পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খেলাফতের দুই মহাশত্রুর যোগসাজশে আব্বাসীয় খেলাফতের পতন ঘটে। এটি ঐতিহাসিকদের চূড়ান্ত অভিমত। এ দুইজনের একজন আব্বাসীয় খলিফার শিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং অপরজন হালাকুখানের শিয়া প্রধান উপদেষ্টা। এ দুজনের গভীর ষড়যন্ত্রের শোচনীয় পরিণতি আব্বাসীয় খেলাফত ও খলিফা পরিবারের পতন। খলিফা মোস্তাসেম বিল্লাহর মন্ত্রী মোওয়ায়্যুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে আলকামী ছিলেন একজন কট্টর শিয়া, অপরদিকে হালাকুখানের প্রধান উপদেষ্টা আল্লামা নাসিরুদ্দীন তুসীও ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। তার সর্ম্পকে শেখ তাজুদ্দীন সুবকী বলেন, তারই পরামর্শ অনুযায়ী খলিফাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যার বর্ণনা পরবর্তীতে রয়েছে। তবে প্রথমেই হালাকুখান কর্তৃক বাগদাদ অবরোধের ঘটনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
হালাকুখানের বর্বর হিংস্র তাতার বাহিনী মঙ্গোলিয়া থেকে সয়লাবের ন্যায় উঠে এসে প্রথমে বোখারার দিকে অগ্রসর হয়। মুসলমানদের এ প্রধান শহর ধ্বংস্তূপে পরিণত করে হালাকু বাহিনী সমরকান্দে ধ্বংসলীলা চালায়। অতঃপর রায়, হামদান, জানজান, কাজভীন, মার্ভ, নিশাপুর এবং খাওয়ারেজমকে ধ্বংস করে। এসব শহরের অধিবাসীদের হত্যা, লুটপাট তথা অরাজকতা চরম পর্যায়ে উপনীত করে। এসব এলাকায় ইমারত-অট্টালিকাগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত এবং সর্বত্র রক্তবন্যা বইয়ে দেয়। এর পরে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে হালাকুখানের নেতৃত্বে তার হিংস্র বাহিনী ইসলামী বিশে^র রাজধানী এবং সেকালের প্রধান ইসলামী কেন্দ্র বাগদাদে প্রবেশ করে। এ সর্ম্পকে ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে বিবরণের বিভিন্নতা লক্ষ করা যায় এবং ইবনে আলকামী ও নাসিরুদ্দীন তুসীর মধ্যে গোপন যোগাযোগ ও বিশ্বাস ঘাতকতার বর্ণনা রয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনার একটা সংক্ষিপ্ত সার নিম্নরূপ:
‘আছমাঁরা হক বুওয়াদ গার খুঁ বরেজাদ বর জমিঁ।
বর জাওয়ালে আলে মোস্তাসেম আমীরুল মোমেনীন।।’
অর্থাৎ আমীরুল মোমেনীন খলিফা মোস্তাসেম বিল্লাহ ও তাঁর সপরিবারে হত্যাকান্ডে আসমান পর্যন্ত অশ্রু বিসর্জন দেয়। হযরত শেখ সা’দী (রহ.) হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতনে যে শোকগাঁথা রচনা করেন তারই এক স্থানে তিনি এ মর্মবেদনা প্রকাশ করেন। অথচ বাগদাদ ধ্বংসের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে খলিফা মোস্তাসেমের রাফেজী মন্ত্রী খলিফাকে সপরিবারে নিমর্মভাবে হত্যা করার প্রধান নায়ক ছিলেন। তিনি খলিফার লাশের অবমাননা করার সময় বলেছিলেন, ‘আমি আহলে বায়তের প্রতিশোধ নিলাম।’ মোওয়ায়্যিদুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে আলকামীর নিকট খলিফা রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা অর্পণ করে দিয়েছিলেন এবং এই ইবনে আলকামীর আহ্বানেই হালাকু খান তার বাহিনীসহ বাগদাদ আক্রমণ করেন, যার করুণ পরিণতি হিসাবে বাগদাদের পতন হয়।
বাগদাদের পতনের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল খলিফা মোস্তাসেম বিল্লাহর রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সম্পর্কে বে-খবর ও অসাবধান থাকা এবং আব্বাসীয় খেলাফতের ঘোর বিরোধী এমন একজন লোককে অসাধারণ ক্ষমতা প্রদান করা, যিনি গোপনে এর ধ্বংস কামনা করতেন। মোস্তাসেমের পিতা মোস্তানসের বিল্লাহ ছিলেন ৩৬তম আব্বাসীয় খলিফা। তিনি এমন এক চরিত্রের লোক ছিলেন, যিনি সোনাকে পর্যন্ত মাটি মনে করতেন এবং বলতেন যে, ‘আমার ভয় হয় আমি যা কিছু দান করে থাকি তার কোন সওয়াব(গুণ) আমি পাব না। কেননা, আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, তোমরা যদি পছন্দনীয় বস্তু ব্যয় না কর তা কবুল হবে না। সোনা-রূপা তো আমার কাছে মাটি অপেক্ষা উত্তম নয়।’
এমনি পিতার সন্তান ছিলেন মোস্তাসেম। তাঁর কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতারও কোনো গুরুত্ব ছিল না। ইবনে আলকামীর ওপরই ছিলেন তিনি সম্পূর্ণ আস্থাবান। তাঁর আমলে হালাকু খানের সাম্রাজ্যে বিস্তার ও বিজয় অভিযান অব্যাহত গতিতে চলছিল। অথচ সেদিকে তাঁর কোনোই দৃষ্টি ছিল না। তিনি নিশ্চিন্তভাবে ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকেন। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ইবনে আলকামীও কসুর করেননি, রাষ্ট্রের সকল দিক থেকে খলিফার দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করেন এবং সঠিক পরিস্থিতি খলিফাকে না জানিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ইবনে আলকামী বানোয়াট কাহিনী তাঁকে শোনাতে থাকেন। হালাকু খানের সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে সৈন্য সংখ্যা হ্রাস করার পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল হালাকু খানকে বিনা প্রতিবন্ধকতায় বাগদাদে প্রবেশের সুযোগ দেয়া।
তাতারীরা বাগদাদ আক্রমণ করবে না বলে খলিফার ধারণা ছিল। এরূপ কোনো ইচ্ছা প্রথমে হালাকু বাহিনীরও ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন শোচনীয় অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইবনে আলকামীর আহ্বানে হালাকু খান সাড়া দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন। এ অবস্থায় তাঁর বিশাল বাহিনীসহ তিনি বাগদাদ অভিমুখে যাত্রা করেন। সামরিক দিক দিয়ে অরক্ষিত ও অপ্রস্তুত বাগদাদের ক্ষুদ্র দুর্বল বাহিনী ব্যর্থ প্রতিরোধ করে। অতঃপর হালাকু বাহিনী চর্তুদিক থেকে বাগদাদ অবরোধ করে। হিজরী ৬৫৫ সালের জিলহজ্জ মাসের শেষ দিকে এই অবরোধ শুরু হয়। তবে অনেকের মতে, হিজরী ৬৫৬ সালের ১২ মহররম (১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে) তারিখে অবরোধ শুরু হয় এবং ২৮ মহররম পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। কেউ কেউ বলেন, অবরোধের তারিখটি ছিল ১৫ মহররম। আর বাগদাদের পতন ঘটে ৪ সফর।
ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ ও বাগদাদ ধ্বংসের পর হালাকু খান যে কর্মটির মাধ্যমে তাঁর বিজয় সম্পূর্ণ করেন, তা হচ্ছে আব্বাসীয় সর্বশেষ খলিফা আল মোস্তসেম বিল্লাহকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা। আবু আহম্মদ আব্দুল্লাহ মোস্তাসেম বিল্লাহ ইবনে মোস্তানসের হিজরী ৬০৯/১২১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৪০/১২৪২ সালে খেলাফত লাভ করেন। তাঁর আমলে চেঙ্গিস খানের পুত্র তাওয়াল্লি খান খোরাসানের বাদশাহ ছিলেন। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যে বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ইরানের যেসব এলাকা তখনও তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তিনি সেগুলো অধিকার করেন। কিন্তু বাগদাদের দিকে তিনি অগ্রসর হননি। কেননা তাঁর ধারণা ছিল যে, খেলাফতের কেন্দ্রে আক্রমণ চালালে সমগ্র মুসলিম বিশ^ তাঁর বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। হিজরী ৬৫৪ সালে তাওয়াল্লি খান মারা যাওয়ার পর তাঁর পুত্র হালাকু খান তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। এসময় বাগদাদের কতিপয় কপট বিশ্বাসী- মোনাফেক তাঁর সাথে মিলে যায় এবং তাঁকে বাগদাদ আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে।
এটি সে যুগের কথা, যখন বাগদাদের অধিকাংশ লোক ছিল সুন্নী। কিন্তু শিয়াদেরও একটি দল ছিল, যাদের সাথে সুন্নীদের এক দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ বিরাজ করছিল। শিয়ারা আলাবীদের ইমামতের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং আব্বাসীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে তাঁরা বিশেষ তৎপর ছিল। মোস্তাসেমের আমলে একবার উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। খলিফাতনয় আবু বকরের ইঙ্গিতে সুন্নীরা কার্খ নামক শিয়া মহল্লা লুট করে এবং মহল্লাবাসীদেরকে মারধর করে। এর ফলে খলিফার কট্টর শিয়াপন্থী উজির ইবনে আলকামী হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণে উদ্ধুদ্ব করেন ।
হিজরী ৬৫৬ সালের ১৫ মহররম হালাকু খান তাঁর বিশাল বাহিনীসহ বাগদাদের দিকে যাত্রা করেন এবং বাগদাদ অবরোধ করেন। খলিফার কাছে প্রতিরোধ করার মতো শক্তি ছিল না। হালাকু বাহিনী দশ দিনের মধ্যে প্রবেশ করে খলিফার সৈন্য বাহিনীকে হত্যা ও লুটপাট আরম্ভ করে। অধিকাংশ শহরবাসী নিহত হয় এবং কতিপয় খিস্টান ও শিয়া ব্যতীত শহরে আর কেউ অবশিষ্ট ছিল না। এভাবে ইসলামী ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যায়। হালাকু খান খলিফা পুত্র আবু বকর ইবনে মোস্তাসেমকে সদলবলে ফাঁসিতে ঝুলান। খলিফা হালাকু খানের কাছে একটি পাত্র ভর্তি হীরা-জহরত পাঠিয়েছিলেন, তা হালাকু খান তাঁর সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। আব্বাসীয় সর্বশেষ খলিফা মোস্তাসেম বিল্লাহকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়, সে লোম হর্ষক কাহিনী শেখ তাজুদ্দীন সুবকীর বর্ণনা হতে জানা যায়। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী:
হালাকু খান বাগদাদ অধিকার করার পর খলিফা মোস্তাসেম বিল্লাহকে একটি তাবুতে আবদ্ধ করে রাখে। অতঃপর মোস্তাসেম বিল্লাহর উজির ইবনে আলকামী শহরের আলেম-ফাজেল সমাজের নিকট আহ্বান জানায় যে, আপনারা আসুন এবং হালাকু ও খলিফার মধ্যে চুক্তিতে আপনারা সাক্ষী হিসেবে সই করুন। এ নির্দেশ পালনার্থে যখন তারা আগমন করেন তখন তাদের সকলকে হত্যা করা হয়। অনুরূপভাবে একের পর দ্বিতীয় এবং দ্বিতীয়ের পর তৃতীয় দলকে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ খলিফার বিশ^স্ত ও দরবারের উচ্চপদস্থ প্রধান ব্যক্তিদের ডাকা হয়, কিন্তু তাদেরও সেই একই পরিণতি হয়, কেউই প্রাণ নিয়ে জীবিত ফিরে যেতে পারেননি। এবার বাকী রইলেন খলিফা। তাঁর সম্পর্কে সাধারণ লোকদের ধারণা ছিল এই যে, যদি খলিফার রক্ত জমিনে পতিত হয়, তাহলে দুনিয়া ভূমিকম্পে পতিত হবে। একারণে হালাকু খান খলিফাকে হত্যা করার ব্যাপারে ইতস্তত করতে থাকে। এতে হালাকুর উপদেষ্টা আল্লামা নাসিরুদ্দীন তুসী তাকে পরামর্শ দিলেন যে, খলিফার রক্ত জমিনে প্রবাহিত না করেও তার প্রাণ হরণ করা যায় আর তা এইভাবে যে, খলিফাকে একটি শতরঞ্জি বা সূতীর কার্পেট কিংবা কোনো কাপড়ে লেপটে দেওয়া এবং পদাঘাত ও লাঠির আঘাতে তাকে খতম করা এবং এভাবেই তাকে হত্যা করা হয়। ইবনে আলকামীও ঘৃণ্যভাবে নিহত হয় বলে বর্ণিত হয়ে থাকে।
বর্ণিত আছে যে, তাতারী হিংস্র পশুরা যখন বাগদাদের অধিবাসীদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে দিশেহারা হয়ে যায়, তখন হালাকু খানের নির্দেশে লাশগুলো গণনা করা হলে দেখা যায়, ১৮ লাখ লাশ রক্ত স্রোতে ভাসছে। তখন বাগদাদের মোট জনসংখ্যা ছিল ২৫ লাখ। মসজিদগুলোতে মদের সয়লাব চলে এবং নিষিদ্ধ করা হয় আযান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।