চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মু. আতাউর রহমান সরকার
॥ এক ॥
মহান রাব্বুল আলামীন একটি বড় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের বসবাসের জন্য এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য আবাসস্থল হিসেবে তৈরী করেছেন। মানুষকে দিয়েছেন “আশরাফুল মাখলুকাত”-এর মর্যাদা। কোন নির্দিষ্ট জাতি, গোত্র বা বর্ণের মানুষ এই মর্যাদার একক দাবীদার নয়, বরং সকল মানুষ সমানভাবে এই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
সৃষ্টি জগতের অন্য যে কোন জীবের সাথে এই পার্থক্যটা গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মহান রাব্বুল আলামীন। বাহ্যিক অবয়ব, মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব অর্থাৎ নৈতিক মূল্যবোধ, জীবন পদ্ধতি সকল দিক দিয়েই মানুষ অনন্য। অন্য যে কোন সৃষ্টির তুলনায় সে স্বতন্ত্র ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। যে ফেরেশতারা সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর তাসবীহ পড়ে তারা থাকার পরও আল্লাহ খলিফার মর্যাদা দিয়ে একদল রক্তে মাংসে গড়া মানুষকে কেন দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন? ফেরেশতাদের এ প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ বলেছেন-
আবার সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই।” তারা বললো, “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে? আপনার প্রশংসা ও স্তুতি সহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি।” আল্লাহ বললেন, “আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।” -সূরা বাকারা-৩০
সূরা যারিয়াতে সে উদ্দেশ্যটাই আরো পরিষ্কারভাবে আল্লাহ বলেছেন-
জিন ও মানুষকে আমি শুধু এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার দাসত্ব করবে-সূরা যারিয়াত-৫৬
এই গোলামী বা দাসত্বের পরিচয়টাকেই আল্লাহ উচ্চ মর্যাদা দান করে সূরা বাকারা-৩০ আয়াতে বলেছেন-“আমি পৃথিবীতে খলিফা প্রেরণ করেছি”
মানুষের পরিচয়টাকে সৃষ্টিকুলে বিশেষত ফেরেশতাকুলের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আদম (আঃ) কে সিজদা করার জন্য।
যখন আমি তাকে পূর্ণ অবয়ব দান করবো এবং তার মধ্যে আমার রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দেবো তখন তোমরা সবাই তার সামনে সিজদাবনত হয়ো- সূরা হিজর-২৯
অর্থাৎ শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং মানুষের চমৎকার অবয়ব দান করে, পৃথিবীর চারপাশকে তার অনুকূলে এনে তাকে এ মর্যাদার উপযোগী করে গড়ে তুললেন। অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
তোমরা কি দেখো না, আল্লাহ যমীন ও আসমানের সমস্ত জিনিস তোমাদের জন্য অনুগত ও বশীভূত করে রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও গোপন নিয়ামতসমূহ সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন? এরপর অবস্থা হচ্ছে এই যে, মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের নেই কোনো প্রকার জ্ঞান, পথনির্দেশনা বা আলোক প্রদর্শনকারী কিতাব। -সূরা লুকমান-২০
এই নিয়ামত ও মর্যাদা শুধুমাত্র মানুষ হিসেবেই সে লাভ করেছে। এতে সাদা কালো, আরব-অনারব, প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্য, উঁচু-নিচুর কোন ভেদাভেদ নেই। কেননা একই আত্মা থেকে সকলের সৃষ্টি। মহানবী (সাঃ) মানুষের এই নিয়ামত ও মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে তাওয়াফকালীন পবিত্র কাবা ঘরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন ঃ
[“কতই না পবিত্র তুমি। তোমার পরিবেশ কতই না মনোমুগ্ধকর, কত মহান তুমি এবং কতই না মহান তোমার মর্যাদা। যে আল্লাহর হাতে মোহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ করে বলছি, একজন মুসলমানের জানমাল ও রক্তের মর্যাদা আল্লাহর নিকট তোমার চাইতেও বেশী”-(ইবনে মাজাহ, হাদীস নং -৩৯৩২, মুসনাদে আহম্মদ)।]
আল্লাহ রাব্বুল আলমীন মানুষকে এত বেশি মর্যাদা দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি অসৎ পথকে গ্রহণ না করে সৎ পথকে বেছে নিল তার মর্যাদা ফেরেশতার চেয়েও বেশি। কেননা একজন ফেরেশতার কাজই হল আল্লাহর তাসবীহ করা আল্লাহর হুকুম পালন করা কিন্তু মানুষের সামনে আল্লাহ ভাল ও মন্দ যে কোন একটি পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন।
মানুষ যে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে অনেক বেশি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন তার কারণ হল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে নৈতিকতার মানদ- দিয়ে দিয়েছেন যা অন্য কোন প্রাণীর নেই। এই পার্থক্য প্রথম দৃশ্যমান হয় আদম সন্তান হাবিল ও কাবিলের ঘটনায়। কাবিল যখন হাবিলকে হত্যা করল, অনেকটা উ™£ান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একটি কাকের মাধ্যমে ইংগিত প্রদানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন মৃত ব্যক্তির লাশ উন্মূক্ত না রেখে তাকে মাটির নিচে সুন্দরভাবে কবর দিতে হবে। দুনিয়ার প্রথম হত্যাকা- ছিল এটি। একটা পশুর সাথে মানুষের মূল্যেবোধগত পার্থক্য এটি।
ইসলাম পূর্ব যুগে মানুষের মর্যাদা বা সম্মান কিছুই ছিল না বললেই চলে। পণ্যের মত মানুষ বেচাকেনা হতো। দাস হিসাবে কেনা গোলাম হয়ে থাকতো সবাই। ঝগড়া, মারামারি, শত্রুতার কারণে হত্যা- খুন ছিল নিত্য দিনের সঙ্গী। নারীদের অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। জীবিত কন্যা সন্তানকে মাটিতে পুঁতে হত্যা করা হতো। সমাজে তাদের অস্তিত্ব ছিল অনাকাংক্ষিত। সমাজে না ছিল ইনসাফ, না ছিল শান্তি, না ছিল নৈতিকতা, মূল্যবোধের কোন অস্তিত্ব। এই অবস্থায় মানুষের অনন্য অতুলনীয় মর্যাদা নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। নাযিল হল পবিত্র কুরআন। পরিপূর্ণ হল দ্বীন ইসলাম। প্রতিষ্ঠিত হল মানুষের চমৎকার কিছু মর্যাদা। নি¤েœ তা তুলে ধরা হলো:
মানুষ হল খলিফাতুল্লাহ ঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে তার খলিফা হিসেবে ঘোষণা দিলেন। মানুষ হল দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষের কাজ হলো আল্লাহকে এক ইলাহ হিসেবে মেনে নিয়ে জীবনের সবক্ষেত্রে তার প্রতিনিধিত্ব করা। এরশাদ হচ্ছে ঃ
তিনিই তোমাদের করেছেন দুনিয়ার প্রতিনিধি এবং যা কিছু তোমাদের দিয়েছেন তাতে তোমাদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কাউকে অন্যের ওপর অধিক মর্যাদা দান করেছেন। নিঃসন্দেহে তোমার রব শাস্তি দেবার ব্যাপারে অতি তৎপর এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও করুণাময়-সূরা আনআম-১৬৫
মানুষ হল আনসারউল্লাহ ঃ
মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে এক আল্লাহর দাস, গোলাম হওয়ার মর্যাদা দিলেন। এমনকি তার আহবানে সাড়া দানকারীদের ‘আনসারউল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র মনিব মহান রাব্বুল আলামীনের সাথে সরাসরি এই সম্পর্ক নিঃসন্দেহে মানুষকে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করল।
আল্লাহর সাথে মানুষের চুক্তি ঃ
আল্লাহ নিজেই মানুষকে দিলেন জান ও মাল। আবার সেই জান মাল কে বিক্রি করারও সুযোগ করে দিলেন। আর সেই ক্রয়-বিক্রয়ের বিনিময় বস্তুটি কোন সামান্য কিছু না বরং সেটি জান্নাতের বিনিময়ে। মহান আল্লাহ বলেন- প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের প্রতি তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে (জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ। আর আল্লাহর চাইতে বেশী নিজের ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনাবেচা করছো সেজন্য আনন্দ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য-সূরা তাওবা-১১১।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।