Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

প্রহসনের নির্বাচন যেন না হয়

সেলিম সামীর | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

দীর্ঘ ১০ বছর পর সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগুচ্ছে দেশ। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ভোটাধিকার বঞ্চিত দেশের মানুষ নতুন আশায় বুক বেঁধেছে। দীর্ঘদিন পর তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন এই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে, কিংবা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটা আদৌ প্রয়োগ করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে জনগণের মনে রয়েছে নানা সংশয়। এই সংশয়ের যথেষ্ঠ কারণও রয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমন পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি যে, ক্ষমতায় অধিষ্টিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের উপর মানুষ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারে। দেশের বিগত স্থানীয় নির্বাচনগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জনমনে এমন সংশয়কে আরও দৃঢ় করেছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটসহ অন্যান্য দল দশম সংসদ নির্বাচনকে বয়কট করেছিল এ সংশয় থেকেই। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে তারা আন্দোলন করে আসছিল তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর থেকেই। এই দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে শত জেল-জুলুম সয়েও শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি পূরণ হয়নি। এ কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বিএনপি জোটও নির্বাচনে আসার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ছিল। ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর বিএনপি জোট মূলত কৌশলগত কারণেই নির্বাচনমুখী হয়। তারপর থেকেই দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের হাওয়া লাগে। জনমনে নাগরিক ক্ষমতা প্রয়োগের আশা জাগতে থাকে। এবারের নির্বাচনে একটি বড় অংকের নতুন ভোটারও যুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনো অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন না হওয়ায় এসব তরুণ ভোটারও নিজের ভোট প্রয়োগের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য মুখিয়ে আছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের চলমান সহিংস নির্বাচনী পরিস্থিতি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে ভয় ও শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই দেশের মানুষ নির্বাচন কেন্দ্রিক এসব সহিংসতা প্রত্যক্ষ করছে। দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের সময়েই আ. লীগের দু’গ্রæপের সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনায় দুজন নিহত হওয়া, বিএনপির পার্টি অফিসের সামনে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ দিয়েই সহিংসতার শুরু। শুরু থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি আসনে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধা দেয়া হচ্ছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বাধা দিতে গিয়ে আ. লীগের আরও দু’জন কর্মী নিহতের ঘটনা ঘটেছে। ঘরোয়া ও উঠান বৈঠকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের উস্কানিমূলক বক্তব্য কর্মীদেরকে আরও হিংসাত্মক করে তুলছে। বিএনপির বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচারণায় হামলাসহ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতাদের গাড়ি বহরে হামলা হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে হামলা আর সহিংসতা তত বাড়ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের গাড়ি বহরে হামলার পর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ড. কামাল হোসেনের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় সহিংসতার স্বরূপ আরও বড় হয়ে সামনে এসেছে। এতসব ঘটনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের সামনেই ঘটেছে, কিন্তু পুলিশ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। পক্ষান্তরে বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর পুলিশের মামলা হামলা, ধর পাকড় অব্যাহত রয়েছে। পুলিশি পাকড়াও অভিযান আগের চেয়ে বরং এখন আরো বেড়ে গেছে। একদম নগন্য কর্মী ও সমর্থকরাও ধর-পাকড় থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। সমর্থকরা প্রার্থীর সাথে প্রচারণায় নামলেই চলছে পুলিশের ধর-পাকড়। সারা দেশেই এমন পরিস্থিতি বিদ্যমান। একদিকে সরকারদলীয় লোকদের হামলা, অন্যদিকে পুলিশের ধর-পাকড়ের ভয়ে তারা প্রচারণায় নামতেই পারছেন না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব ঘটনায় সিইসির আচরণ পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। এসব সহিংস ঘটনায় সিইসি নিন্দা আর বিব্রত হওয়ার অনুভূতি জানিয়েই যেন দায় সারছেন। এসব ঘটনার ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তিনি নির্বাচনকেন্দ্রীক সহিংসতা আরও বৃদ্ধির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, অথচ এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে সে ব্যাপারে ইসির কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সমন্বয় সভায় সিইসি বললেন, ‘কেউ যেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো তাÐব চালাতে না পারে।’ এজন্য তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সিইসির এমন মন্তব্য এবং নির্দেশ নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত ও পক্ষপাতমূলক। সিইসির এমন প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথকে যে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ করছে এবং করবে এমন ধারণা করা মোটেই অমূলক নয়।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে, নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর ধরপাকড়, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নজরদারি চলছে। সংস্থাটির মতে, নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনকে ঘিরে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে এবং এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি প্রতিষ্ঠানটির নেই। এজন্য বিভিন্ন দেশ ও বিদেশি সংস্থার পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন বলে মনে করেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘সরকার যখন নির্বাচন করে তখন তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন: নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হয়।’ কিন্তু নির্বাচন কমিশনসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পক্ষপাতমূলক বলে তিনি উল্লেখ করেন। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি দলের লোকজনের মনোনয়ন বাতিল করছে, অন্য দলেরটা করছে না। শুধু এক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে একটা অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ আমরা দেখছি না।’ এই পরিবেশে বিদেশি পর্যবেক্ষক না থাকলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এটা শুধু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আশঙ্কা নয়, বরং দেশের সর্বসাধারণ আজ এই আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত ও ভীত। নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে সহিংসতার মাত্রা যে আরও প্রকট আকার ধারণ করবে তা বলাবাহুল্য। শেষ পর্যন্ত সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে পারবে কি না, মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে কি না, এ নিয়ে দেশের জনসাধারণ আজ উদ্বিগ্ন। বিরোধী জোটের নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলন ও দাবির মুখে সরকার প্রধান সব সময়ই বলে এসেছেন যে, আমাদের সরকার একটি সুষ্ঠু, ¯¦চ্ছ এবং অবাধ নির্বাচন দেশের মানুষকে উপহার দিতে পারবে, সুতরাং নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকার প্রধানের কথার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং ক্ষমতার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সকল পন্থাই অবলম্বন করছেন ক্ষমতাসীনরা।
ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পথ সুগম করতে ক্ষমতাসীনরা যদি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে এভাবেই প্রভাবিত করেন, এটা ক্ষমতাসীনদের জন্য হীতে বিপরীতই হবে। তারা হয়তো ক্ষমতার মসনদটা তাদের দখলেই রেখে দিতে পারবেন, কিন্তু জনসমর্থন পুরোপুরি হারাবেন। আমরা আশা করব, ক্ষমতাসীনরা এমন আত্মঘাতি পথ থেকে সরে আসবেন এ নির্বাচন যেন প্রহসনের নির্বাচন না হয়, জাতি এটাই প্রত্যাশা করে।
লেখক : কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন