখনি নিশ্চিত হওয়া যেত যদি প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেনকে ধরে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ায় ইন্টেরোগেট করা হত। ঘটনার ১০ বছর পর ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ থেকে ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে মার্কিন মেরিন কমান্ডো বাহিনী যে অভিযান চালিয়েছিল, সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের অন্যতম সহযোগী দেশ হওয়া সত্তে¡ও পাকিস্তানে বাহিনীকে সে অভিযানের সাথে সম্পৃক্ত রাখা হয়নি। তাদের নজরদারীতে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত ধরা তাদের জন্য হয়তো অসম্ভব ছিল না। আত্মগোপনে থাকা লাদেনকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া অভিযোগের ধুম্রজাল ছিন্ন করে প্রকৃত সত্য বিশ্বের মানুষের সামনে তুলে ধরার যে সুযোগ ছিল মার্কিনীরা যেন ইচ্ছা করেই সে সুযোগটি নষ্ট করেছে।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে খৃষ্টান বর্ণবাদী ব্রেন্ট ট্যারান্টের বন্দুক হামলার ঘটনাকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ‘হেইট-ক্রাইম’ বলছেন। তার প্রকাশিত মেনিফেস্টোতেও এই হেইট-ক্রাইম সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা ও সমর্থন পাওয়া যায়। সে তার মেনিফেস্টোতে যে সব বিষয় লিখেছে তার সাথে পশ্চিমা বর্ণবাদী হোয়াইট সুপারম্যাসিস্ট ও নিওকন নেতাদের প্রোপাগান্ডার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। একটি উদার গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী সমাজে বাস করেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকা ফার্স্ট শ্লোগান তুলে যে বর্ণবাদী ও অভিভাসন বিরোধী বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন তার প্রধান টার্গেট হয়েছে মুসলমানরা। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন সমাজের মূল ধারার রাজনীতির প্রতিক্রিয়া ইউরোপের দেশগুলোতে প্রভাব ফেলে। শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ নিউজিল্যান্ড সব ধর্মমতের মানুষের বসবাসের জন্য খুব নিরাপদ স্থান হিসেবে পরিচিত। মুসলিম বিদ্বেষী বর্ণবাদী স্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা সেই দেশটিকে বেছে নিয়েছিল সেখানকার সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নস্যাৎ করার পাশাপাশি সেখানে ক্রমবর্ধমান মুসলমান জনসংখ্যার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনমত ও মানুষকে বিদ্বিষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে। মুসলমান ও অভিবাসিদেরকে সে ইনভেডার বা দখলদার বলে অভিহিত করে রক্তাক্ত ও ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা সে বা তার পৃষ্ঠপোষকরা নিয়েছিল তা শুধু ব্যর্থই হয়নি, বুমেরাং হয়েছে। ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে শুক্রবারের জুম্মা নামাজে বন্দুক হামলার আগে পোস্ট করা মেনিফেস্টোতে হামলার অভিযানকে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ নামে অভিহিত করেছে। সে মনে করেছিল মসজিদে ঢুকে কয়েক ডজন মুসলমানকে হত্যা করলে নিউজিল্যান্ডে মুসলমানদের বিচরণ ও অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার দায় মুসলমানদের চাপানোর মধ্য দিয়ে যেমন আমেরিকায় মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রুখে দেয়া যায়নি, বরং সেখানে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রভাব এবং খৃষ্টানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে কৌতূহল এবং ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার হার আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। একইভাবে ক্রাইস্টচার্চ হেইট-ক্রাইম হত্যাকান্ডের মাত্র দু’দিন পর রবিবার একদিনে সাড়ে ৩৫০ জন সাদা চামড়া নিউজিল্যান্ডার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই ঘটনা থেকে আবারো এটাই প্রমাণীত হচ্ছে, যেখানেই ইসলামের উপর মিথ্যা অপবাদ এবং অন্যায় আঘাত এসেছে, সেখানেই মুসলমানদের অগ্রযাত্রা তত বেশি গতি লাভ করেছে। ব্রেন্টন ট্যারান্ট এবং তার সহযোগীরা দেখো, মানুষ তার বিবেকের শাসনে কখনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে ভয় পায় না। সে সত্য উৎঘাটন ও প্রকাশে আরো বেশি উৎগ্রীব ও সাহসী হয়ে ওঠে। ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকশন ক্যাম্পেইনের সময় রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমেরিকা ফার্র্স্ট স্লোগান নিয়ে মুসলিম ও অভিবাসন বিরোধী মেনিফেস্টো তুলে ধরেছিলেন, তখন পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত প্রবীণ মার্কিন নাগরিক খিজির খান ইরাক যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করে নিজের সন্তান হারানোর কথা তুলে ধরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মার্কিন সংবিধান পড়তে অনুরোধ করেছিলেন। তার আবেগি বক্তব্য ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কংগ্রেসে উপস্থিত সবাইকে আপ্লুত করেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি যত বেশি মুসলিম বিদ্বেষী নীতি গ্রহণ করেছেন মার্কিন রাজনীতিতে পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ সময়ে মুসলমানদের ভূমিকা ও প্রভাব বেড়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে ইলহান ওমর বা রাশিদা তৈয়বের মতো মুসলিম তরুণীদের বিজয়ী হয়ে মার্কিন কংগ্রেসে বর্ণবাদ বিরোধী, ইসলাম বিদ্বেষী ও প্রো-ইসরাইল নীতির বিরুদ্ধে শক্ত আঘাত হানার ঘটনাও এ সময়ে ঘটেছে।
শার্লি হেবদো পত্রিকা অফিসে বন্দুক হামলায় প্রায় ১২ জন নিহত হওয়ার পর সারাবিশ্বে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। ইউরোপের মুসলমানরা একদিকে দুঃসময়ের প্রমাদ গুনছিল, অন্যদিকে সারাবিশ্বের মুসলিম নেতারা শার্লি হেবদো নিহতদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে শরিক হয়ে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা নেতাদের সুরে সুর মেলাতে দেখেছি। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘জে সুইস শার্লি’ লেখা হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ইসলাম বিদ্বেষী কার্টুনিস্টদের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন প্রকাশ করে নিজেদের মানবতাবাদী ও আধুনিক প্রগতিশীল হিসেবে জাহির করতে দেখা গেছে এক শ্রেণীর বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গকে। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই শার্লি হেবদো বন্দুক হামলাকারীদের ইসলামিক টেরোরিস্ট বলে প্রোপাগান্ডা চালানো হলেও ৫০জন নিরীহ, নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যার বাস্তব, চাক্ষুষ তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও ব্রেন্টন ট্যারান্টকে কেউ খৃষ্টান সন্ত্রাসী এমনকি শেস্বতাঙ্গ সন্ত্রাসী বলেও ট্যাগ দেয়নি। এমনকি তাঁকে সন্ত্রাসী না বলে বড়জোর বন্দুকবাজ তকমা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে গণমাধ্যম। তবে নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়রা হামলাকারীর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। গত শনিবার অস্ট্রেলিয়ান লিগ ফুটবলে মেলবোর্ন ভিক্টোরী ক্লাবের স্টাইকার উইঙ্গার কস্তা বারবারোসা গোল করার পর এবং তাকে অনুসরণ করে নিউজিল্যান্ডের ক্লাব ওয়েলিংটন ফনিক্সের খেলোয়াড় রয় কৃষ্ণা মাঠে নামাজের ভঙ্গিতে সেজদা দিয়ে ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অরডেন সেদিন মাথায় হিজাব পরে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন। ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকান্ডের পর নিউজিল্যান্ডে পুলিশের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক নাগরিক সমাবেশে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মুসলমান হিসেবে নিজেকে গর্বিত বোধ করে কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য রাখেন। যতদূর মনে পড়ছে, সাদা চামড়ার এই পুলিশ কর্মকতার নাম নায়লা মাহমুদ। ইন্নালিল্লাহ পড়ে, কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করার মধ্য দিয়ে পুরো অনুষ্ঠানটিতেই মুসলিম ধর্মীয় আবহ তৈরি হয়। ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকান্ডের পর নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্টের প্রথম বিশেষ অধিবেশন মঙ্গলবার কোরান তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে ম্যাসাকারের পরও অস্ট্রেলিয়ার বণবাদী সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিং এই ঘটনার জন্য অভিবাসন নীতি এবং মুসলমানদের দায়ী করলে খোদ অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন তার সমালোচনাসহ প্রতিবাদ করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন এগবয় উইল কনোলি। মুসলিম বিদ্বেষী সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিংয়ের জাতিবিদ্বেষী ও বিতর্কিত বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে সে সরাসরি অ্যানিংয়ের মাথায় ডিম ভেঙ্গে দিয়ে ‘এগবয়’ খেতাবে ভূষিত হয়। জায়নবাদী ও নিওকন বর্ণবাদীরা ইসলামের ক্রমপ্রসারমাণ অগ্রযাত্রাকে ঠেকিয়ে দিতে ইসলামোফোবিয়া প্রোগ্রাম গ্রহণ করেছে। ইসলামোফোবিয়া ও বর্ণবাদী প্রোপাগান্ডার উপর ভর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে মুসলিম বিদ্বেষী যুদ্ধবাদী নীতি বিশ্বকে আরো সংকটাপন্ন করে তুলেছে। এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ব্রেন্টন ট্যারান্টরা মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে রক্তচোষা ড্রাকুলায় পরিণত হয়ে সিজদারত মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যায় মেতে উঠতে পারে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব এসব নরপিশাচদের সমর্থন করছে না। যেমন মুসলমান নামধারী আইএস’র নিষ্ঠুরতাকেও বিশ্বের মুসলমানরা সমর্থন করে না। আল কায়েদা বা আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠি গড়ে উঠার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিরাই দায়ী। ট্যারান্ট মুসলমান অভিবাসিদের ইনভেডার বলেছে। মধ্যযুগে ইউরোপে মুসলমানদের আগমন সেখানে নতুন সভ্যতার বিনির্মাণে মূল ভূমিকা রেখেছিল। তবে ব্রেন্টন ট্যারান্টের পূর্ব পুরুষ কোনো ভাইকিং জলদস্যু ছিল কিনা, একইভাবে জর্জ বুশের পূর্ব পুরুষরা কত লাখ রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করে আমেরিকা দখল করেছিল তা গবেষণা করলেই বেরিয়ে আসতে পারে। এই একবিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা মারণাস্ত্র দিয়ে নয়, ধৈর্য, ত্যাগ ও সাহসিকতার মধ্য দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার নতুন প্রজন্মের হৃদয় জয় করে চলেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গত শতাব্দীর দুইটি মহাযুদ্ধসহ অসংখ্য যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী ঘটনায় কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব কোনোটির জন্য মুসলমানরা দায়ী বা জড়িত না হলেও এসব যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরাই। ব্রেন্টন ট্যারান্টের বর্ণবাদী প্রতিহিংসার গুলিতে ৫০ জন মুসলমান শহীদ হওয়ার তৃতীয়দিনে নিউজিল্যান্ডে স্বেচ্ছায় সাড়ে ৩০০ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে। কোনো মূলধারার সূত্র থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এ সংখ্যা হয়তো ক্রমেই বাড়তে থাকবে। অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে বা নিবর্তনমূলক আইন করে এ অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।