পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইচ্ছা ছিল এবার ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসকে নিয়ে লিখব। লোকে তমদ্দুন মজলিসকে শুধু ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন বলেই জানেন, কিন্তু তমদ্দুন মজলিস শুধু ভাষা আন্দোলন সূচনার দাবিদার প্রতিষ্ঠান নয়; ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার আন্দোলনের পাশাপাশি আরো অনেক কৃতিত্বের দাবিদার তমদ্দুন মজলিস। এসবের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, জমিদারী বিরোধী আন্দোলন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৃতীয় ব্লক আন্দোলন প্রভৃতির জন্য কৃতিত্বের দাবিদার তমদ্দুন মজলিস।
অনেকের ধারণা, ভাষা আন্দোলনের গৌরব একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা সত্য নয়। এমনকি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের গৌরব একুশে ফেব্রুয়ারির আগে আটচল্লিশেও আরেকবার অনেকটা একুশের মতোই অভ্যুত্থান ঘটে এবং সে অভ্যুত্থানে তদানীন্তন প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরেও বাধ্য হয়েছিলেন। ঊনিশ শ’ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আগে ঊনিশ শ’ আটচল্লিশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি মেনে খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে অভ্যুত্থান শুরু হয় ঊনিশ শ’ আটচল্লিশের ১১ মার্চ।
১১ মার্চ শুরু হওয়া সে আন্দোলন এগারো, বারো, তের, চৌদ্দ, পনের মার্চ পর্যন্ত চলতে থাকলে সমস্ত ঢাকা শহরে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে খাজা নাজিমুদ্দিন ভয় পেয়ে যান। আর কয়েক দিনের মধ্যে কায়েদে আজমের ঢাকা সফরের কথা ছিল। তিনি এসে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে অরাজক পরিস্থিতি দেখতে পেলে নাজিমুদ্দিনের প্রতি তাঁর ধারণা ভালো থাকার কথা নয়। এ কারণেই ১৫ মার্চ তারিখে নিজে উদ্যোগ নেন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটা চুক্তি সম্পাদন করতে। চুক্তি সম্পাদনের ফলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়। এরপর ১৯ মার্চ কায়েদে আজম ঢাকা আসেন। ঢাকায় এসে রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দেন।
উভয় স্থানেই কায়েদে আজম ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন। উভয় স্থানেই তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ হয়। রেসকোর্স ময়দানের বিরাট ময়দানে কে কোথায় তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়, তা তিনি খেয়াল করতে না পারলেও কার্জন হলের মিলনায়তনের সীমিত উপস্থিতিতে তার চোখের সামনে ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রতিবাদ ওঠে, তিনি বিস্ময়ে অবাক হয়ে যান। কারণ, এই ছাত্ররাই মাত্র কিছু দিন আগে পাকিস্তান আন্দোলনে তার আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাকে সমর্থন জানিয়েছিল। তারা এত শীঘ্র এমন বদলে গেল কী করে! তিনি তার বক্তৃতা বন্ধ করে কার্জন হল ত্যাগ করে চলে যান। পরে তিনি ছাত্রদের সঙ্গে এ ব্যাপারে ঘরোয়া পরিবেশে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ আলোচনায় উভয় পক্ষ যার যার বক্তব্যে অটল থাকায় আলোচনা ব্যর্থ হয়।
তবে একটা ব্যাপার ছিল লক্ষণীয়। ঐ বছর (১৯৪৮) ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোনো প্রকাশ্য বক্তব্য দেননি তিনি। বরং তার মৃত্যুশয্যায় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বখশের কাছে একাধিকবার তিনি বলেন, জীবনে অন্যের কথা বিশ্বাস করে আমি কয়েকটি ব্যাপারে ভুল করেছি। এর অন্যতম হচ্ছে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে। এটা আমার গণপরিষদের কাছে ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল।
ভেবেছিলাম আজকের উপসম্পাদকীয় কলামে এসব লিখব। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভূমিকা দেখার পর আমার পূর্বের সিদ্ধান্ত বদল করতে হলো। কেন, এবার সেটাই বলছি। আগেই বলেছি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু করে তমদ্দুন মজলিস নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন। তা ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের কথা। পাকিস্তান নামের নতুন রাষ্ট্র যাত্রা শুরু করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। এর অল্পদিন পর ঐ বছরই (১৯৪৭) ১ সেপ্টেম্বর নতুন রাষ্ট্রের সঠিক দিকনির্দেশনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস নামের সংগঠনটি। এই মজলিসের পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পুস্তিকা মারফত পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠির মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে তমদ্দুন মজলিস। ১৯৪৭ সালেই অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
ইতোমধ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থকরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের একটি ছাত্র সংগঠন গঠন করে। গঠনের পর থেকেই এই ছাত্রলীগ তমদ্দুন মজলিসের সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়া শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধভাবে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ায় এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কোনো কোনো জেলায় একই ঘরে এই দুই সংগঠনের শাখা অফিস স্থাপিত হয়। এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেখা যায় জামালপুর ও বাগেরহাটে, সেখানে একই সঙ্গে দুই সংগঠনের অফিস ছিল।
এবার আমরা আমাদের দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আসি। গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ বাংলাদেশে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তা কোনোভাবেই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে মেনে নেয়া যায় না। এটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী প্রহসন। সারাদেশ থেকে এ নির্বাচনকে বাতিল ঘোষণা করে নতুনভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। সে দাবি এখনো পূরণ হয়নি। এরই মধ্যে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। জনগণের ধারণা ছিল, ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে যত অনিয়মই হয়ে থাক, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের নিয়ে যে নির্বাচন, তাতে কোনো অনিয়ম হবে না। কারণ, আমরা প্রায়ই বলে থাকি, ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ। সেই ছাত্রদের মধ্যেও যদি কলঙ্কজনক ঘটনা সংঘটিত হয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ বলে আশা করার আর কিছুই থাকে না। কিন্তু আমাদের সমস্ত প্রত্যাশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে দিয়েছে ডাকসু নির্বাচনে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কলঙ্কজনক ভূমিকা।
এখানে আমরা ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে গত মঙ্গলবারের পত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা এক এক করে তুলে ধরছি। এ সম্পর্কে দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রধান শিরোনাম ছিল: বিতর্কিত ডাকসু নির্বাচন। উপশিরোনাম ছিল, ঢাবি ক্যাম্পাস উত্তাল: আজ থেকে লাগাতার ধর্মঘট। প্রকাশিত খবরের সাথে ছিল ডাকসু নির্বাচন বাতিল ও পুনঃনির্বাচনের দাবিতে ছাত্রদের বিশাল ছবি। ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, আইয়ুব আমলেও এমন কলঙ্ক হয়নি নির্বাচনে। দৈনিক ইত্তেফাক খবরটি ছেপেছে যে শিরোনামে তা ছিল: ‘অনিয়ম, বর্জনে ডাকসু নির্বাচন’। দৈনিক ইত্তেফাকে এ সম্পর্কে আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: প্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা। আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্রধর্মঘটের ডাক। প্রথম আলোয় প্রধান শিরোনাম ছিল: উৎসবের ভোট অনিয়মে শেষ। আরেকটি শিরোনাম ছিল অনিয়মের প্রতিবাদে সরব ছাত্রীরা। শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রতিক্রিয়া ছিল। খুবই হতাশ হয়েছি।
দৈনিক সমকালও এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘ছয় প্যানেলের ভোট বর্জন’। দৈনিক নয়া দিগন্ত খবরটি যে শিরোনামে প্রকাশ করেছে তা ছিল: ডাকসুতেও সংসদ মডেল। ঐক্যফ্রন্ট বলেছে: ভোট ডাকাতির পুনরাবৃত্তি।
পরিশেষে যে কথাটি অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে চাই, তা হলো ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যেসব অনিয়মে হয়েছে, তাতে আমাদের বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে। বহু আশা ছিল, সরকার আর যাই করুক, জাতির ভবিষ্যৎ যাদের ওপর নির্ভর করছে, তাদের ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করবে না। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের ঘটনা প্রমাণ করেছে, সরকার শুধু বর্তমানকে ধ্বংস করেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না, তারা চায় বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে জাতির ভবিষ্যৎও যেন ধ্বংস হয়। ডাকসু নির্বাচন মারফত তারা তাদের সেই লক্ষ্যই তারা কার্যকর করেছে, যেটা করেছে তারা ৩০ ডিসেম্বর। বর্তমান প্রজন্মকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করার পর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধ্বংস যাতে নিশ্চিত হতে পারে, তার ব্যবস্থা করছে। তাদের এ কার্যক্রম বাংলাদেশের কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক বা দল চোখ বুজে মেনে নিতে পারবে না।
আমরা ডাকসুর নির্বাচন বাতিল করার পর নতুন করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা দাবি করছি এবং ভিসিসহ যেসব কর্মকর্তা এই অনিয়মের জন্য দায়ী, তাদের অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমাদের গর্ব ও গৌরবের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাহার করার দাবি রাখছি।
আমরা যারা একদা ভাষা আন্দোলনে সহযোগী হিসেবে পেয়ে ছাত্রলীগকে নিয়ে গর্ব ও গৌরব বোধ করতাম, তারা ছাত্রলীগের বর্তমান অধঃপতনে অত্যন্ত মর্মাহত ও দুঃখিত, আওয়ামী লীগের পাল্লায় পড়ে তার দেশ ও গণতন্ত্রবিরোধী ভূমিকার জন্য চরম লজ্জাবোধ করছি। জানাচ্ছি ছিঃ! ছিঃ!!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।