চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
সাধারণত কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনলে আমরা বলে উঠি- ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। এটি একটি ইসলামী ও কুরআনী বাক্য, যার দ্বারা আমরা প্রকাশ করি বেদনার অভিব্যক্তি। প্রাত্যহিক জীবনের নানা প্রসঙ্গে আমরা যে উচ্চারণ করি কিছু ইসলামী শব্দ-বাক্য, যেমন পরস্পর সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করি, আনন্দের সংবাদে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলি, ভবিষ্যতের ব্যাপারে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলি- এ খুবই ইতিবাচক ব্যাপার, আমাদের আলোকিত সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একে অবহেলা করা উচিত নয়। এই জ্যোতির্ময় বাক্যমালা যেন স্থায়ী হয় আমাদের জীবনে, হারিয়ে না যায় আগামীর জীবন ও সমাজ থেকে, সেদিকে মনোযোগ দেয়া আমাদের কর্তব্য। আর এ কারণেই প্রয়োজন এর বাণী ও বার্তা অনুধাবন করা এবং এর মর্ম ও মর্যাদা উপলব্ধি করা।
আমাদের আজকের আলোচ্য, ইন্না লিল্লাহ...। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ কথাটিতে দু’টো বাক্য আছে : ক. ‘ইন্না লিল্লাহি’, এর অর্থ, আমরা তো আল্লাহরই। খ. ‘ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’, আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। দু’টো বাক্যই গভীর মর্ম ও ব্যঞ্জনার ধারক, যার উপলব্ধি মুমিনের বুকে আনে প্রশান্তি ও নির্ভরতা আর তার হৃদয়ে জাগিয়ে দেয় এক পবিত্র প্রত্যাশা।
ইন্না লিল্লাহি, আমরা তো আল্লাহর
‘আমরা তো আল্লাহর’ কথাটিতে আছে এক অপূর্ব সমর্পণ এবং অদ্ভুত অন্তরঙ্গতা। আরবী ভাষা হিসেবেও বাক্যটির ভাব ও ব্যঞ্জনা এমনই। আরবী ভাষাবিদ মনীষীগণ এ বাক্যের তরজমা করেছেন এভাবে- আমরা তো আল্লাহর। অর্থাৎ তাঁর মাখলুক ও সৃষ্টি, মামলূক ও দাস। পৃথিবীতে মালিকানা বলে একটা কথা আছে। আমরা বহু কিছুর মালিক- বাড়ি-গাড়ি, জমিজমা, মিল-ফ্যাক্টরি আরো কত কিছুর। এই পার্থিব মালিকানার রয়েছে নানা সূত্র, যেমন, ক্রয়-বিক্রয়, হেবা, মীরাছ ইত্যাদি। আরো আছে, চাষাবাদ, উৎপাদন, রচনা ও অন্যান্য। এই যে মালিকানার নানা সূত্র, এগুলো তো সর্বজনস্বীকৃত। আর এই স্বীকৃতির উপরই চলছে গোটা পৃথিবীর সকল কাজ-কারবার। অথচ, লক্ষ করার বিষয় এই যে, এইসব সূত্রের কোনোটাকেই বলা যায় না, শূন্য থেকে সৃষ্টি। জমিজমা, ফলফসল, নানা প্রকারের খাদ্য ও পানীয় এবং অসংখ্য জীবনোপকরণ সরাসরি প্রকৃতি থেকে আহরিত, যা আল্লাহর দান। জেলে মাছ ধরে, মাছের উপর তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, মৌয়াল মধু সংগ্রহ করে, মধুর উপর তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, গাভী দুধ দেয়, গোয়ালের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, এরপর বেচাকেনার মাধ্যমে মূল্যের উপর বিক্রেতার আর পণ্যের উপর ক্রেতার মালিকানা সাব্যস্ত হয়। তদ্রূপ কলকারখানায় উৎপাদিত অসংখ্য বস্তুর মূল উপাদান প্রকৃতি থেকে আহরিত। আর আহরণকারী, অর্থাৎ মানবের চিন্তা-শক্তি ও কর্ম শক্তিরও স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা। সুতরাং আল্লাহপ্রদত্ত শক্তি দ্বারা আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতি থেকে শুধু ‘আহরণ’ ও উৎপাদনের দ্বারাই সাব্যস্ত হচ্ছে মানুষের মালিকানা, এরপর এরই ভিত্তিতে চলছে বেচাকেনা, দান, হেবা, ভোগ-উপভোগ, কোনো কিছুতেই কোনো বাধা থাকছে না। যদিও এই মালিকানার কোনো সূত্র বা উপায়কেই বলা যায় না নিরঙ্কুশ সৃষ্টি। বস্তুত এই জগৎ-মহাজগতের সব কিছুর উপর শুধু একজনের মালিকানাই একচ্ছত্র এবং শুধু তাঁর মালিকানার সূত্রটিই নিরঙ্কুশ ও ‘লা-শরীক’। সেই এক ও একক সত্তা হচ্ছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি আমাদের স্রষ্টা, আমাদের সত্তা ও সত্তার সকল উপকরণের স্রষ্টা, আমাদের জীবন ও জীবনোপকরণের স্রষ্টা। অবিমিশ্র তাঁর সৃজন আর নিরঙ্কুশ তাঁর মালিকানা। এরই সাক্ষ্য ও স্বীকৃতি হচ্ছে, ইন্না লিল্লাহ- আমরা তো আল্লাহর।
আল্লাহ যখন আমাদের খালিক ও মালিক- স্রষ্টা ও প্রভু তখন আমাদের বিষয়ে যে কোনো ফয়সালার অধিকার তাঁর রয়েছে; সুখের ফয়সালার, দুঃখের ফয়সালার; উন্নতির ফয়সালার, অবনতির ফয়সালার, জীবনের ফয়সালার, মৃত্যুর ফয়সালার। তেমনি তাঁর রয়েছে বিধান ও আদেশের অধিকার; প্রাণ দেয়ার, সম্পদ দেয়ার; পানাহার করার, পানাহার বর্জন করার; বিশ্রাম করার, বিশ্রাম ত্যাগ করার; ভোগ করার, ভোগ বর্জন করার; তাঁর আদেশ শিরোধার্য এবং তাঁর ফয়সালাই চূড়ান্ত। তিনি আমাদের স্রষ্টা ও মালিক; আমরা তাঁর সৃষ্টি ও আজ্ঞাবহ। দেখুন, আল্লাহ সম্পর্কে জগতের শ্রেষ্ঠ মানব ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীর কী বাস্তব অভিব্যক্তি- ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার দাস, পুত্র আপনার দাসের এবং পুত্র আপনার দাসীর। আমার সম্পর্কে আপনার ফয়সালা কার্যকর ও সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১০৩৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪১১৮
কিন্তু এতে শঙ্কার কিছু নেই। কারণ আমরা এমন এক স্রষ্টার সৃষ্টি ও আজ্ঞাবহ যিনি পরম করুণাময় ও পরম প্রজ্ঞাময়। যিনি নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছেন। কারো প্রতি এক কণা অবিচার তিনি করেন না। যে ভালো কাজের তাওফীক চায় তাকে তাওফীক দান করেন, যে বিশ্বাস করে তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেন। যে তাঁর দিকে এক হাত আসে তিনি তার দিকে চার হাত যান, যে হেঁটে হেঁটে আসে তিনি তার দিকে দৌড়ে় যান। এমন মালিকের ফয়সালা শিরোধার্য করার মাঝেই তো কল্যাণ। তো আমরা যখন বলি, ‘ইন্না লিল্লাহ’ (আমরা আল্লাহর) তখন তাঁর সকল বিধান শিরোধার্য করি, এবং তাঁর সকল ফয়সালায় সম্মতি ও সমর্পণ ব্যক্ত করি।
‘ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী
এ কথাটিতে আছে আখিরাতে ঈমানের ঘোষণা। পৃথিবীর নানা অবস্থা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এই পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। এখানের সুখও ক্ষণস্থায়ী, দুখও ক্ষণস্থায়ী। বিপদে আক্রান্ত হলে বুঝে আসে, পৃথিবীর সুখ কত অসার! পাবার প্রত্যাশা ও হারাবার বেদনার মাঝে বাস্তব সুখ কত ক্ষণিকের! স্বজন-প্রিয়জনের মৃত্যু স্মরণ করিয়ে দেয়, জীবন কত ক্ষণস্থায়ী! কত দ্রæত অপসৃয়মান। এই তো ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে এবং ‘সময়’ আসছে। হযরত ওমর রা.-এর বিখ্যাত বাণী- প্রতিদিন ঘোষণা হয়, অমুক মারা গেছে, অমুকের ইন্তেকাল হয়েছে। একটি দিন তো অবধারিত, যেদিন বলা হবে, ওমরের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর কী হবে?
মৃত্যুর পর সকলকে সেই মহাপরাক্রমশালী স্রষ্টার সম্মুখে দাঁড়াতে হবে, এই জীবন ও জগতে যাঁর মালিকানাই নিরঙ্কুশ। তাঁরই কাছে দিতে হবে কৃতকর্মের হিসাব। সেইদিন যার ব্যাপারে জাহান্নাম থেকে নাজাতের ও জান্নাতে দাখিলের ফয়সালা হবে সেই কামিয়াব। তো মানব-জীবনের এই বিপদাপদ এক একটি নিদর্শন ও উপলক্ষ। কীসের নিদর্শন? পার্থিব সুখের ক্ষণস্থায়িত্বের নিদর্শন। কীসের উপলক্ষ? মানুষের সতর্কতা ও সচেতনতার উপলক্ষ। সেই মানুষটিই তো জ্ঞানী যিনি উপলব্ধি করেন বিপদ-মৃত্যুর ভাষাহীন বাণী। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন- দুর্ভাগা সে যে মাতৃগর্ভেই ছিল দুর্ভাগা আর সৌভাগ্যবান সে যে উপদেশ গ্রহণ করে অন্যের দ্বারা। -সহীহ মুসলিম, ২৬৪৫
কবি বলেন-
প্রশংসা এক আল্লাহর/ আমরা যে মৃত্যুমুখে সবাই।
কত গাফিলজন রয়েছে গাফলতে,
অথচ আয়ু তার ফুরিয়ে গেছে।
কত সুখ ছিল আশারও অধিক-
ফল-ফসলে, বাগবাগিচায়,
হাসি-আনন্দে, শীতল বৃক্ষ-ছায়ায়।
অবশেষে চোখের পলকে,
সুখ ও সুখী দু’জনই চলে গেছে।
প্রশংসা এক আল্লাহর/ এ যে পরম শিক্ষা ভাই!
তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯০-১৯৪-এর অধীনে
কোনো বিপদে বান্দার মুখে যখন উচ্চারিত হয় এই দুটি বাক্য- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, তখন এর অর্থ-হয় আমি আল্লাহর ফয়সালা সর্বান্তকরণে মেনে নিচ্ছি। আর আমি আখিরাতে বিশ্বাস করি তাই এ বিপদে সবরের বিনিময় তাঁর কাছে প্রত্যাশা করছি। দেখুন, ছোট্ট দুটি বাক্যে ঈমানের কী মৌলিক সাক্ষ্য। আর তাই এর ফযীলতও অনেক।
কুরআন মাজীদের ইরশাদ- আমি তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের-
যারা তাদের উপর বিপদ এলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।
এদেরই উপর বর্ষিত হয় তাদের রবের পক্ষ হতে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত। আর এরাই সৎপথে পরিচালিত। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৫-১৫৭
হযরত উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- কোনো মুসলিমের উপর যখন বিপদ আসে আর সে ঐ কথাটি বলে যা বলতে আল্লাহ আদেশ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আরো বলে- ‘ইয়া আল্লাহ! আমার বিপদে আমাকে প্রতিদান দিন এবং হারানো বস্তুর চেয়ে উত্তম বস্তু আমাকে দান করুন’ তাহলে আল্লাহ তাকে উত্তম বস্তু দান করেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯১৮
আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
‘যখন বান্দার সান্তান মারা যায় আল্লাহ তাআলা তাঁর ফেরেশতাদের বলেন-
তোমরা আমার বান্দার সন্তানকে কবজ করেছ?
তারা বলেন-
জী হাঁ।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
তোমরা তার কলিজার টুকরা’কে কবজ করেছ?
তারা বলেন-
জী হাঁ।
আল্লাহ বলেন-
আমার বান্দা কী বলেছে?
তারা বলেন-
সে আপনার হাম্দ করেছে ও ইন্নালিল্লাহ... বলেছে।
আল্লাহ বলেন-
আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ কর আর তার নাম রাখ ‘বাইতুল হাম্দ’( প্রশংসার ঘর)। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১০২১ (‘হাসান’ সনদে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।