Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উৎসবের ফেরিওয়ালারা

ইমরান মাহমুদ, চট্টগ্রাম থেকে | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

এ সপ্তাহে একটি ভারী শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস আগেই দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। দুই দিন ভালোই গিয়েছে, আগের দিন সন্ধ্যা থেকে কিছুটা বৈরীতার পর গতকাল সকাল থেকেই ভার চট্টগ্রামের আকাশ। মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি চললো দিনভর। দুপুরে বেরসিক মেঘের সঙ্গে আর পেরে উঠলো না সূয্যিমামা। দুই পরস্থ বৃষ্টি হয়ে ছূঁয়ে গেল জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের সবুজ উইকেট! যেখানে একটু পরই নামার কথা এই চট্টগ্রাম বিভাগেরই দুই দল চিটাগং ভাইকিংস এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
বৃষ্টির কবলে পরে মাচ নামিয়ে আনা হয় ১৯ ওভারে। তাতে কী ‘চট্টগ্রাম ডার্বি’র রঙ ফিকে হতে পারে! হঠাৎ বৃষ্টির পর যেমন ঝলমলে হয়ে ওঠে প্রকৃতি ঠিক তেমনি যেন আরো রঙ বাড়িয়ে দিল ম্যাচের! আর এই রঙ বাড়ানোর কাজের নেপথ্যের নায়কদের নিয়েই আজকের ‘উৎসবের ফেরীওয়ালারা’।
ক্রিকেটপাগল চট্টলার দর্শকের কাছে হার মানলো বৈরী আবহাওয়া। বৃষ্টি উপেক্ষা করে দলে দলে দর্শকরা আসতে শুরু করে সাগর পাড়ের স্টেডিয়ামটির কোলে। হাতে করে আনা নানান রঙের পতাকা, গায়ে প্রিয় দলের জার্সি আর পছন্দের তারকার নামাঙ্কিত মুখগুলো সত্যিই ক্রিকেটের রঙ রাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। ব্যাট-বলের ঝঙ্কারে যখন চার-ছক্কার ফুলঝুরি হয়ে ছোটে, সেটিকে ছাপিয়ে যাওয়া ভুবুজেলার শব্দ কিংবা এই মাঘের শীতেও উলঙ্গ গায়ে এঁকে আনা তারকার নাম- ক্রিকেট বলেই তো এমনটা সম্ভব!
নাসির হোসেন। বয়স সঠিক বলতে পারেন নি। অনুমান করে বললেন, ‘চল্লিশ তো হইবোই’। স্টেডিয়াম প্রবেশ মুখ থেকে নিরাপদ দূরত্বে পাশের ফুটপাথে বসে বিক্রি করছেন ক্রিকেটীয় আনুসঙ্গ- বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা, বিপিএলের লোগো সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, ফ্যাঞ্চাইজির পতাকা, জার্সি, দীর্ঘাকায় টুপি, দলীয় হ্যাট, হ্যান্ড ব্যান্ড। পরিচয় পর্বের এক পর্যায় যখন জানালেন ঢাকা থেকে এসেছেন শুধুমাত্র ফেরী করতে, অবাক না হয়ে পারলাম না। জানলাম, এই বিপিএলের সিলেট পর্বেও গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংরাদেশ ক্রিকেট দলের বিভিন্ন সফরের সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের নানা স্টেডিয়াম, নানা শহর। তবে তাতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়না জানিয়ে বললেন, ‘আমি গত বেশ ক’বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। শুধুমাত্র পেট চালানো হলে এক জায়গায় বসেই কাজটি করতে পারতাম। কেমন যেন নেশা হয়ে গেছে। স্টেডিয়ামের শোরগোল, মানুষের মুখে উল্লাসের যে চিত্র দেখি তাতে মনটাও ভরে ওঠে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘বেটা-কেনা ক্যামন হয়?’ জানালেন, ‘দিনে চার থেকে পাঁচ হাজারের মত। এখানে থাকা-খাওয়া বাদে হাতে যা থাকে তাতেই আমি খুশি। মুানুষের আনন্দের মধ্যে থাকলে নিজের মনও ভালো থাকে।’ জীবনের হাজারো কষাঘাতেও মানুষ নামের অস্বিত্বটা টের পেয়ে মনটা ভরে উঠলো আমারও। ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
বিটাক মোড়ের দিকে আরেকটু এগিয়ে পাওয়া গেল মাঝ বয়সী মোহাম্মদ আনোয়ার নামের আরেকজনকে। এবার আমার অবাক হবার পালা। ৪৫ বছর বয়সী মানুষটাও বিপিএলের ফ্রাঞ্চাইজিগুলো জার্সি নিয়ে এসেছেন সুদূর ঢাকা থেকে! জিজ্ঞেস করে জানলাম, তিনি একাই নন তার সঙ্গে আরো কয়েকজন এসেছেন, ‘ঢাকার মিরপুরে (শেরে বাংলা স্টেডিয়াম সংলঘœ) আমার একাটা স্পোর্টসের (ক্রীড়া সামগ্রীর) দোকান আছে। সেখান থেকেই আমরা এসেছে। বেচা কেনা প্রথম দুই দিন ভালোই ছিল, আইজ একটু কম।’
আমার অবাক হবার সক্ষমতার পরীক্ষা নেবার একটু দূরেই বসে মো: জসিম নামের এক মুরুব্বী। বয়স জিজ্ঞেস করার বেয়াদবীটা করিনি। ষাটের কাছাকাছি তো হবেই। জানতে চাইলাম, ‘আপনিও কী ঢাকা থেকে এসেছেন?’ এক গাল হেসে উত্তর এলো ‘হ’। আর কারো সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। উনার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসের দর-দাম করে জেনে নিলাম উচুঁ টিলার মত হ্যাটগুলো বিক্রি করেন একশো থেকে ষাটের মধ্যে, গোল টুপি পঞ্চাশ, যে কোন দলের বিভিন্ন মাপের পতাকার দর উঠানামা করে ৩০-১০০ টাকা পর্যন্ত, জার্সি ১০০ টাকা, ভুবুজেলা ছোট ৫০ বড় একশ টাকা। আর হান্ড বা হেড ব্যান্ড পাওয়া যায় ১০ থেকে ২০ টাকায়। তবে যারা কোন জিনিস কেনেন তাদের একটি করে চার ছক্কার প্ল্যাকার্ড ‘উপহার’ হিসেবে দিয়ে দেন তাদের সকলেই!
চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেন ব্যাটসম্যানরা, দল জিতে উল্লাস করে পাঁচতারকা হোটেলে। কিন্তু তাদের এই উৎসবের নেপথ্য নায়কদের কি কেই মনে রাখে? যারা শহর থেকে শহরে ফেরী করে বেড়ান উৎসবের!



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উৎসব

২২ ডিসেম্বর, ২০২২
১৭ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ