পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিরোনামটি ধার করা। গত ২৩ জানুয়ারি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার এ শিরোনামে একটি পিলে চমকানো সচিত্র খবর প্রকাশ করেছে। জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী ৪৫ বছর বয়স্ক এক লোক হাইকোর্টে এসেছে জামিন নিতে। তারা মিঞা নামের ওই লোকের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ থানায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা হয়েছে। থানার এএসআই তারিকুল ইসলাম কর্তৃক দায়ের করা মামলার ৫২ জন আসামির সে একজন। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা গত ২৮ ডিসেম্বর জামালগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর বাজারে রাস্তা দখল করে ধানের শীষের মিছিল করছিল। পুলিশ বাধা দিলে মিছিলকারীরা লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক, লোহার রডসহ বিভিন্ন হাতিয়ার নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। হামলাকারীদের মধ্যে উল্লিখিত তারা মিঞাও ছিল। পত্রিকাটি তারা মিঞার একটি ছবিও ছেপেছে। হলুদ রঙের একটি জীর্ণ গেঞ্জি গায়ে শীর্ণ তারা মিঞাকে দেখে কারোরই বিশ্বাস হওয়ার কথা নয় যে, সে কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিলে অংশ নিতে কিংবা পুলিশের ওপর রড-হকিস্টিক নিয়ে হামলা করতে পারে। খবরে বলা হয়েছে, তারা মিঞার ডান হাতটি জন্মগতভাবেই অচল। বাম হাতটিও খুব একটা ভালো নেই। সে তার বাম হাতের সাহায্যে ডান হাতকে প্রয়োজনমতো নাড়াচাড়া করে। যে মানুষটি জন্মগতভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী, সে কি না লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলে পড়েছে সশস্ত্র পুলিশের ওপর! অবিশ্বাস্য ঘটনাই বটে! তারা মিঞা পত্রিকাটির রিপোর্টারকে বলেছে, সে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নয়, কোনো মিছিলেও সে যায়নি। সে তার পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে এখন ভীষণ চিন্তিত। তারা মিঞার অচল হতে লাঠি বা রড ধরার ঘটনা অবিশ্বাস্য হলেও পুলিশের মামলা দায়ের কিন্তু অবিশ্বাস্য বা অলীক ঘটনা নয়। পুলিশের এজাহারে তারা মিঞা কর্তৃক পুলিশের ওপর হামলার কথা স্পষ্টই বলা আছে।
খবরটি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে অনেকেরই। যারা পত্রিকার খবরটি দেখেননি, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দ্রুতই তা জেনে গেছেন। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া খবরটি ছিল ওইদিন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। তবে খবরটি আবার অনেককে অবাকও করেনি। তাদের বক্তব্য হলো, যে দেশে আড়াই বছর আগে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে পুলিশ বোমা ছুঁড়তে দেখে, সেদেশে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করতে দেখা পুলিশের পক্ষে অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। আমাদের পুলিশের দিব্যদৃষ্টি খুলে যাওয়ায় তারা এখন এসব অলৌকিক ঘটনা চোখে দেখছে এবং প্রয়োজন মতো ব্যবস্থা নিচ্ছে। তারা শুধু দেখতে পায় না সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের, চোর-গুন্ডা, ছিনতাইকারী, ডাকাত-ধর্ষকদের। তারা চোখ বুঁেজ থাকে শাসকদলের কর্মী-ক্যাডারদের দ্বারা নানান অপকর্ম সংঘটনের সময়।
সুনামগঞ্জের তারা মিঞা যে ধরনের মামলার আসামি হয়েছে, এ ধরনের মামলার অভাব নেই সারাদেশে। গত কয়েক বছরে এমন মামলার আসামী হয়েছে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী। তাদের কেউ কেউ জামিন পেয়েছে। আর বেশির ভাগ জামিনের আশায় আদালতের বারান্দায় তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে। পুলিশি হয়রানির হাত থেকে বাঁচার জন্য এসব মামলার অভিযুক্তরা আগাম জামিনের জন্য ছুটে আসে হাইকোর্টে। কোর্টের বারান্দায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে জামিনের আদেশ পাবার আশায়। হাইকোর্টে গেলেই এ দৃশ্য চোখে পড়ে। জামিন নিতে আসা ব্যক্তিদের ভিড়ে হাঁটাচলা করাই কষ্টকর সেখানে।
বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থবির করে দিতেই সরকার এসব মামলার পথ ধরেছে। তারা এসব মামলাকে বলছে ‘গায়েবি মামলা’। নামকরণে তেমন কোনো ভুল আছে বলে মনে হয় না। কেননা, এসব মামলার আসামিরা জানে না তাদের কী অপরাধ। এমন কি যে মানুষটি ঘটনার সময় ছিলেন দেশের বাইরে তাকেও করা হচ্ছে আসামি। নিজের কথাই বলি। আমি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছি ২০১৬ সালের ১২ আগস্ট। আড়াই বছর ধরে আমি কোনো রাজনৈতিক দল বা কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। অথচ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আমার উপজেলায় নৌকা মার্কার দু’টি ক্যাম্প পোড়ানোর অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আমাকেও আসামি করা হয়েছে। এ খবরে আমার পরিচিতজনেরা যেমন বিস্মিত হয়েছেন, আমি নিজেও কম বিস্মিত হইনি! এটাও একটি ‘হার্ড টু বিলিভ’ ধরনের ঘটনা। সচেতন ব্যক্তিরা এসব মামলাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক বললেও সরকারের তরফ থেকে তা বরাবরই অস্বীকার করা হচ্ছে। সেদিনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না, যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট’ অভিযোগ আছে। হ্যাঁ, অভিযোগ থাকতে পারে। তবে, তার সবই পুলিশ বা স্থানীয় আওয়ামী লীগের মনগড়া।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা বা পরাভ‚ত করার কালচার যেন উঠেই যাচ্ছে। এখন শক্তি, তা পেশি কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা যেটাই হোক, তা-ই যেন প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। কোনো বিশেষ দল বা সরকারের কথা বলছি না। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারাই এ ঘৃণ্যপন্থা অবলম্বন করে। তবে, বর্তমানের মতো তা অতীতে এতটা প্রকট ছিল না। নির্বাচনের আগে সিইসি বলেছিলেন, সিডিউল ঘোষণার পর কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। কিন্তু হা হতোষ্মি! গ্রেফতার তো বন্ধ হয়ই নি, উল্টো নতুন নতুন মামলার জালে আটকে বিরোধী দলীয় কর্মীদের করা হয়েছিল মাঠছাড়া! একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দেশে এ ধরনের পরিবেশ কি বাঞ্ছনীয়? অনেকে ভেবেছিলেন, নির্বাচনের পরে হয়তো বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে রকম কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। মামলা দায়ের এবং অব্যাহত গ্রেফতারের খবর প্রতিদিনই আসছে গ্রাম-গঞ্জ থেকে।
নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন উপলক্ষে অনেক কথাই বলেছেন। বলেছেন আগামী দিনে বাংলাদেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে তার নানা পরিকল্পনার কথা। তন্মধ্যে দু’টি কথা অনেকেরই ভালো লেগেছে। এক. তিনি বলেছেন, ‘এখন আমি সবারই প্রধানমন্ত্রী’ আর দুই. ‘এতবড় বিজয়ের পর আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেছে’। নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রীসুলভ কথা বটে। এটাতো ঠিক যে, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর দেশের সব নাগরিক তার দৃষ্টিতে সমান বলে বিবেচিত হবে। যারা তাকে ভোট দেয়নি, তিনি তাদেরও প্রধানমন্ত্রী। হতে পারে তারা তাকে সমর্থন করে না। কিন্তু যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক প্রধানমন্ত্রী, সে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুবিচার আশা করবেন- এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে যারা সরকারি দল বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের নিবর্তনের শিকার হচ্ছে, তাদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপরই বর্তায়। আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের যেসব অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেসবের মধ্যে চলাফেরা, সভা-সংগঠন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্যতম। আর এগুলোর সম্মিলিত রূপই হলো জনগণের রাজনৈতিক অধিকার। সেখানে এটা বলা হয়নি যে, যে দল সরকার চালাবে তারা এক ধরনের সুযোগ পাবে, আর বিরোধীদলের জন্য হবে অন্য রকম ব্যবস্থা। তাছাড়া সংবিধান নাগরিকদের যেসব অধিকার দিয়েছে, রাষ্ট্রের পক্ষে তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও ক্ষমতাসীন সরকারের ওপরই বর্তায়। ফলে দেশবাসী সঙ্গত কারণেই আশা করে, প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তা তিনি ‘মিন’ করেছেন। সবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই নাগরিকদের ভরসাস্থল। তাছাড়া তিনি নিজেই বলেছেন তার দায়িত্ব বেড়ে যাবার কথা। সুতরাং তিনি সে বিরাট দায়িত্ব তার নেয়া শপথ অনুযায়ী পালন করবেন দেশবাসী তা আশা করতেই পারে।
ডেইলি স্টারের ওই প্রতিবেদনে তারা মিঞার আসামি হওয়ার ঘটনাকে ‘হার্ড টু বিলিভ’ অর্থাৎ বিশ্বাস করা কঠিন বলা হলেও এখন তা বিশ্বাস করতেই হচ্ছে। কেননা, চাক্ষুষ সাক্ষ্য-প্রমাণের পর ওই ঘটনাকে মিথ্যা বলবে এমন চক্ষুষ্মান অন্ধ কেউ আছেন বলে মনে হয় না। ওই প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়েছে কিনা জানি না। তার কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উচিত ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা। দেশবাসীর প্রত্যাশা- তিনি বিষয়টি দেখবেন। একজন পঙ্গু লোকের এ হয়রানি প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বরদাশত করতে পারেন না।
আমরা যারা দেশের সাধারণ নাগরিক তারা চাই না এমন কোনো ঘটনা ঘটুক, যা আমাদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হয়। আমরা চাই সামাজ শান্তিময় থাকুক। সব অনাচার-অবিচার দূর হোক। কিন্তু আমরা চাইলেই তো সব হবে না। চাইতে হবে রাষ্ট্রের যারা নিয়ন্ত্রক-পরিচালক, তাদের। আমরা আমাদের চোখের সামনে এমন সব ঘটনা ঘটতে দেখেছি, বা শুনেছি, যা বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা জেনেছি, জেনেছি কুমিল্লার সেই ভাগ্যাহত তরুণী সোহাগী জাহান তনুর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন ও খুনের ঘটনাও। কিন্তু ওই খুনের কোনো ক‚ল-কিনারা আজো হয়নি। পুলিশ খুঁজে বের করতে পারেনি ওই নির্মম হত্যাকান্ডের হোতাদের। বিশ্বাস করা সুকঠিন হলেও আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের চৌকস পুলিশ বাহিনী খুনিদের কোনো খোঁজই পাচ্ছে না। ওরা কি তাহলে কর্পুরের মতো হাওয়া হয়ে গেল?
যারা ভেবেছিলেন নির্বাচনের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে, তারা এখন প্রমাদ গুণছেন। গত কয়েকদিন ধরে সংবাপত্রের পাতা জুড়ে থাকছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একশ্রেণির নেতাকর্মীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনার খবরে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, গণধর্ষণ, এমন কি কর্তব্যরত পুলিশকে প্রহারের ঘটনাও তারা ঘটিয়ে ফেলছে! এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের এ অধঃপতনের পেছনের কারণ সম্পর্কে নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে, আফসোসের বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা সন্ত্রাসকে নির্মূলের কথা বললেও ছাত্রলীগ নামধারী ওইসব দুর্বৃত্তের লাগাম তারা টেনে ধরতে পারছেন না।
লেখাটি শুরু করেছিলাম সুনামগঞ্জের তারা মিঞার দুর্ভাগ্য নিয়ে। হ্যাঁ, এটাকে তার দুর্ভাগ্যই বলবো। কারণ, তার পঙ্গুত্বের জন্য রাষ্ট্র কোনো সহায়তা দিতে না পারলেও রাষ্টীয় একটি বাহিনী তাকে আদালতের বারান্দায় এনে দাঁড় করিয়ে রাখতে পেরেছে। আজ দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়ই নেতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেসব দেখে আমরা ব্যাথিত হই, রাষ্ট্র পরিচালকরা হন ক্ষুব্ধ। কিন্তু তাতে নিমর্ম বাস্তবতাকে কি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? খবরের কাগজেই বেরিয়েছে দেশের সবগুলো কারাগার এখন পরিপূর্ণ, কোথাও আবার উপচে পড়ছে বন্দি। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বলবৎ রয়েছে এমন একটি দেশে এ ধরনের পরিস্থিতি সত্যিইতো বিশ্বাস করা কঠিন! ‘হার্ড টু বিলিভ’ বা ‘আনবিলিভেবল’!
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।