পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতি বছরই ওরা আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা রং আর আকৃতির সেসব পাখির ক‚জনে মুখরিত হয় নদীপাড়, বিল-ঝিল, বন-বাদাড় সব। প্রতি শীতের শুরুতে দেশের জলাশয়গুলো ছেয়ে যায় যাযাবর পাখির ঢলে। ওদেরই আশেপাশে ভিড় জমায় বিচিত্র সব দেশি পাখি। শুভ্র আকাশে, সিগ্ধ বাতাসে ওরা মেলে ধরে ডানা। সৌন্দর্যে অতিথি পাখির আনাগোনা যেন ভিন্ন এক মাত্রা যোগায়। অক্টোবরের শুরু থেকেই সাধারণত অতিথি পাখিদের আগমন শুরু হয় বাংলাদেশে। শীতটা কাটিয়ে আবার ওরা পাড়ি জমায় নিজ দেশে। এরই ভেতর পাখি প্রেমিকরা মন ভরে দেখে নেয় তাদের। প্রতি বছর এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করে অনেকেই। কিন্তু এবার যেন কিছু একটা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলগুলো এমনিতেই অতিথি পাখির জন্যে বিখ্যাত। এবার এই প্রথম বারের মতো দেখা গেলো, ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি সেখানে লুটোপুটি খেলছে না। গেল বছর নভেম্বরের গোড়ার দিকে ডজন খানেক প্রজাতির অতিথি পাখি এসেছিল সেখানে। ওরা দেখলো বসবাসের জন্যে অনুক‚ল পরিবেশ আর নেই। দেরী করেনি ওরা, দ্রæতই চলে গেছে, প্রতি বছরই অল্প কিছু পাখি পরিবেশের অবস্থা দেখার জন্যে আসে। এরা ফিরে গিয়ে দলের পাখিদের জানায় পরিবেশের অবস্থা কী রকম। ক’সপ্তাহ আগে আবার এসেছে পাখি, সংখ্যায় এবারে আগের চেয়ে একটু বেশি। প্রতি বছর যেখানে হাজার হাজার পাখি আসতো, এবার সেখানে পাখির সংখ্যা অনেক কম। এ পাখিগুলোও যদি কোন কারণে ফিরে যায়, তাহলে এ মৌসুমে আর কোনো অতিথি পাখির দেখা মিলবে বলে মনে হয় না।
অবাক বিস্ময়ে মানুষ দেখে, হাজার হাজার পাখি এ সময়টাতে কোথা থেকে উড়ে আসে, তারপর কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। প্রায় দু’হাজার বছর ধরে চলে আসছে পাখিদের এই সাময়িক আসা-যাওয়া। পন্ডাইস্টোসিন হিমযুগে পৃথিবীর উত্তর বরফে ঢেকে গেলে বাঁচার তাগিদে পাখিরা ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় দক্ষিণ গোলার্ধে। অবস্থা বদলে গেলে পাখিরা আবার ফিরে যায় নিজ ভ‚খন্ডে। দিনের আলো যখন উত্তর গোলার্ধে কমতে থাকে, পাখিদের প্রজনন গ্রন্থি তখন নিষিদ্ধক্রিয় হতে থাকে। সে সঙ্গে দেশান্তরে যাওয়ার জন্যে চঞ্চল হয়ে ওঠে ওরা। দেশান্তরী এসব পাখির মূল বাসভ‚মি শীত প্রধান এলাকা। সাইবেরিয়াসহ হিমালয়ের বনাঞ্চলে এদের বাস। শীত বাড়তেই এরা পাড়ি জমায় হাজার মাইল দূরদেশে। শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছে- বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, চখাচখিম সারস, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, মানিকজোড়- নাম না জানা কতো কী পাখি। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪-১৫ প্রজাতির হাঁস ছাড়াও গাগিনি, গাও, ওয়েল, পিগটেইল, ডাটাস্মক, থাম, আরাথিল, পেরিক্যান, পাইজ, শ্রেভির, বাটান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখিদের মধ্যে পৃথিবীর চৌম্বক শক্তিকে সূক্ষ¥ভাবে উপলব্ধি করার বিস্ময়কর এক ক্ষমতা আছে। পথের নিশানা এদের ভুল হয় না কখনো। কোথায় কতো উচ্চতায় অনুক‚লে বাতাস মিলবে, সেটি অনুভব করার শক্তিও আছে এদের। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাসও এরা আগেভাগেই পেয়ে যায়। সে জন্যে নিজ দেশে যখন শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকে, তখনই দেশত্যাগ করতে শুরু করে এরা।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ওদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই তো শুরু হয় পাখি শিকারীদের আনাগোনা। শিকারীর রক্তে জাগে খুনের নাচন। বন্দুকের নলে চকচকে করে লোভ। যদিও ৭৩-এ বন্য জন্তু (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ অনুসারে জীবজন্তু হত্যা, ফাঁদ পেতে ধরা বা অন্য কোনো উপায়ে ক্ষতি করা আইনত দÐনীয়। কাগুজে এ আইনের ভয়ে শিকারীরা দমে না। শৌখিন পাখি শিকারীদের উপদ্রব তাতে খানিকটা কমলেও পেশাদার পাখি শিকারীদের তৎপরতা একটুও কমেনি। শীতের পাখি আসা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে হাওর এলাকায় ধূম পড়ে যায় পাখি শিকারের। নানা রকমের জাল, পিঞ্জর, ফাঁদ তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। হাওর এলাকায় মানুষের নির্ভরতা বছরে একটি মাত্র ফসলের উপরে, সে কারণে অনেকেই শীত মৌসুমে পাখি শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করে। পাখি শিকার মানেই নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আর নৃশংসতা। বাজারে দশ-বিশ-একশো টাকায় অতিথি পাখি বিক্রি হতে দেখা যায়। রাতের বেলা জালের সাহায্যে ফাঁদ পেতে বন্দি করা হয় পাখিদের। দিনে এয়ারগান, বন্দুক, রিভলবার- এসব ব্যবহার করে মারা হয়। এখানে একটি ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া দরকার যে, পাখি শিকারের অস্ত্র হিসাবে প্রধানত এয়ারগান ব্যবহার করা হয়। কার্যকারিতার দিক থেকে পাখি মারা ছাড়া আর কোনো কাজে এয়ারগানের ব্যবহার নেই। এয়ারগান কেনা আর লাইসেন্স করার উদ্দেশ্য একটাই- পাখি শিকার। আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা এসব যে জানেন না, তা নয়। ভালোই জানেন তারা। কিন্তু সব জেনেও কেন এয়ারগান ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে না?
সৌন্দর্যই শুধু নয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যেও পাখিদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের অত্যাচারে অসম্ভব হয়ে পড়বে ফসল ফলানো। সেটিই যদি হয়, তাহলে নির্ভর করতেই হবে কীটনাশকের উপর। কিন্তু এটি তো পরিবেশের জন্যে খুবই ক্ষতিকর। যে দেশে পাখি বেশি সে দেশে পর্যটকের সংখ্যাও বেশি। কাজেই পাখি ঘাটতি অবশ্যই উদ্বেগের ব্যাপার। যে পাখি নিসর্গকে এতো সুন্দর করে, চোখকে এতো প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে এতো আলোড়িত করে, নিরীহ সে পাখির প্রাণ নেওয়াতে কী এতো সুখ মানুষের?
পাখিরা আসুক। ওদের কলকাকলীতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ। শিকারীর বন্দুকের আঘাতে যেন ডানা ভেঙ্গে থুবড়ে না পড়ে কোনো পাখি। সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে প্রয়োগ করতে হবে কার্যকরভাবে। তৎপরতা বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনকে। পাশাপাশি হাওর এলাকার মানুষদের জন্যে বিকল্প কর্মসংস্থান দরকার। মানুষের ক্ষুধার কাছে সবকিছু দাহ্য, পাখি তো বটেই। প্রকাশ্যে রাজপথে দিনের পর দিন পাখির বিপণন বন্ধ হলে পাখি শিকার প্রবণতা কমে যাবে, সেটি সহজেই বোঝা যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।