চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুফতী মুহাম্মদ আমীর হুসাইন
পবিত্র শাবান মাসের একটি ফজিলতপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্য ম-িত রাত শবে বরাত। ১৪ শাবান দিবাগত রাতই সেই শবে বরাত। আরবি মাসে রাত আগে আসার কারণে ১৪ শাবান দিবাগত রাতই ১৫ শাবানের রাত। রাসূল (সা.) হাদিসে এ মহিমান্বিত রাতকে “লাইলাতুন্ নিসফ্ মিন শাবান” ১৫ শাবানের রাত বলেছেন।
ফার্সি শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত/রজনী। আর বারাআত অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃৃতি, অব্যাহতি, পবিত্রতা ইত্যাদি। সুতরাং শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায়- মুক্তি, নিষ্কৃতি ও অব্যাহতির রজনী। এ রাতে যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা পাপী লোকদের ক্ষমা করেন, নিষ্কৃতি দেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, সেহেতু এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত বলা অযৌক্তিক নয়।
ফজিলত
(১) এ প্রসঙ্গে হযরত আয়শা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে যে, নবী করিম (সা.) হযরত আয়শা (রা.) কে সম্বোধন করে বললেন, হে আয়শা! এ রাতে কি হয় জান? হযরত আয়শা (রা.) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল (সা.) বললেন, এ রাতে আগামী বছর যত শিশু জন্ম নিবে এবং যত লোক মারা যাবে তাদের নাম লেখা হয়, মানুষের বিগত বছরের সব আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং মানুষের রিজিক অবতীর্ণ হয়। (মিশকাত শরীফ ১ম খ- পৃ. ১১৫)
(২) হযরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ১৫ শাবান রাতে এ শবে বরাত থেকে পরবর্তী শবে বরাত পর্যন্ত মানুষের বয়স নির্ধারিত হয়। এমনকি এ সময়ের মধ্যে কেউ তো বিয়ে করে তার সন্তান জন্ম নেয় অথচ দুই শাবানের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যারা মারা যাবে তাদের তালিকায় তার নাম রয়েছে।
পূর্বোক্ত হাদিসদ্বয় বিশদভাবে পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমেয় যে, লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান- (শবে বরাত) ভাগ্য রজনীও বটে।
শবে বরাতের করণীয়
শবে বরাত মহান বিধাতার পক্ষ থেকে উম্মতে মুসলিমার জন্য এক বিশেষ উপহার, তাই এ রাতে আমাদের করণীয় ইবাদাত সম্পর্কে নি¤েœ বিধৃত হল :
(১) রাত জেগে ইবাদাত করা। যেমন- নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। কেননা হাদিসে পাকে এসেছে- এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং ফজর পর্যন্ত মানুষকে তাঁর কাছে ক্ষমা, রোগ মুক্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, রিজিক ইত্যাদি বৈধ প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রার্থনা করার জন্য আহ্বান করতে থাকেন।
হযরত আবু বকর (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন- আল্লাহ তায়ালা শবে বরাতে পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং কাফের-মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করেন।
হাদিসের ব্যাখ্যায় এসেছে এ ধরনের লোকেরাও যদি খালেছভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ভবিষ্যতে আর কুফরি, শেরেকি ও হিংসা করবে না বলে ওয়াদা করে তবে আল্লাহ এদেরও ক্ষমা করে দেন।
(২) পরদিন রোজা রাখা, কেননা রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- ১৫ শাবানের রাত জেগে ইবাদাত কর এবং পরদিন রোজা রাখ।
(৩) যতদূর সম্ভব অনাড়ম্বরভাবে কবর জিয়ারত করা। যেমন হাদিসে পাকের ইরশাদ : হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক রাতে রাসূল (সা.) কে হারিয়ে ফেললাম। অতঃপর আমি তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। অবশেষে তাকে জান্নাতুল বাকীতে পেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, আয়শা তুমি কি আশঙ্কা করছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি জুলুম করবেন? হযরত আয়শা বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল- আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। অতঃপর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ১৫ শাবান আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বনু-কাল্ব গোত্রের মেষের পশম অপেক্ষা অধিক লোককে ক্ষমা করেন। (তিরমিযী- ১ম খঃ পৃ. ১৫৬) উল্লেখ্য, আরবে বনু কালবের অধিক মেষ ছিল।
শবে বরাতে বর্জনীয়
রাসূল (সা.) স্বীয় জীবন মোবারকে এ রাত বারবার পেয়েছেন, আমল করেছেন। এ রাতে কি করতে হবে, কি ভাবে করতে হবে তা বলে এবং সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে আমাদের শিখিয়ে গেছেন। তারপর সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং যুগে যুগে ওলামা ও মাশাইখে কিরাম এ রাতে ইবাদাত করে গেছেন। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শই হুবহু আমাদের অনুসরণ/অনুকরণ করতে হবে। নিজের পক্ষ থেকে বাড়ানো-কমানোর কোনই অবকাশ নেই। আমাদের দেশে শবে বরাতে প্রচলিত কিছু বর্জনীয় কার্যকলাপ নি¤েœ পেশ করা হলো।
(১) অনেকেই এ রাতে মহা ধুম-ধামে হালুয়া রুটির ব্যবস্থা করেন, যার সাথে শবে বরাতের নূন্যতম কোন সম্পর্ক নেই। কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের কোন ভিত্তি নেই। বরং এ পবিত্র রাতে হালুয়া রুটি ইবাদাতে বিঘœ ঘটায়। এর পেছনে পরে মানুষ বঞ্চিত হয় আল্লাহ প্রদত্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত থেকে। কাজেই অন্তত এ রাতে এটা বর্জনীয় (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া)।
(২) অনেকেই এ রাতে আতশবাজি, আলোকসজ্জা, শোরগোল ও হৈ চৈ করে থাকেন যা চরম বিদআত কুসংস্কার, গুণাহের কাজ ও হারাম। এ রাত তো কোন আনন্দ উৎসবের রজনী নয়। অধিকন্তু এটা অপচয়ও বটে। ইসলামে অপচয় করা কবিরা গুণাহ, মহাপাপ। পবিত্র কোরআনে পাকে আল্লাহ পাকের ঘোষণা “তোমরা অপচয় কর না নিশ্চয় অপচয়কারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না”। (সূরা আ’রাফ আয়াত. ৩১) পবিত্র কোরআন পাকে অন্য স্থানে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। “নিশ্চই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই” (বনী ইসরাইল - ২৭)
পরিশিষ্ট
শবে বরাতের সব ইবাদাতই নফল। নফল ইবাদাত নির্জনে একাকী করাই উত্তম। রাসূল (সা.) বহু হাদিসে নফল নামাজ বাড়িঘরে, নির্জনে-নিভৃতে আদায় করার পরামর্শ দিয়েছেন। শবে বরাতের ইবাদাত যেহেতু নফল সেহেতু এ রাতে-মসজিদে ভিড় করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর যদি বাসা-বাড়িতে ইবাদাতের পরিবেশ না থাকে তা হলে মসজিদে যাওয়াই উত্তম। তাবে তাকে বাসায় নফল ইবাদাতের পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। শবে বরাতে নফল নামাযের ধরা-বাঁধা কোনো নিয়ম নেই বরং অন্যান্য নফল নামাজের মতো দুই/চার রাকাত নিয়ত করে সূরায়ে ফাতিহার পরে যে কোনো সূরা মিলিয়ে যত ইচ্ছা পড়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যে, রাতভর নফল ইবাদাত করে ফজর নামাজ কাজা না হয়ে যায়। কারণ হাজার রাকাত নফল নামাজের ছাওয়াব একটি ফরজ নামাজের সমতুল্য হবে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যথাযথভাবে শবে বরাত পালন করার তৌফিক দান করেন।
লেখক : অধ্যক্ষ, জামিয়া আরাবিয়া আহসানুল উলুম (আদাবর মাদরাসা)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।