পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য মতে, যে কোন সময়ের তুলনায় দেশের ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিংখাত থেকে কয়েকটি বড় কেলেঙ্কারী মাধ্যমে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। যার বিরুদ্ধে সরকারী কোনো ব্যবস্থা সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। বাড়তি খেলাপি ঋণ, যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ বাগিয়ে নিতে রাজনৈতিক প্রভাব, পরিচালনা পরিষদে রাজনৈতিক পরিচয়, ব্যাংকারদের পেশাদারিত্বের অভাবে দেশের ব্যাংকিংখাত এখন ক্রান্তিকাল পার করছে।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমাদের করণীয় কী’ শীর্ষক এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংলাপে সভাপতিত্ব করেন।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বড় কয়েকটি জালিয়াতির মাধ্যমে গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুট হয়েছে। সোনালী, জনতা, বেসিক, এবি, ফারামার্স, প্রাইম, প্রিমিয়ার, এনসিসি, মার্কেন্টাইল, ঢাকা, যমুনা, এনআরবি কমার্শিয়াল, শাহজালাল এবং কেন্দ্রিয় ব্যাংক থেকে এ টাকা লুট হয়েছে। এই টাকা দিয়ে অনেকগুলো উন্নয়ন কাজের অর্থায়ন করা সম্ভব হতো।
তিনি বলেন, খেলাপী ঋণ, লোকসান ও মূলধন বেড়েছে। অনিয়মের ফলে মূলধন হারানো সরকারি ব্যাংকগুলোকে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। প্রয়োজন না থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতকে পরিচালনা করার জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে ব্যাংকিংখাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। সুশাসনের অভাবে বিভিন্নভাবে লুটপাট হওয়ায় পুরো আর্থিকখাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আগামী বছর সিপিডি একটা নাগরিক কমিশন করতে চায়। জাতীয় নির্বাচনের পরই এ কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি ব্যাংক খাত নিয়ে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনসহ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরবে। কেননা আলাদা কমিশন ছাড়া এ খাতের বিপর্যয় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এজন্য সরকার উদ্যোগ না নিলে সিপিডি নিজ উদ্যোগেই তা করবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংক খাত অর্থনীতির হৃৎপিন্ড। এ হৃৎপিন্ড সচল রাখতে সবাইকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়াও ব্যাংক খাত থেকে যারা টাকা বের করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের নিবৃত থাকতে বলেছেন ড. দেবপ্রিয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনি ইশতেহারে ব্যাংক খাতের বিষয় উল্লেখ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকার গঠনের পর ব্যাংকিং খাতের ব্যাপারে তারা (রাজনৈতিক দলগুলো) কী ভূমিকা রাখবে তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, বর্তমানে ব্যাংকিংখাতের অবস্থা একেবারেই নাজুক। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে মধ্যম আয়ের দেশের যে স্বপ্ন তা বাধাগ্রস্ত হবে। বিগত সরকার এ খাতের যে ক্ষতি করেছে তা পুষিয়ে নিতে আগামীতে কী করবে সেটি এখনই তাদের বলা উচিত। তা না হলে বিশাল এ খাতে মানুষের আস্থা ফিরবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, কয়েক বছর ধরে উন্নতি বদলে অবনতি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আমানতাকারীদের মুখে শুনেছি কোন ব্যাংকে অর্থ নিরাপদ। আগে এমন সংশয় ছিল না। ব্যাংকিং খাতকে রক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন উন্নতি হলেও তা টেকসই হবে না। কিছুদিন ভালো থাকার পর আগের জায়গায় চলে যাবে।
তিনি বলেন, এক সময় আইন করে ঋণ খেলাপী, অনিয়মকারী বাংক মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন আবার আমরা পেছনের দিকে চলে যাচ্ছি। নিয়ম কানুন শিথিল করা হচ্ছে।
ড. ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ বলেন, ভোটের আগে হাস্যকরভাবে প্রভাবশালী ঋণ খেলাপীরা সুবিধা নিয়েছেন। নতুন করে ঋণ নিয়ে পুরাতন খেলাপী ঋণের কিছু অংশ পরিশোধ করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হয়েছেন। তাই নির্বাচনে রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার করতে হবে, ব্যাংকিং খাতে হস্তক্ষেপ করা হবে না। রাজনৈতিক প্রভাবে সুবিধা গ্রহণ করবো না। তুলনামূলকভাবে ব্যাংকিং খাতকে বেশি সুরক্ষা দিতে হবে। তা না হলে আগামীতে অবস্থা হবে আরো ভয়াবহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত পুরো ধ্বংস না হলে ‘ক্র্যাক’ বা চিড় ধরেছে। পরিষদে রাজনীতি ঢুকেছে। ব্যাংকিং খাত রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। রাজনৈতিকভাবে বিকৃত প্রণোদনা বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের পেছনে ছুটছেন আর ছোটরা ঋণের জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে দৌড়াচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবীদ জাহিদ হাসান বলেন, বড় গ্রাহকদের হাতে ব্যাংকের ঋণ ও মালিকানা কেন্দ্রীভূত। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকের মালিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সুশাসনের অভাবে আমানতকারীদের স্বার্থ ঝুঁকিতে পড়ছে। ব্যাংক খাতকে রক্ষার জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, অর্থমন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ বাতিল করতে হবে এবং খেলাপী বা কোন গ্রাহককে অসীম সুবিধা দিতে হবে। এসবের জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন। তবে সবকিছুর জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা যোগাড় করতে সবার আগে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান বলেন, খেলাপীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মার্জার ও একীভূত আইন জোরদার করা দরকার।
মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. নুরুল আমীন বলেন, নির্বাচনী হলফনামায় দেশের ভিভিআইপিরা তাদের সম্পদের যে বিবরণ দিয়েছেন তা দেখলে মনে হয় তারা খুবই গরিব। অথচ বাস্তবতা কি তাই? তাদের হলফনামার তথ্য যদি আমরা সত্য ধরে নেই তবে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশের স্বপ্নতো সুদূর পরাহত! তার মতে, প্রার্থীরা যেমন সত্য তথ্য দিচ্ছেন না তেমনি ব্যাংকিং কিংবা দেশের আর্থিকখাত নিয়ে যত বুলিই আওড়ানো হোক প্রকৃত অবস্থা কিন্তু খুবই নাজুক। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সুশাসন জরুরি।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আওয়াল বলেন, ঋণ খেলাপী ও ব্যাংক লুটকারীদের নির্বাচনে মনোনয়ন না দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করতে হবে। তবে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করা গেলেও অন্তত তাদের নাম প্রকাশ করে লজ্জা (নেমিং অ্যান্ড শেমিং) দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
দি ফারমার্স ব্যাংকের এমডি এহসান খসরু বলেন, রাজনৈতিকভাবে একজন চরম প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তার আশেপাশের মানুষ ফারমার্স ব্যাংককে শেষ করেছে। দেড়লাখ গ্রাহককে অর্থ আত্মাসাত করেছে। ব্যাংকের অনিয়ম শুরু পরিষদ সদস্যদের অপরাধপ্রবণতা থেকে। এজন্য অবকাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। পরিচালকদের অনৈতিকতার কারণে যোগ্য ম্যানেজমেন্ট গড়ে উঠছে না। চাকরি যাওয়ার ভয়ে তারা পরিচালকদের অন্যায় মেনে চলছেন।
এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ, নতুন ব্যাংক অনুমোদন না দেওয়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিচারিক ব্যবস্থাসহ কয়েকটি সুপারিশও তুলে ধরে সিপিডি। যা বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকার কাজ করবে বলেও আশা প্রকাশ করে সিপিডি।
সংলাপে এছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর আবু আহমেদ, সাবেক অর্থসচিব সিদ্দিকুর রহমান, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী, ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।