Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

মাদক পাচারে সাত দেশের ট্রানজিট বাংলাদেশ

আফগানিস্তান থেকে করাচি হয়ে নৌপথে শ্রীলংকা : কলম্বোয় গ্রেফতারকৃত তিন বাংলাদেশীর চাঞ্চল্যকর তথ্য : একাধিক পাসপোর্টে একই দেশে বার বার ভ্রমণ

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

একাধিক পাসপোর্ট সংগ্রহ করে একই দেশে বার বার ভ্রমন করেন মাদক চোরাচালানের সাথে জড়িতরা। শুধু একাধিক পাসপোর্ট নয়, পরিচয় গোপন করেও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের বাংলাদেশী নাগরিকরা। বাংলাদেশকে ট্্রানজিট রোড হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারি চক্র। মূলত আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, দুবাই ও মালয়েশিয়া কেন্দ্রীয় গড়ে উঠা ওই চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে ২৫ থেকে ৩০জন বাংলাদেশী। এরই মধ্যে চীনে ২ জন, শ্রীলংকায় ৩০২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি ২৯৮ গ্রাম কোকেনসহ ৩জন এবং দেশে ৬জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে নৌপথে করাচি হয়ে শ্রীলংকায় যায় ওই হেরোইন ও কোকেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল শ্রীলংকায় গিয়ে গ্রেফতারকৃত তিন বাংলাদেশিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেশে ফিরেছেন। তদন্তে তারা আন্তর্জাতিক হেরোইন ও কোকেন পাচারের সঙ্গে জড়িত ও রুট সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। ওই সূত্র ধরে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, সিআইডি ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছে। দায়িত্বশীল সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিনিধি দলের কর্মকর্তারা শ্রীলংকা কারাগারে তিন বাংলাদেশীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। শ্রীলংকার পুলিশ প্রধান ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বৈঠকও করেন।
তদন্তের সাথে জড়িত ও শ্রীলংকা থেকে ফিরে আসা কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৬ সালে শ্রীলাংকায় ৯৬২ কেজি হেরোইন উদ্ধার করা হয়। ওই হেরোইন পাচারের সাথে ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীরা জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য পায় শ্রীলংকার তদন্তকারী দল। এছাড়া ২০১৮ সালে চীনের গুয়াংজু এলাকায় মাদকসহ দু’জন বাংলাদেশী নারী গ্রেফতার করে আইন-শৃংখলা বাহিনী। ওই দু’জন নারী হলেন-শাহিনা আক্তার ও শারমিন আক্তার। এছাড়া সর্বশেষ গত ৩১ ডিসেম্বর শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোর উপকণ্ঠ মাউন্ট লাভিয়ানা এলাকায় গ্রেফতার হয় জামাল উদ্দিন ও দেওয়ান রফিউল ইসলাম নামে দুই বাংলাদেশি নাগরিক। এ সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেন। এর আগে ১৪ ডিসেম্বর কলম্বোর উপকণ্ঠের একই এলাকা থেকে প্রায় ৩২ কেজি হেরোইনসহ গ্রেফতার হয় সূর্যমণি।
ওই সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতরা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সদস্য। মূলত আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, দুবাই ও মালয়েশিয়া কেন্দ্রীয় গড়ে উঠা ওই চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে ২৫ থেকে ৩০জন বাংলাদেশী। যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০জনের অধিক। সূর্যমনি এর আগে ৬বার শ্রীলংকা ও ২বার মালয়েশিয়ায় ভ্রমন করেন। এ সময় তিনি মাদক বহন করে নিয়ে যান।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই চক্রের অন্যতম শেখ মোহাম্মদ আরিফ উদ্দিন ও শেখ আহমেদ হোসেন সুমন। ওই দু’জনেরই একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে। আরিফের বাড়ি বগুড়ায় এবং সুমনের বাড়ি নীলফামারী জেলায়। কিন্তু সুমনের পাসপোর্টে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে তা ভূয়া। এ ধরনের ৪জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। যাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তাছাড়া বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা কিভাবে একাধিক পাসপোর্ট সংগ্রহ করলো তাও তদন্ত করা হচ্ছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এক সময় শেখ সুমন হেরোইন ও কোকেনের বড় কারবারি হয়ে ওঠেন। দীর্ঘদিন তিনি টঙ্গীতে বসবাস করেছেন। সেখানে ২০১৫ সালে আনিছা নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন তিনি। বর্তমানে তার পরিবার লন্ডনে রয়েছে। শ্রীলংকায় হেরোইন ও কোকেন জব্দের বিষয়টি জানাজানি হলে দেশ থেকে দুুবাই পালিয়ে যান সুমন ও আরিফ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম সিকদার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, তদন্তে উঠে এসেছে শ্রীলংকায় জব্দ হেরোইন নৌপথে এসেছিল আফগানিস্তান থেকে। করাচি বন্দর থেকে মাছ ধরার নৌযানে তা পাচার হয়। আর উত্তর আমেরিকা থেকে এসেছিল কোকেন। গ্রেফতার বাংলাদেশের তিন নাগরিক বলেছেন, তিন-চার বছর ধরে তারা হেরোইন ও কোকেন বহনের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে সূর্যমনি খুব অভিজ্ঞ। তিনি তামিল ভাষাও কিছু বলতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, শ্রীলংকা ও চীনে মাদকসহ গ্রেফতারকৃদের সাথে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের সাথে জড়িতদের যোগাযোগ কতটুকু তা তদন্ত করা হচ্ছে। দেশের ভেতর মাদক চোরাচালানের সাথে জড়িতদের এবং অর্থলঘ্নিকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। শ্রীলংকার যে মাদক উদ্ধার করা হয়েছে তার বাজার মূল্য ৩শ’ কোটি টাকার উপরে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের সাথে জড়িতদের শনাক্ত, অর্থলগ্নিকারী এবং কোন পথ দিয়ে কিভাবে মাদক পাচার হয় তা নিয়ে কাজ করছি। মাদক নিয়ন্ত্রণে এ বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
দায়িত্বশীল একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, শ্রীলংকায় গ্রেফতারকৃত তিন বাংলাদেশিকে সহসায় দেশে আনার তেমন কোনো সুযোগ নেই। কারণ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে এ ঘটনার সূত্র ধরে এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শেখ মোহাম্মদ আরিফ উদ্দিন ও শেখ আহমেদ হোসেন সুমনসহ বেশ কয়েকজনকে খুঁজছে। শ্রীলংকার ঘটনার সূত্র ধরে এরই মধ্যে সিআইডি চয়েজ রহমান নামে একজনকে গ্রেফতার করে। র‌্যাব পৃথকভাবে ৫জনকে গ্রেফতার করে। এরা হলেন- ফাতেমা ইমাম তানিয়া (২৬), আফসানা মিমি (২৩), সালমা সুলতানা (২৬), শেখ মোহাম্মদ বাঁধন ওরফে পারভেজ (২৮) ও রুহুল আমিন ওরফে সায়মন (২৯)। এ পাঁচজনের মধ্যে চারজন একাধিকবার বিদেশে মাদক পাচারে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে তানিয়া দু›বার ভারতে, তিনবার চীনে, ৮-১০ বার মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকায় যাতায়াত করেছেন। মিমি অন্তত চারবার ঢাকা-শ্রীলংকা-মালয়েশিয়া এবং সালমা চীন, শ্রীলংকা ও ভারতে যাতায়াত করেছেন। পারভেজ দীর্ঘদিন শ্রীলংকায় অবস্থান করেছেন।
হেরোইন কারবারের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের করিমপুরের সূর্যমণি, জয়পুরহাটের রামনগরের দেওয়ান রাফিউল ইসলাম হিরো, বগুড়া সদরের সূত্রাপুরের জামাল উদ্দিন, জয়পুরহাটের দলহারার চয়েজ রহমান, বগুড়ার সূত্রাপুরের শেখ মোহাম্মদ আরিফ উদ্দিন, নীলফামারীর গোলাহাটের শেখ আহমেদ হোসেন সুমন, রাজধানীর উত্তরখানের শাহিনা আক্তার ও রেহানা আক্তার লাকীর।
সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে আলবেনিয়া থেকে দেশে ফিরে আসেন চয়েজ রহমান। এরপর ২০০৭ সালে শুরু করেন বায়িং হাউসের ব্যবসা। ২০১৪ সালের দিকে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সূর্যমণি ও রাফিউল ইসলামকে পাসপোর্ট তৈরি করেন দেন তিনি। চয়েজ রহমানের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন আরিফও। ওই সময় চয়েজের সঙ্গে শেখ সুমনের পরিচয় করিয়ে দেন আরিফ। ২০১৫ সালে হঠাৎ আরিফ চয়েজ রহমানের তুলনায় একটি দামি প্রাইভেটকার কেনেন। তখন চয়েজ ভাবতে থাকেন, তার প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী তার চেয়ে দামি গাড়ি কীভাবে ব্যবহার করেন। এ নিয়ে আরিফের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়।



 

Show all comments
  • আঃ রহমান ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:৩০ পিএম says : 0
    এদেরকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাদক

২২ অক্টোবর, ২০২২
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ